লড়াই: সিওপি-২৯’এর মঞ্চের বাইরে পরিবেশ আন্দোলনের কর্মীরা। ২৩ নভেম্বর। ছবি: পিটিআই।
২০০৪। নয়াদিল্লিতে রাষ্ট্রপুঞ্জের এক সম্মেলনে আমেরিকান জলবায়ু-বিশারদ জ্যাক হল বলেন, তাঁর গবেষণালব্ধ ফল— জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারে বরফ যুগ। আমেরিকান প্রেসিডেন্ট রিচার্ড ব্লেক-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট রেমন্ড বেকার উপস্থিত ছিলেন সেখানে। তিনি উড়িয়ে দেন আন্টার্কটিক বরফের একটি বিশাল অংশ ধ্বংস সংক্রান্ত এই উদ্বেগকে। দিনকয়েকের মধ্যেই কিন্তু বরফ গলতে শুরু করে। শুরু হয় আবহাওয়া-সংক্রান্ত অদ্ভুত ঘটনার এক শৃঙ্খল, যার পরিণতি বিশ্বব্যাপী সুপারস্টর্ম। সমগ্র উত্তর গোলার্ধই নিমজ্জিত হয় এক নতুন হিমযুগে। প্রেসিডেন্ট ব্লেক-কে আমেরিকা দেশটার দক্ষিণ অংশ ফাঁকা করার নির্দেশ দিতে হয়। সবাই ছোটে মেক্সিকো অভিমুখে। বাঁচতে।
নামগুলো অচেনা ঠেকছে কি? ঘটনাক্রমও অপরিচিত? হ্যাঁ, এটা বাস্তবের বিবরণ নয়, গল্প। জলবায়ু বিপর্যয় নিয়ে রোল্যান্ড এমেরিচের ২০০৪-এর ছবি দ্য ডে আফটার টুমরো-র দু’দশক পূর্ণ হল এ বার। এটি সেই ছবির গল্পের অংশ। সিনেমাটি মুক্তি পাওয়ার প্রায় এক দশক পরে, ২০১৩-র শীতে, পোলার ভর্টেক্স-এর হাড়হিম করা ঠান্ডা বায়ুস্রোত ভেসে আসে উত্তর আমেরিকায়। আমেরিকা যখন তুষারঝড় আর টর্নেডো-বিধ্বস্ত, ঠান্ডায় জমে-যাওয়া লস অ্যাঞ্জেলেসে বসে ব্যঙ্গাত্মক টুইট করলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প, “পুরোমাত্রায় দুনিয়ার উষ্ণায়ন”। একে বললেন, “খুব ব্যয়বহুল প্রতারণা!” বরফ যুগ না-ই আসুক, দুনিয়া জুড়ে ট্রাম্প-যুগ আসবে তার ক’বছরের মধ্যেই। এমেরিচের চলচ্চিত্রে জলবায়ু নিয়ে আমেরিকান প্রশাসনের শীর্ষস্তরে যে বিশ্বাস করতে না চাওয়ার মনোভাব প্রতিবিম্বিত হয়েছে, তা যেন প্রবাহিত হতেই থাকে ওয়াশিংটন ডিসি-র ক্ষমতার অলিন্দে। এবং হয় তার এক নবতর রূপায়ণও।
হাল আমলে দুনিয়া বারংবার দেখছে বিধ্বংসী জলবায়ুর প্রকোপ। এ বছরই হয়েছে এশিয়ার তাপপ্রবাহ, ব্রাজ়িল ও কেনিয়ার মারাত্মক বন্যা, কানাডায় দাবানল, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি আর স্পেনের ভেসে-যাওয়া বৃষ্টি। গোটা দুনিয়াতেই জলবায়ুর বিপর্যয় রোধের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে সচেতনতা তাই বাড়ছে। বহু ঢাক-ঢোল পিটিয়ে রাষ্ট্রপুঞ্জের ২০১৫-র জলবায়ু সম্মেলন, ‘কনফারেন্স অব দ্য পার্টিজ়’-এর ২১তম সংস্করণ বা সিওপি২১-এ স্বাক্ষরিত হয় প্যারিস পরিবেশ চুক্তি, যার শরিক হয় ১৯৬টি দেশ। মূল লক্ষ্য, দুনিয়ার গড় তাপমাত্রাকে শিল্পযুগের আগেকার তুলনায় দেড় থেকে দু’ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি-র সীমারেখার মধ্যে নিয়ন্ত্রণ করা। এ জন্য প্রয়োজন গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমন কমানো, জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার হ্রাস করা। আসলে কয়লা বা খনিজ তেলের মতো অনেক যুগের মরা ধন, পৃথিবী যাকে কবর দিয়ে রেখেছে, তা বার করে অনেকটাই মেটানো হয় দুনিয়ার শক্তির প্রয়োজন। একে বর্জন করা সহজ নয়, নিশ্চয়ই। প্রয়োজন