ফাইল ছবি
ভারত আর তালিবানের সম্পর্ক বিশ্লেষণ করতে গেলে মহীনের ঘোড়াগুলির একটি গানের লাইন মনে পড়ে, ‘তাকে যত তাড়াই দূরে দূরে / তবু সে, আসে মেঘলা চোখে ঘুরে ফিরে’।
ভারত কোনওদিন চায়নি, তালিবান কাবুলের মসনদে বসুক। কিন্তু ভারতের ভাগ্য এবং আফগানিস্তানের রাজনৈতিক ইতিহাস সেই আশায় জল ঢেলেছে বারবার। কেন ভারত তালিবানকে পছন্দ করে না? কারণগুলিও স্পষ্ট। প্রথমত, তালিবান পাকিস্তান মদতপুষ্ট জিহাদি সংগঠন, দ্বিতীয়ত, তালিবান আন্তর্জাতিক আইন এবং মানবাধিকারের বিরোধী।
এই যুক্তিগুলির সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন নেই। তবে তার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন অবশ্যই আছে। কারণ, প্রথমত, ভারত যে মুজাহিদিনকে (নর্দান অ্যালায়েন্স বা উত্তরের জোটের একাংশ) প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ভাবে সমর্থন দিয়েছিল, সেই দলের অনেক নেতারই মানবাধিকার লঙ্ঘন করার ইতিহাস তালিবানের থেকে কোনও অংশে কম নয়। দ্বিতীয়ত, এক সময় এই মুজাহিদিনের পিঠে ভর করে কাবুলে তাদের প্রভাব বিস্তারের স্বপ্ন দেখেছিল পাকিস্তান। নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় মুজাহিদিনের একাধিক নেতা ছিলেন ভারত-বিরোধী। আহমেদ শাহ মাসুদ তাঁদের মধ্যে অন্যতম। মুজাহিদিনদের মতে ভারত ছিল সোভিয়েতপন্থী এবং নাজিবপন্থী, তাই আফগান জনগণের বিরোধী। তাদেরকেই সমর্থন দেওয়ার মানে কী?
নরসিংহ রাও সরকারের কূটনীতির কারণে ধীরে ধীরে মুজাহিদিন ভারতের কাছে আসে। বরফ গলার চিত্র প্রথম দেখা যায় ১৯৯২ সালে। মুজাহিদিন নেতা এবং তৎকালীন আফগান রাষ্ট্রপতি বুরহানউদ্দিন রব্বানি জাকার্তায় ন্যামের (NAM) শীর্ষ সভায় যোগদানের আগে দিল্লিতে নরসিংহ রাওয়ের সঙ্গে বৈঠক করেন। পাকিস্তান তখনই বুঝতে পারে, মুজাহিদিনের ভারতের প্রতি দুর্বলতা বাড়ছে। তাই তারা বিকল্প খুঁজতে শুরু করে এবং পেয়েও যায়। ওদিকে, মুজাহিদিনদের নিজেদের মধ্যে কলহের কারণে গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি আরও দীর্ঘায়িত হয়। সেই অবস্থা থেকে দেশকে বাঁচানোর স্বপ্ন দেখিয়েই মোল্লা ওমরের নেতৃত্বে তালিবান নিজেদের জায়গা করে নেয়। তালিবানের জন্য পাকিস্তান এবং সৌদি আরব থেকে ব্যাপক অর্থ এবং অস্ত্র সাহায্যে আসতে থাকে। পাকিস্তানের লক্ষ্য ছিল একটাই— কাবুলে বন্ধু সরকার। যা হবে ভারত-বিরোধী। তালিবানের আক্রমণের সামনে একের পর এক মুজাহিদিন নেতা এবং যুদ্ধপতিরা আত্মসমর্পণ করে এবং অচিরেই কাবুলের দখল নেয় তালিবান।
