Environmental Awareness

চাই সচেতনতা আর সদিচ্ছা

ভূবিজ্ঞানীদের মতে, আমরা এখন উষ্ণযুগের মধ্য দিয়ে চলেছি, ক্রমে ক্রমে পৃথিবী আরও গরম হবে। জলবায়ুর অবক্ষয় কিন্তু তাতে আরও ইন্ধন দিয়ে চলেছে।

Advertisement
শ্রেয়া ঠাকুর
শেষ আপডেট: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০৪:২৭

শেষ গাছটা কাটা হয়ে গেলে, শেষ মাছটা ধরা হয়ে গেলে, শেষ জলধারাও বিষিয়ে গেলে আমরা বুঝব, টাকা খাওয়া যায় না।— উত্তর আমেরিকার ক্রি জনজাতি সম্প্রদায়ের এই প্রবাদ এই সময়ে দাঁড়িয়ে বড় প্রাসঙ্গিক মনে হয়। তাপপ্রবাহের ত্রাহি রব বার বার অনুভব করিয়েছে, প্রকৃতির কাছে আমরা আদতে কতটা অসহায়। সারা পৃথিবী ভয়ানক ভাবে উষ্ণ হয়ে উঠছে।

Advertisement

ভূবিজ্ঞানীদের মতে, আমরা এখন উষ্ণযুগের মধ্য দিয়ে চলেছি, ক্রমে ক্রমে পৃথিবী আরও গরম হবে। জলবায়ুর অবক্ষয় কিন্তু তাতে আরও ইন্ধন দিয়ে চলেছে। আইপিসিসি ২০২৩-এর রিপোর্টে স্পষ্টই বলা হচ্ছে, অ্যানথ্রোপজেনিক ক্লাইমেট চেঞ্জের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তাপপ্রবাহ ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। নিউ ইয়র্ক, মেক্সিকো সিটি, কায়রো, তেহরান, মস্কো-সহ বিশ্বের ২০টি বড় শহর নিয়ে ১৯৫০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত করা একটি সমীক্ষার উপর ভিত্তি করে আইপিসিসির এআর৬ রিপোর্টে দাবি, এই বছরগুলির মধ্যে কলকাতার ‘সারফেস এয়ার টেম্পারেচার’ বেড়েছে প্রায় ২.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

এ বারের তাপপ্রবাহে মানুষ তা বুঝেছেন। যদিও সদ্য ইঙ্গিত মিলেছে স্বস্তির বৃষ্টির। তবে, তাপপ্রবাহ যে ফিরে আসবে না, তার নিশ্চয়তা নেই। ২০২৩ সালের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে দেশে একটা বড় সময় ‘এল নিনো’র প্রভাব চলেছে। ফলে পশ্চিম থেকে শুষ্ক হাওয়া প্রবেশ করে বঙ্গোপসাগরের স্বাভাবিক জলীয় বাষ্পের গতি প্রতিরোধ করেছিল। বিশেষজ্ঞদের অনুমান যথার্থ ছিল— গোটা মে মাস, এমনকি জুন মাস পর্যন্ত এর প্রভাব বজায় থাকতে পারে।

সংবাদমাধ্যমে প্রতি বছর প্রকাশিত মৃত্যুর খবর মনে করিয়ে দেয় তাপপ্রবাহ কতখানি প্রাণঘাতী। সংবাদে আসে না এমন মৃত্যুও থাকে। এ বছরও ব্যতিক্রম হয়নি, এক স্কুলপড়ুয়ার মৃত্যু দিয়ে শুরু হয়েছিল তাপপ্রবাহ। গবেষণায় প্রকাশ, তাপপ্রবাহের প্রভাব ঘোরতর ভাবে পড়ছে বিশ্বের নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলির মৃত্যুহারে (প্রতি ১০০০ জনে কত জন মারা যাচ্ছেন)। যার মধ্যে ভারতও রয়েছে। এই দেশগুলিতে তাপপ্রবাহের সঙ্গে যুক্ত হয় অপরিকল্পিত নগরায়ণ, বাড়ির ত্রুটিপূর্ণ পরিকল্পনা ও ক্ষয়িষ্ণু সবুজের আচ্ছাদন। এনভায়রনমেন্ট ইন্টারন্যাশনাল-এ সদ্যপ্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে জানা গিয়েছে, পর পর দু’দিন যদি ৯৭ পার্সেন্টাইলের বেশি তাপপ্রবাহ চলতে থাকে, তবে মানুষের দৈনিক মৃত্যুহার বৃদ্ধি পায় অন্তত ১৪.৭ শতাংশ। আমদাবাদ, কলকাতা, মুম্বই, দিল্লি-সহ দশটি শহরের উপর ২০০৮ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত করা হয়েছিল এই সমীক্ষা।