বিকল্প শক্তির। উপযুক্ত পরিকল্পনার। সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি— দুনিয়া জুড়ে এই সব অপ্রচলিত পরিচ্ছন্ন শক্তির জন্য প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো তৈরিতে প্রয়োজন বিপুল অর্থ। অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলিকে এই অর্থ জোগাতে হবে ধনী দেশগুলিকেই। কারণ, সে ক্ষমতা তাদেরই আছে। সেই সঙ্গে ঐতিহাসিক ভাবে, এবং এখনও গ্রিনহাউস গ্যাসের মাধ্যমে দুনিয়াকে বিষিয়ে দেওয়ার সিংহভাগ দায় তো তাদেরই। বাৎসরিক সিওপি সম্মেলনে তাই অর্থের জোগান নিয়ে দড়ি টানাটানি চলে ধনী-দরিদ্র দেশগুলির মধ্যে।
ট্রাম্প অবশ্য জলবায়ু বিপর্যয়কে ‘গুজব’ বা ‘গল্পকথা’ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন বহু বার। আসলে ডোনাল্ড ট্রাম্প তো এক দুঁদে ব্যবসায়ী। আর আমেরিকার সঞ্চিত জীবাশ্ম জ্বালানির পরিমাণ পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি। তা বার করে আনার মধ্য দিয়ে আমেরিকার অর্থনীতি সঞ্জীবিত হয়। সেই সঙ্গে তা সাঙাততন্ত্রের প্রকাশ তো বটেই। ২০১৭-তে প্রথম বার প্রেসিডেন্ট হয়েই ট্রাম্প আমেরিকাকে বার করে আনেন প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে। কারণ তাঁর মতে, এই চুক্তিতে আমেরিকার পুরো লোকসান। এর ফলে আমেরিকাকে ‘অহেতুক’ই প্রচুর ডলার জোগাতে হচ্ছে রাষ্ট্রপুঞ্জের ভান্ডারে। জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট হয়ে তাঁর কার্যকালের প্রথম দিনই আমেরিকাকে ফিরিয়ে আনেন প্যারিস চুক্তির চৌহদ্দিতে।
প্রেসিডেন্ট বাইডেনের আমলে আমেরিকায় পাশ হয় ঐতিহাসিক ‘ইনফ্লেশন রিডাকশন অ্যাক্ট’, যার ফলে অন্তত ৩৯০ বিলিয়ন ডলার ইতিমধ্যেই বিনিয়োগ করা হয়েছে বায়ুশক্তি, সৌরশক্তি, ইত্যাদি বিকল্প পরিচ্ছন্ন শক্তির উৎপাদনে। ২০২৪-এর আমেরিকার ভোটটা যেন তাই এক অর্থে ছিল শক্তি উৎপাদনের দুই সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী নীতির টক্করও। ভোটে জয়পরাজয় কোনও একটা বিচ্ছিন্ন বিষয়ে নির্ধারিত না হলেও, সংখ্যাগরিষ্ঠ আমেরিকার জনতা কিন্তু বেছে নিয়েছে ট্রাম্পের ‘ড্রিল বেবি, ড্রিল’ পলিসিকে। মাঝের চার বছর ঝিমিয়ে থাকার পর ট্রাম্প-যুগের হল পুনর্নির্মাণ।
নভেম্বরে দু’সপ্তাহ জুড়ে সিওপি২৯ সম্মেলন হয়ে গেল আজ়ারবাইজানের রাজধানী বাকু-তে। যুগপৎ বিতর্ক আর ভয়ের অনুরণনকে সঙ্গে করেই। আজ়ারবাইজানের মতো কর্তৃত্ববাদী পেট্রোস্টেট, আধুনিক তেল শিল্পের জন্মই যেখানে, সেখানে এই সম্মেলন হওয়াটাই একটা বিড়ম্বনার বিষয় বলে মনে করেছেন গ্রেটা থুনবার্গের মতো অনেকে। তার উপর আমেরিকায় জীবাশ্ম জ্বালানির উৎপাদন বাড়ানোর কর্মসূচি এবং বৈশ্বিক জলবায়ু চুক্তি থেকে আমেরিকাকে আবার বার করে আনার কথা বলে ডোনাল্ড ট্রাম্প হইহই করে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই অনুষ্ঠিত হয় সম্মেলনটি।