ভারত মুজাহিদিনকে নিয়ে এতই ব্যস্ত ছিল, যে তালিবানের উত্থানের বিষয়টিকে প্রথমে গুরুত্বই দেয়নি। ওই সময় আফগানিস্তানে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার চোখ-কান-মাথা পুরোটা জুড়ে ছিলেন আহামেদ শাহ মাসুদ। তার যা ফল হওয়ার কথা, তা-ই হয়েছিল। ১৯৯৬ সালে তালিবানের কাবুল দখল এবং নাজিবুল্লার হত্যা ভারতের দরজায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল কূটনৈতিক সঙ্কট। আমেরিকা এবং ইউরোপের দেশগুলির সঙ্গে ভারতও ওই পৈশাচিক হত্যার নিন্দা করে এবং সকলের শেষে হলেও দূতবাস বন্ধ করে কাবুল থেকে চলে আসে। দিল্লি সিদ্ধান্ত নেয়, মুজাহিদিনদের নিয়ে গঠিত উত্তরের জোটকে সমর্থন করবে। এই সিদ্ধান্তের ফলে তালিবানদের সঙ্গে আলোচনার দরজা সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। দীর্ঘ মেয়াদে বোঝা যায়, উত্তরের জোটকে সমর্থন করে ভারত রাজনৈতিক অথবা কূটনৈতিক কোনও সাফল্য পায়নি।
তালিবান বহুবার ভারতের সঙ্গে আলোচনা এবং সুসম্পর্ক গড়তে চাওয়ার সঙ্কেত দিয়েছে। কিন্তু ভারত সরকার সেই ডাকে সাড়া দেয়নি। সাড়া না দেওয়ার কারণ হিসেবে ভারত বলেছে, ‘‘তালিবান পাকিস্তানের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং তাদের সঙ্গে আলোচনা মানে তালিবান সরকারের কাছে নত হওয়া।’’ এই ভাবভঙ্গির ফলে অচিরেই ভারত এবং কাবুলের সম্পর্ক পাকাপাকি ভাবে ঠান্ডা ঘরে চলে গিয়েছে অনেকদিন আগেই। এর ফল ভারত পায় ১৯৯৯ সালে। যখন নেপাল থেকে ছিনতাই হওয়া ভারতীয় বিমান কন্দহরে অবতরণ করানো হয়। শোনা যায়, তালিবানের সঙ্গে মধ্যস্থতার পথ খুলতেই সমস্যায় পড়তে হয় ভারতকে। কারণ, ওই সময় আফগানিস্তানের মাটিতে ভারতের হয়ে প্রাথমিক আলোচনা শুরু করার মতো কেউ ছিলেন না। তবে আলোচনা শুরু হয় যখন দিল্লি থেকে প্রতিনিধিরা উড়ে যান। তালিবান ভাল-খারাপ দুটি চরিত্রে অবতীর্ণ হয়ে ঘটনাটিকে সামাল দেওয়ার সঙ্গে সম্ভবত শেষবারের মতো ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার ইচ্ছে প্রকাশ করে। তৎকালীন বিদেশমন্ত্রী যশবন্ত সিংহ তালিবানের ভূমিকার প্রশংসা করেও জানিয়ে দেন যে, ভারত তার ঘোষিত সিদ্ধান্ত থেকে একচুল নড়বে না। তার দু’বছর পরে আমেরিকার হস্তক্ষেপে তালিবান সরকারের পতন হয়।
তালিবানের পিছনে পাকিস্তানের সমর্থন আছে, সে কথা কারও অজানা নয়। কিন্তু তালিবানের উপর পাকিস্তানের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ছিল এবং আছে, এ কথা বলা ভুল হবে। অন্য অনেক দলের মতো তাদের মধ্যেও মতপার্থক্য রয়েছে। হক্কানিরা ঘোষিত পাকিস্তানপন্থী হলেও আবদুল গনি বরাদরের মতো নেতারাও রয়েছেন। যাঁরা পাকিস্তান বিরোধী হিসেবে পরিচিত। এই মর্মে বলে রাখা ভাল, হক্কানিদের অন্যতম শীর্ষনেতা আনাস হক্কানি