নাম যা-ই হোক, এই নতুন ব্যবস্থা হল উচ্চবর্ণের জন্য সংরক্ষণ
himachal pradesh

চতুর চালে বাজি মাত?

নরেন্দ্র মোদী বা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আসলে জাতপাত, ধর্ম, ধনী, গরিবের ভেদাভেদ মুছে সকলের ভোট ঝুলিতে পুরে ফেলতে চান।

Advertisement
প্রেমাংশু চৌধুরী
শেষ আপডেট: ১৭ নভেম্বর ২০২২ ০৬:১৭
অপেক্ষায়: কে কোন হিসাব কষে ভোট দেবেন? হিমাচল প্রদেশে বিধানসভা নির্বাচনে ভোটারদের লাইন, শিমলা, ১২ নভেম্বর। পিটিআই

অপেক্ষায়: কে কোন হিসাব কষে ভোট দেবেন? হিমাচল প্রদেশে বিধানসভা নির্বাচনে ভোটারদের লাইন, শিমলা, ১২ নভেম্বর। পিটিআই

হিমাচল প্রদেশের ভোটে শেষ বার প্রচারে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী একটা কথা স্পষ্ট ভাষায় বলে এসেছিলেন। কোন আসনে কে প্রার্থী, তা দেখার দরকার নেই। পদ্মফুলে ভোট দিন। তা হলেই মোদীকে ভোট দেওয়া হবে।

লোকসভা ভোট নয়। হিমাচলের বিধানসভা ভোট। সেখানেও নরেন্দ্র মোদী শুধু নিজের নামে ভোট চাইছেন। পশ্চিমবঙ্গে গত দু’টি বিধানসভা নির্বাচনে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঠিক একই কৌশল নিয়েছিলেন। ২০১৬-র বিধানসভা ভোটের ঠিক ১৫ দিন আগে তিনি বলেছিলেন, “২৯৪টি কেন্দ্রে আমিই প্রার্থী। আমাকে ভোট দিন।” ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূলের প্রার্থী বাছাই পর্যন্ত অপেক্ষা করেননি। তার আগেই বলেছিলেন, “এই ভোট আমার ভোট। আমাকে ভোট দিন।”

Advertisement

নরেন্দ্র মোদী বা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আসলে জাতপাত, ধর্ম, ধনী, গরিবের ভেদাভেদ মুছে সকলের ভোট ঝুলিতে পুরে ফেলতে চান। ভোটারদের বাকি সব ভুলে গিয়ে শুধু তাঁদের উপরে ভরসা করতে বলেন। এক সময় যে ভাবে মানুষ শুধু ইন্দিরা গান্ধীর মুখের দিকে তাকিয়ে ভোট দিতেন। এখন মোদী-মমতা সেই পথে হাঁটতে চান। সে ক্ষেত্রে বিরোধীদের উপায় কী? ভোটব্যাঙ্কে ভেদাভেদ তৈরি করা। স্ববিরোধিতার মুখোশ খুলে দেওয়া।

সুপ্রিম কোর্ট উচ্চবর্ণের গরিবদের জন্য ১০ শতাংশ আসন সংরক্ষণে সিলমোহর দেওয়ায় নীতীশ কুমার-তেজস্বী যাদবরা নতুন করে জাতগণনার দাবি তুলেছেন। অখিলেশ যাদব আগেই এই দাবি তুলেছিলেন। ওবিসি বা অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির আসল সংখ্যা জানা যাবে। অনুমান করা হয়, দেশের জনসংখ্যায় ওবিসি-দের ভাগ ৫০ শতাংশের বেশি। তখন জনসংখ্যার অনুপাতে সরকারি চাকরি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ওবিসি-দের সংরক্ষণের দাবি উঠবে। ১০০ জনের মধ্যে ৫০ জনই ওবিসি হলে, সরকারি চাকরিতেও ১০০টি পদের মধ্যে ৫০টি পদ ওবিসি-দের জন্য সংরক্ষিত থাকা উচিত। এখন তা মাত্র ২৭ শতাংশ। নীতীশরা মনে করছেন, ওবিসি-দের জন্য আরও বেশি আসন সংরক্ষণের দাবি মোদীর বিরুদ্ধে নতুন অস্ত্র হয়ে উঠতে পারে। এত দিন সুপ্রিম কোর্টেরই লক্ষ্মণরেখা ওবিসি-দের জন্য অতিরিক্ত সংরক্ষণের পথে বাধা ছিল। তা হল, কোনও ভাবেই ৫০ শতাংশের বেশি আসন সংরক্ষিত করা যাবে না। তফসিলি জাতির জন্য ১৫ শতাংশ, জনজাতির জন্য ৭.৫ শতাংশ ও ওবিসি-দের ২৭ শতাংশ যোগ করলে এখন ৪৯.৫ শতাংশ আসন সংরক্ষিত থাকে। এ বার সুপ্রিম কোর্টই নিজের লক্ষ্মণরেখা তুলে দিয়েছে। উচ্চবর্ণের গরিব বা ইডব্লিউএস কোটায় ১০ শতাংশ আসন সংরক্ষণে সায় দিয়ে বলেছে, ৫০ শতাংশের বেশি সংরক্ষিত করা যেতেই পারে। ওবিসি-দের জন্য আরও বেশি সংরক্ষণের রাস্তাও খুলে গিয়েছে বলে নীতীশদের মত। বিজেপি চিরকালই ‘সমগ্র হিন্দুত্ব’-র ছাতার তলায় জাতনির্বিশেষে সব হিন্দুকে নিয়ে আসতে চায়। তাতে ফাটল ধরিয়ে ফের ওবিসি-দের এক ছাতার তলায় আনার স্বপ্ন দেখছেন নীতীশরা।