এই যে জলবায়ুর অবক্ষয় নিয়ে এত বিতর্ক এর পিছনে মূল লক্ষ্য কিন্তু একটাই— মানবসভ্যতার অস্তিত্ব সঙ্কটের মোকাবিলা। ঠিক সেই চিন্তা থেকেই তাপপ্রবাহের আবহে এ বছরও আলোচনায় উঠে এসেছে বৃক্ষরোপণের কথা। সারা বিশ্বে না হোক, অন্তত নিজের শহরের দিকে তাকালে কিন্তু খানিক হতাশ লাগে। ফরেস্ট সার্ভে অব ইন্ডিয়ার ২০২১ সালের ‘স্টেট অব ফরেস্ট রিপোর্ট’ অনুসারে, ২০১১ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে কলকাতায় প্রায় ৩০ শতাংশ বৃক্ষ-আচ্ছাদন কমেছে। কমেছে দক্ষিণ শহরতলির বৃক্ষ-আচ্ছাদনও। তার পিছনে প্রবল ভাবে রয়েছে নগরায়ণের হাত, রয়েছে ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবও। অন্য দিকে, ২০১২-১৩ সাল থেকে শুরু হওয়া শহরের গাছ-শুমারির এখনও কোনও সার্বিক ছবি মেলেনি। খাতায়-কলমে প্রশাসনের নীতি রয়েছে প্রচুর। তার আড়ালে কতখানি কাজ হয়, প্রশ্ন থেকে যায়। এখনই যদি নড়েচড়ে না বসা যায়, তবে আর কবে?

অন্য দিকে, ব্যক্তিগত উদ্যোগের ক্ষেত্রে প্রয়োজনে ‘গেরিলা গার্ডেনিং’-এর সহায়তা নেওয়া যেতে পারে। আপাতভাবে শহর বা মফস্‌সলের খোলা জমিতে ব্যক্তিগত উদ্যোগে গাছের বীজ ছড়িয়ে দেওয়াকে বলা হয় ‘গেরিলা গার্ডেনিং’। এর জন্য তৈরি করা হয় বিশেষ ধরনের ‘সিড বম্ব’— মাটির গোলাকার স্তূপের মধ্যে ভরা হয় বীজ। সেই মাটির গোলক পুঁতে দেওয়া হয় জমিতে। সত্তরের দশকের শুরুতে নিউ ইয়র্কের লিজ় ক্রিস্টি, এমস টেলর ও মার্টিন গ্যালান্ট প্রবল ভাবে জনপ্রিয় করেন এই আন্দোলন। নিউ ইয়র্কের ব্যস্ত রাস্তার মাঝের ফাঁকা জায়গায় সূর্যমুখীর বীজ পুঁতেছিলেন তাঁরা। স্বভাবতই যে কোনও আন্দোলনের মতো ‘গেরিলা গার্ডেনিং’-এর সঙ্গেও আইনের বিশেষ সদ্ভাব ছিল না। কলকাতার বুকেও এমন কয়েক জন সবুজ যোদ্ধা ভালবেসেই শহরে গাছ ফিরিয়ে আনতে চান। কুর্নিশ জানাতে ইচ্ছে করে সেই মানুষগুলিকে, যাঁরা যশোর রোডের দু’ধারের প্রাচীন গাছগুলোকে নিয়ে এখনও লড়ে যাচ্ছেন। সঙ্কটজনক পরিস্থিতিতে রয়েছে শহরের বৃক্ক রূপে পরিচিত ‘ইস্ট ক্যালকাটা ওয়েটল্যান্ডস’।

বর্তমান সময়ের ভাষায় বলতে গেলে, পরিবেশবিদদের সঙ্গে প্রশাসনের সম্পর্কটি ‘ফ্রেন্ড জ়োন’-এর পর্যায়ভুক্ত। এই নিয়ে কথা বলতে ভাল লাগে, নীতিও তৈরি হয়, কিন্তু অঙ্গীকারে সমস্যা। কিছু ক্ষেত্রে তো সেটুকুও নেই, রয়েছে সংঘাত। কার্ল সাগান তাঁর পেল ব্লু ডট-এ বলেছিলেন, ‘লুক এগেন অ্যাট দ্যাট ডট। দ্যাটস হিয়ার। দ্যাটস হোম। দ্যাটস আস।’ বিন্দুসম নীল বাসস্থানের সঙ্গে নিজের শহরটির বুকেও শ্বাসের বাতাস ফেরানোর সদিচ্ছা দেখানোর সময় কি এখনও আসেনি?

আরও পড়ুন
Advertisement