ভারতের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে সংবাদমাধ্যমের কাছে মতামত দিয়েছিলেন। তালিবানদের আর এক গুরুত্বপূর্ণ নেতা আব্বাস স্ত্যানিকজাই সম্প্রতি ভারতের কাছে অনুরোধ করেছেন দূতাবাস বন্ধ না করার জন্য। আরও একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, পাকিস্তানের বহু চেষ্টা সত্ত্বেও তালিবান কখনও ‘ডুরান্ড সীমানা’ ( ব্রিটিশ নির্ধারিত আফগানিস্তান-পাকিস্তান সীমান্ত) মেনে নেয়নি। তালিবানও চায়, ভারতের মতো দেশগুলি তার সরকারকে স্বীকৃতি দিক।
২০১০ সালের লন্ডন বৈঠকে যখন আমেরিকা প্রথম তালিবানের সঙ্গে আলোচনা শুরু করার প্রস্তাব দেয়, তখন ভারত তার বিরোধিতা করেছিল। তবে ধীরে ধীরে দোহা আলোচনা যত এগিয়েছে এবং আমেরিকার সেনা প্রত্যাহারের সম্ভাবনা যত বৃদ্ধি পেয়েছে, ভারত তালিবানের সঙ্গে আলোচনার গুরুত্ব উপলব্ধি করেছে। কখনও রাশিয়ায়, কখনও কাতারে একাধিক বার আলোচনায় বসেছে ভারত। কিন্তু কোনও বৈঠকই ফলপ্রসূ হয়নি। সম্ভবত ভারত বুঝতে পেরেছে, বিগত ২০ বছরে আফগানিস্তান গঠনে তার যে ভূমিকা, তা রক্ষা করতে গেলে তাকে গতবারের মতো ময়দান ছেড়ে চলে এলে হবে না। পাকা খেলোয়াড়ের মতো মাটি আঁকড়ে টিকে থাকতে হবে। ইতিমধ্যে আমেরিকা, ইরান, রাশিয়া, জার্মানি-সহ ইউরোপের অন্য দেশগুলির সঙ্গে ভারত আলোচনা শুরু করেছে। কিন্তু শুধু তা করলে তো হবে না। চিনের সঙ্গে আলোচনাও এখন গুরুত্বপূর্ণ। চিনকে আলোচনায় নিয়ে এলে তা ভারতের কূটনৈতিক পেশাদারিত্বের পরিচয় দেবে। মনে রাখতে হবে, একমাত্র কাবুলে টিকে থেকেই তালিবানের স্বেচ্ছাচারিতার বিরোধিতা করা সম্ভব। অন্য কোনও ভাবে তাদের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখা সম্ভব নয়।
এখানে বলা দরকার যে, বর্তমান পরিস্থিতিতে উত্তরের জোটের আর কোনও ভবিষ্যৎ নেই বললেই চলে। এটা বলতে কোনও দ্বিধা নেই যে, ২০০১-এর পর থেকে ভারতের আফগান নীতি তৈরি হয়েছে আমেরিকাকে ঘিরে। তবে ইতিবাচক ভূমিকার ফলে সাধারণ আফগান জনগণের মধ্যে ভারতের ব্যাপক জনপ্রিয়তাও রয়েছে। যা তালিবানের পক্ষেও অস্বীকার করা মুশকিল। তাই এটা আশা করা যায় যে, সব দিক বিচার করে ভারত তালিবানের সঙ্গে কাবুলের মাটিতে থেকেই আলোচনা চালাবে। এ ছাড়া ভারতের কাছে অন্য কোনও পথ নেই। খালি হাতে ফিরে এলে তা ভারতের বিদেশনীতির উপর মস্ত আঘাত হিসেবে গণ্য হবে। এখন সময় কূটনৈতিক সমীকরণ শক্তিশালী করা এবং তালিবানের অন্দরে ভারতের প্রতি নমনীয় গোষ্ঠীর সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাওয়া। এই পথ আপাত দৃষ্টিতে কঠিন হলেও অসম্ভব নয়।
(লেখক আন্তর্জাতিক সম্পর্কের গবেষক। মতামত একান্ত ব্যক্তিগত)