এ যেন নতুন করে ‘কমণ্ডলু বনাম মণ্ডল’-এর লড়াইয়ের পরিকল্পনা। কমণ্ডলু রাজনীতির বিরুদ্ধে ফের মণ্ডল রাজনীতি খাড়া করার স্বপ্ন। না কি দিবাস্বপ্ন? বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংহ মণ্ডল কমিশনের সুপারিশ মেনে ওবিসি সংরক্ষণ ও লালু-নীতীশ-মায়াবতী-মুলায়মদের জাতপাতের রাজনীতিতে বিজেপি-আরএসএস নেতৃত্ব হিন্দু ভোটব্যাঙ্কের আড়াআড়ি বিভাজন দেখতে পেয়েছিল। সেই মণ্ডল রাজনীতির মোকাবিলায় বিজেপি-আরএসএস কমণ্ডলু রাজনীতিকে হাতিয়ার করেছিল। রামমন্দিরের দাবিতে ফের হিন্দু ভোটব্যাঙ্ককে এককাট্টা করতে লালকৃষ্ণ আডবাণীর রথযাত্রা শুরু হয়েছিল। গত তিন দশকে হিন্দি বলয়ের ময়দানে কমণ্ডলু বনাম মণ্ডলের লড়াইয়ে কমণ্ডলুরই জয় হয়েছে। হিন্দুত্বের আবেগ, উন্নয়নের স্বপ্নকে সামনে রেখে বিজেপি জাত-রাজনীতিতে ধস নামিয়েছে। নীতীশ-তেজস্বীরা আবার কমণ্ডলুর বিরুদ্ধে মণ্ডল রাজনীতি শুরু করতে চাইছেন।

লালকৃষ্ণ আডবাণীর সেই কমণ্ডলু এখন নরেন্দ্র মোদীর হাতে। সেই কমণ্ডলুতে এখন আর শুধু হিন্দুত্ব, উন্নয়ন নয়, তফসিলি জাতি, জনজাতি এবং ওবিসি-দের জন্য পরিচিতিসত্তার রাজনীতিও রয়েছে। ‘লাভার্থী বর্গ’ নামক নতুন ভোটব্যাঙ্কও মোদীর কমণ্ডলুতে। মোদী নিজে ওবিসি। তিনি ওবিসি নেতাদের সরকারে তুলে এনেছেন। ওবিসি-দের জন্য ডাক্তারিতে আসন সংরক্ষণ করেছেন। প্রথমে তিনি দলিত বা তফসিলি জাতির রামনাথ কোবিন্দকে রাষ্ট্রপতি করেছিলেন। এ বার আদিবাসী বা তফসিলি জনজাতির দ্রৌপদী মুর্মু রাষ্ট্রপতি পদে। এই প্রতীকী রাজনীতি মোদীর ঝুলিতে তফসিলি জাতি, জনজাতি, ওবিসি ভোট এনে দিয়েছে। জাতপাতের ঊর্ধ্বে উঠে বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের সুবিধাভোগী বা ‘লাভার্থী বর্গ’-এর ভোটব্যাঙ্কও তৈরি করেছেন মোদী। তাতে দলিত, আদিবাসী, ওবিসি, মায় মুসলমানরাও বাদ যাননি বলে বিজেপি বোঝাতে চায়। সর্বোপরি মোদীর নিজস্ব ভোটব্যাঙ্ক রয়েছে। যাঁরা সব ভুলে শুধু মোদীতেই ভরসা করেন। বাকি ছিল বিজেপির চিরাচরিত উচ্চবর্ণের ভোটব্যাঙ্ক। তার জন্যই ১০ শতাংশ আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা। ইডব্লিউএস নামেই গরিবদের মধ্যেও গরিবতমদের কোটা। বছরে ৮ লক্ষ টাকা বা মাসে ৬৬ হাজার ৬৬৬ টাকা আয় পর্যন্ত পরিবারের ছেলেমেয়েরাও এই কোটার সুবিধা পাবেন। কিন্তু তফসিলি জাতি, জনজাতি, ওবিসি-র গরিবরা বাদ থাকবেন। নাম যা-ই হোক, আসলে এটি শুধুমাত্র উচ্চবর্ণের জন্য সংরক্ষণ।

