Mental Health

মনের উপর ভয়ের আঘাত

হুমকি প্রথার দাপট অবশ্য নতুন নয়। এ রাজ্যে হোক বা অন্য রাজ্যে, শাসকের কথার সামান্য এ দিক-ও দিক হলেই ব্যক্তিকে ডেকে পাঠানো, নানা ভাবে ভয় দেখানো চলছেই।

Advertisement
রত্নাবলী রায়
শেষ আপডেট: ১৭ অক্টোবর ২০২৪ ০৬:০৬

ভয় দেখানোর সংস্কৃতি। হুমকি প্রথা। ‘থ্রেট কালচার’। যে নামেই তাকে ডাকা হোক না কেন, মানুষের ন্যায্য অধিকারকে খারিজ করার এক মোক্ষম হাতিয়ার এটি। আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে এক তরুণী চিকিৎসকের মৃতদেহ উদ্ধারের পর থেকে রাজ্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে বিপুল আলোড়ন শুরু হয়েছে, তার মধ্যে থেকেই উঠে এসেছে এই শব্দবন্ধটি। প্রথমে স্বাস্থ্যব্যবস্থার প্রেক্ষিতে ‘থ্রেট কালচার’ শব্দটি প্রয়োগ হলেও, ক্রমে দেখা গেল এর ব্যাপ্তি আরও বেশি। মেডিক্যাল কলেজ তথা স্বাস্থ্য বিভাগের গণ্ডি ছাপিয়ে তার হাত পৌঁছে গিয়েছে শিক্ষা, বিনোদন থেকে শুরু করে রাজ্যের প্রতিটি পরিসরের গভীরে। বস্তুত যেখানেই ক্ষমতার আস্ফালন, সেখানেই জাঁকিয়ে বসেছে হুমকি প্রথা। নিজের রাজনৈতিক, প্রাতিষ্ঠানিক বা সামাজিক অবস্থান থেকে প্রাপ্ত সুবিধার শক্তিকে কাজে লাগিয়ে তুলনায় কম শক্তিসম্পন্ন মানুষের ক্ষতি করে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে, অবৈধ ভাবে তার থেকে সুবিধা আদায় করা, বা তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাকে কোনও কাজ করতে বাধ্য করা, একেই বলা চলে হুমকি প্রথা। এই হুমকি প্রথা কাজে লাগিয়ে একটি প্রতিষ্ঠান কতখানি পীড়নকারী হয়ে উঠতে পারে, আর জি কর কাণ্ড তার দৃষ্টান্ত।

Advertisement

হুমকি প্রথার দাপট অবশ্য নতুন নয়। এ রাজ্যে হোক বা অন্য রাজ্যে, শাসকের কথার সামান্য এ দিক-ও দিক হলেই ব্যক্তিকে ডেকে পাঠানো, নানা ভাবে ভয় দেখানো চলছেই। হুমকিতে কাজ না হলে কোথাও সদর দরজা আটকে পাঁচিল ওঠে, কোথাও বাড়িই ভেঙে দেওয়া হয়। এই সব কাজ হুমকি সংস্কৃতিকে আরও পুষ্ট করেছে। হুমকি মানেই ক্ষমতার অশ্লীল আস্ফালন। তার নানান রূপ। কখনও আঙুল তুলে শাসানো, কখনও বরফশীতল গলায় কী করতে হবে সেই নির্দেশ। কখনও প্রাণের ভয় দেখানো, কখনও রুটিরুজির ভয়। বৃহত্তর ভাবনায় এই হুমকি প্রথার শরিক খোদ রাষ্ট্র। এনআরসি, সিএএ করে রাষ্ট্রহীন করে দেওয়ার ভয় দেখানো কি আসলে থ্রেট কালচারেরই প্রকারভেদ নয়?

মানসিক স্বাস্থ্যের উপরে হুমকির একটি সুদূরপ্রসারী অভিঘাত রয়েছে। প্রথমত, হুমকির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে অপর পক্ষের প্রতি এক গভীর তাচ্ছিল্য। যাকে হুমকি দেওয়া হচ্ছে, এক দিকে যেমন তার ন্যায্য অধিকারকে পায়ে মাড়ানো হচ্ছে, তেমনই অন্য দিকে কোনও রকম সুস্থ আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে তাঁর মত বদল করে নিজের পক্ষে আনার যে সম্ভাবনা, তা নাকচ করে দেওয়া হচ্ছে। ফলে হুমকির শিকার যিনি, তাঁর জন্য পড়ে থাকছে একরাশ আত্ম-অবমাননা। হুমকি প্রথার মাধ্যমে এক জন মানুষের সিদ্ধান্তকে শুধু নয়, তার নিজের সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতাকেও বাতিল করে দেওয়া হয়, কেড়ে নেওয়া হয় তাঁর স্বাভাবিক অধিকার। ফলে সমাজের চোখে তো বটেই, নিজের কাছেও তিনি খাটো হয়ে যান। যা মানসিক অত্যাচারেরই নামান্তর।