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের পুনর্নির্বাচন সিওপি২৯ সম্মেলনকে গ্রহণের মতো আঁধারে ঢেকেছে, বলা বাহুল্য। বোঝাই যাচ্ছে, প্যারিস চুক্তি থেকে পৃথিবীর ধনীতম এবং দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনকারী দেশ আমেরিকার আবার সরে যাওয়াটা শুধুই সময়ের অপেক্ষা। স্বাভাবিক ভাবেই তাই বাকুতে বাইডেন প্রশাসনের প্রতিনিধি হয়ে ছিলেন গুরুত্বহীন। আবার ট্রাম্পের জয়ের প্রেক্ষাপটে সিওপি থেকে প্রতিনিধি প্রত্যাহার করে নিয়েছে ট্রাম্পপন্থী আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট জেভিয়ার মিলেই-এর সরকার। সেই সঙ্গে দরাদরির খেলায় দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলিকে বিকল্প শক্তির ব্যবস্থাপনায় প্রয়োজনীয় বাৎসরিক ১.৩ ট্রিলিয়ন ডলার জোগাতে ব্যর্থ হয়েছে এই সম্মেলন। পরিবর্তে ২০৩৫-এর মধ্যে বাৎসরিক ৩০০ বিলিয়ন ডলারের যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, তা একেবারেই ‘অপর্যাপ্ত’, এবং এ নিয়ে রেগে আগুন হয়েছে ভারত, ইন্দোনেশিয়া, নাইজিরিয়ার মতো বহু দেশ। এমনকি এই টাকাটাও এক ‘ভঙ্গুর ঐকমত্য’র ফসল বলে মনে করছেন অনেকেই; কারণ, ট্রাম্পের দ্বিতীয় পর্যায়ে আমেরিকা প্যারিস চুক্তি থেকে সরকারি ভাবে নাম প্রত্যাহার করলে এই অনুদানের ব্যবস্থা কী করে হবে, তা নিয়ে স্পষ্ট করে বলা হয়নি কিছুই।
আপাতত তাই পুরোটাই অস্পষ্ট, ধূসর, আবছায়ায় ঢাকা। হয়তো এই গ্রহের ভবিষ্যৎ নিয়ে জল্পনার মতোই। গত বছর বিশ্বব্যাপী গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন সর্বকালের নিরিখে পৌঁছেছে সর্বোচ্চ সীমায়। এ বছর বোধ হয় হতে চলেছে নথিভুক্ত সবচেয়ে উষ্ণতম বছর। জীবমণ্ডল এবং প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্রের অস্থিতিশীলতা ত্বরান্বিত করে উদ্ভিদ ও প্রাণী-জগতের ব্যাপক বিলুপ্তিকে। কিন্তু শুধুমাত্র ট্রাম্পকে দোষ দেওয়াটাও বোধকরি অন্যায্য হবে। একটা ছোট্ট উদাহরণ দেওয়া যাক। বাকু-তে তো সিওপি সম্মেলন হল। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন কিন্তু আজ়ারবাইজান থেকে জীবাশ্ম জ্বালানি কেনা চালু রেখেছে, এমনকি ২০২৭-এর মধ্যে সেখান থেকে জীবাশ্ম গ্যাস আমদানির পরিমাণ দ্বিগুণ করার পরিকল্পনাও করেছে।
দ্য ডে আফটার টুমরো-তে সুপারস্টর্ম-এর দাপটের সময় জ্যাক হল যখন আমেরিকান প্রেসিডেন্টকে পরামর্শ দেন আমেরিকার দক্ষিণ ভাগ খালি করার জন্য, প্রেসিডেন্ট ব্লেক জিজ্ঞাসা করেন, কী হবে উত্তরের জনগণের। উত্তরে জ্যাক হল বলেন, তাদের জন্য দেরি হয়ে গিয়েছে। বাইরে বেরোলেই তারা মারা পড়বে ঝড়ে। তাদের জন্য বিশেষ কিছু করার নেই, প্রার্থনা করা ছাড়া।
তবু আপাতত কালকের দিনটা অনেকখানিই ডোনাল্ড ট্রাম্পের নিয়ন্ত্রণাধীন। পরিণতিতে কী হবে দুনিয়ার জলবায়ুর? পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের একটা ভোট কি সম্পূর্ণ ধ্বংস করতে পারে জলবায়ুর সুস্থিতিকে, সে সংক্রান্ত একটা দীর্ঘকালীন প্রচেষ্টাকে? মনে রাখতে হবে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের একটা টার্ম কাটিয়েও কিন্তু টিকে গিয়েছিল প্যারিস চুক্তি এবং সে সংক্রান্ত বৈশ্বিক প্রচেষ্টা আর উদ্বেগ। আশা করা যাক, ট্রাম্প-উত্তর কালকের পরের দিনও দুনিয়ার জনগণের জন্য কিছু একটা করার অবকাশ থাকবে।
রাশিবিজ্ঞান বিভাগ, ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট, কলকাতা