এখানেই মোদীর সাফল্য। অনগ্রসরদের না চটিয়েই উচ্চবর্ণের জন্য আসন সংরক্ষণ করতে পারেন। ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের আগেই মোদী সরকার সংবিধান সংশোধন করে উচ্চবর্ণের গরিবদের জন্য আসন সংরক্ষণ করেছিল। কিন্তু লোকসভা ভোটের প্রচারে তা নিয়ে মোদীকে গলা ফাটাতে হয়নি।

মোদীর এই কমণ্ডলুতে একটিই স্ববিরোধ রয়েছে। তা হল, বিজেপি তথা আরএসএস বরাবরই জাতপাতের ভিত্তিতে সংরক্ষণের বিরুদ্ধে। সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবত অনেক বারই মুখ ফস্কে সে কথা বলে ফেলেছেন। উচ্চবর্ণের গরিবদের জন্য সংরক্ষণে সুপ্রিম কোর্টের সিলমোহর আদায় করে বিজেপি কার্যত শুধুমাত্র অর্থনৈতিক মাপকাঠিতেই সংরক্ষণের পথ খুলে দিল। রাজনীতিতে, প্রশাসনে, সমাজে শুধুমাত্র উচ্চবর্ণের ছড়ি ঘোরানো বন্ধ করতে, সমাজের প্রভাবশালী শ্রেণিতে দলিত, অনগ্রসরদের তুলে আনতেই ভীমরাও আম্বেডকর সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছিলেন। উচ্চবর্ণের জন্য সংরক্ষণ করে বিজেপি তার উল্টো পথে হাঁটছে। তাতে উচ্চবর্ণের আধিপত্যই কায়েম থাকবে। উচ্চবর্ণের অনেকেরই মনে ভুল ধারণা কাজ করে যে জনসংখ্যায় জেনারেল ক্যাটেগরির ভাগই বেশি। তাই জেনারেল ক্যাটেগরির জন্যই সিংহভাগ আসন সংরক্ষিত থাকা উচিত। বাস্তব তা নয়। জাতগণনা হলে দেখা যাবে, দেশের জনসংখ্যায় অনগ্রসররাই সংখ্যাগুরু। উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণ, কায়স্থরা আদতে সংখ্যালঘু। বিজেপি তা চায় না। তাই মোদী সরকার জাতগণনার পথেও হাঁটতে নারাজ।

নীতীশ-তেজস্বী-অখিলেশরা জাতগণনার দাবি তুলে বিজেপির এই স্ববিরোধিতাকেই প্রকাশ্যে এনে ফেলতে চাইছেন। মুশকিল হল, গত তিন দশকে সামাজিক ন্যায়ের পক্ষে আন্দোলনকারী লালু-নীতীশ-মায়াবতী-অখিলেশদের দলেরও চরিত্র বদল হয়ে গিয়েছে। তাঁরা এখন দলিত-ওবিসির সঙ্গে উচ্চবর্ণের ভোটও চাইছেন। তাই ওবিসি-দের জন্য আরও সংরক্ষণের দাবি তুললেও তাঁরা উচ্চবর্ণের সংরক্ষণের বিরোধিতা করতে পারেন না। তাঁদের ভয়, বিজেপি ইতিমধ্যেই তাঁদের দলিত-ওবিসি ভোটে ভাগ বসিয়েছে। ইডব্লিউএস কোটার বিরোধিতা করলে উচ্চবর্ণের ভোটের ছিটেফোঁটাও মিলবে না। একই কারণে কংগ্রেসও ইডব্লিউএস কোটার পরিকল্পনা ইউপিএ জমানাতেই হয়েছিল বলে কৃতিত্ব দাবি করছে। বিজেপির শীর্ষনেতৃত্বই বরঞ্চ সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরে ঢাক পেটায়নি। কারণ মোদী উচ্চবর্ণ ও দলিত-অনগ্রসর, দু’দিকের ভোটই নিজের হাতে রাখতে চান।

উচ্চবর্ণের সংরক্ষণকে কেন্দ্র করে ফের কমণ্ডলু বনাম মণ্ডল রাজনীতির লড়াই হবে কি না, সে উত্তর পরে মিলবে। আপাতত ‘অ্যাডভান্টেজ মোদী’।

আরও পড়ুন
Advertisement