এই মানসিক চাপ সইতে সইতে হয়তো কেউ কেউ রুখে দাঁড়ান, প্রতিবাদ করার মানসিক জোর জড়ো করতে পারেন। আবার অনেকেরই সেই ক্ষমতা থাকে না। তিল তিল করে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার পরে নিজেকে শেষ করে দেওয়ার কথাও ভাবতে পারেন কেউ কেউ। খুঁজলে দেখা যাবে, কী ভাবে যুগে যুগে হুমকির মুখে পড়েছেন দলিত জনগোষ্ঠী, সংখ্যালঘু যৌন অভিরুচির মানুষজন, এমনকি মনোরোগীরাও, তাঁদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর যার প্রভাব অপরিসীম!

মানসিক হাসপাতালেও চলে ‘থ্রেট কালচার।’ মন-সামাজিক কর্মী হিসাবে মানসিক হাসপাতালে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, কী ভাবে মনোরোগীরা ‘ভাল পেশেন্ট’ না হলে ইনজেকশন দেওয়ার, ওষুধের ডোজ় বাড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখানো হয়। মনে পড়ে, এক মনোরোগী সামান্য সুজি খেতে চাওয়ায় তাঁকে শোনানো হয়েছিল, “ও সব বাড়ি গিয়ে খাবেন।” অকারণ রূঢ়তাও যে কোনও ব্যক্তিকে মানসিক ভাবে বিপন্ন করে তোলার জন্য যথেষ্ট।

আর জি কর কাণ্ডের পর সমাজ ও প্রশাসনের সর্বত্র গজিয়ে ওঠা এই থ্রেট কালচারের বিরুদ্ধে এখন মুখ খুলছেন অনেকেই। প্রতিরোধ শুরু হয়েছে, দাবি উঠছে ঘুঘুর বাসা ভাঙার। প্রতিবাদ মিছিল, সমাবেশ, অভিযানে হুমকি প্রথার দিকে পাল্টা আঙুল উঠছে। মানসিক স্বাস্থ্যের অধিকার নিয়ে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের এই প্রতিবাদের থাকার একটি বিশিষ্ট ভূমিকা আছে। আমরা মনে করিয়ে দিতে চাই যে, কর্মক্ষেত্রে সুরক্ষা মানে কেবল কিছু উচ্চপ্রযুক্তির সরঞ্জাম এবং সুরক্ষাকর্মী নিয়োগ করা নয়। শেষ বিচারে দেখতে হবে, যাঁরা ওই প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন, তাঁরা যে কোনও সময়ে, যে কোনও স্থানে যথেষ্ট সুরক্ষিত ও স্বচ্ছন্দ বোধ করছেন কি না। নিরাপত্তার বোধটা আক্রান্ত হওয়ার মানে, কর্মক্ষেত্রে তাঁর মানসিক স্বাস্থ্যের অধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে।

এই হুমকি প্রথা অবসানের উপায় কী? হুমকির উৎস প্রধানত রাজনৈতিক শক্তি। তাই দরকার ব্যক্তিগত দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে নাগরিকদের একজোট হওয়া, একজোট থাকা, সামাজিক সংগঠন গড়ে তোলা। দ্বিতীয়ত, নিজের চিন্তাভাবনা পাল্টানো ভিতর থেকে। কারণ শাসক আসে-যায়, বদলায় না সার্বিক ব্যবস্থা বা ‘সিস্টেম’। সঙ্কীর্ণ স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে সুস্থ নাগরিক ভাবনার চর্চা করতে পারলে, সমাজের প্রতিটি স্তরে ভারতের সংবিধানের শিক্ষাকে পৌঁছে দিতে পারলে তবেই তার বদল সম্ভব। বদলে-যাওয়া মানুষই ব্যবস্থা বদলাতে পারে। যা এক দিন থ্রেট কালচারেরও অবসান ঘটাবে।

আরও পড়ুন
Advertisement