গত বছর পশ্চিমবঙ্গে রামনবমী তার আগের বছরের থেকে বেশি বড় ছিল। সে বছর তার আগের বছরের চেয়ে। এ বছর সবচেয়ে বেশি। কেউ অবশ্য প্রশ্ন করবে না, এ বার সবচেয়ে বেশি কেন? উত্তরটা সবার জানা। আগ্রাসী রামধ্বজাধারীরাও খোলা মনে বলে দেবেন— সামনে ভোট, তাই বেশি বড় রামনবমী!
ধর্মীয় উৎসবকে ঘিরে রাজনীতি করা নিয়ে রামসেবকদের রাখঢাক নেই, বরং এ তাঁদের ঘোষিত অবস্থান। রাজ্য জুড়ে রামনবমীর পোস্টারে শ্রীরামচন্দ্রের পাশেই নরেন্দ্র মোদী, মোদীর পাশেই শুভেন্দু অধিকারী। সঙ্গে অযোধ্যার সেই মহা রামমন্দির তো আছেই। ১৮০০ কোটি টাকা ব্যয়ে, আসমুদ্রহিমাচল ঢাকঢোল শঙ্খকাঁসরে মথিত করে, চোখ-ধাঁধানো তারকাসমাবেশে যে মন্দিরের প্রতিষ্ঠা, তাতে বাঙালির ঘরে ঘরে ভক্তির হিস্টিরিয়া দেখা গিয়েছিল। এমন ‘ইনভেস্টমেন্ট’ থেকে ভোটে একটা ‘ডিভিডেন্ড’ তুলতে হবে না?
কেন্দ্রে এগারো বছরের বিজেপি শাসনের পর এ প্রশ্ন অবান্তর যে, ধর্মোৎসবের মধ্যে রাজনীতি ঢোকানো কেন? এত দিনে প্রতিষ্ঠিত যে সংখ্যাগুরু সর্বার্থেই ‘গুরু’। তারা ইচ্ছে করলেই ধর্মকে রাজনীতির বাহন করতে পারে। যারা সংখ্যালঘু, তারা একই কাজ করলে, অর্থাৎ ধর্মীয় উৎসব পালনের নামে রাজনীতির অ্যাজেন্ডা নিয়ে এগোলে অবশ্যই তা মহাপাতকের কাজ। হিন্দুরাষ্ট্র প্রায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছে, ফলে এমন কিছু ঘটলে তাকে রাষ্ট্রদ্রোহও বলা যেতে পারে।
সব ছেড়ে হঠাৎ রাম কেন, এ প্রশ্নও পুরনো হল। শোনা হয়ে গিয়েছে দুই মেরুর দুই মত। এক মত হল, রাম বঙ্গসমাজে কস্মিন্কালেও বাঙালির দেবতা ছিলেন না। ইতিহাস বা ধর্মতত্ত্ব ঘেঁটে দেখানো হয়, শাক্ত ও বৈষ্ণব চর্চার বঙ্গভুবনে রাম-পুজো তত ঠাঁই পায়নি বাংলায়। উল্টো দিকের মতবাদীরা বলেন, সব ঝুটা হ্যায়, চিরকালই রাম বাঙালির পুজো পেয়েছেন। আর যদি সেই পুজোয় কেউ ব্যাঘাত ঘটিয়ে থাকেন, তবে তাঁরা কে, তা নিয়েও খোঁজখবর দরকার। এই দুই দলের পক্ষেই যুক্তি সাজানো যেতে পারে, তবে কিনা, আমার মত হল— তর্কটা সম্পূর্ণ অবান্তর। রাম কেন, রাম কেন নন, এ নিয়ে সময় নষ্ট করার অর্থ নেই, কেননা রাম এখানে ‘উপ-লক্ষ্য’ মাত্র, ‘লক্ষ্য’ নন। দুর্গা, সরস্বতী, কালীর পাশে রামকে আনা না হলে অন্য কাউকে আনা হত। মূল ন্যারেটিভটা থাকত একই।
এগুলোর কোনওটাই তা হলে প্রশ্ন নয়। কিংবা এগুলো সবই প্রশ্ন, কিন্তু উত্তরগুলো বড্ড বেশি জানা। ভাবার মতো প্রশ্ন বরং এটাই যে, ওই ‘মূল ন্যারেটিভ’ বলতে আমরা এখন ঠিক কী বুঝি?
দু’টি তথ্য এই প্রসঙ্গে মাথায় রাখা জরুরি। প্রথম তথ্য, পশ্চিমবঙ্গে রামনবমী উদ্যাপনটি বিজেপির রাজনৈতিক উত্থানের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। সময়কাল পর পর মেলে ধরলেই তা বোঝা সম্ভব। দু’-এক বছর মিটিমিটি জ্বলার পর ২০১৭ সালে আরএসএস, হিন্দু জাগরণ মঞ্চ ও বিজেপির যৌথ উদ্যোগে মেগা-স্কেলে পশ্চিমবঙ্গে রাম-মশাল মহোজ্জ্বল হয়ে ওঠে। ২০১৬ থেকেই কোমরবাঁধা শুরু হয়েছিল, সঙ্ঘ পরিবারের নেতৃত্বে বজরং দল, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও হিন্দু জাগরণ মঞ্চ ভার নিয়েছিল। কর্মযজ্ঞ কী ভাবে এগিয়ে গেল— বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন স্নিগ্ধেন্দু ভট্টাচার্য তাঁর মিশন বেঙ্গল: আ স্যাফরন এক্সপেরিমেন্ট বইতে। ২০১৭ সালের এপ্রিলে দিলীপ ঘোষরা বলে দিলেন— এ বার রামনবমীর দিন একটা ‘শো’ দেখা যাবে। সত্যিই, মাথায় গৈরিক ফেট্টি বাঁধা ভক্তবাহিনীর ধুন্ধুমার সে বার বিস্মিত করে দিল রাজ্যবাসীকে। সঙ্গে রইল মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে রামনবমী পালনে বাধাদানের অভিযোগ, এবং অবশ্যই, সংখ্যালঘু-তোষণের অভিযোগ। সময়ের হিসেব পরিষ্কার বলে দেয়, আরএসএস হিন্দুত্বের কার্যক্রম যদিও এ বঙ্গে বহু পুরনো, উপরের গোষ্ঠীগুলিও নতুন নয়, কিন্তু এই বাংলায় তাদের আগেকার কার্যক্রমে রামপুজো বা রামমন্দির কোনওটিই তত দিন গুরুতর ছিল না— যত দিন এই রাজ্যে বিজেপির ভাগ্যাকাশে সূর্যোদয় হয়নি। বিজেপির দিল্লি দখল (২০১৪), পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচনে বিরোধী হিসেবে বিজেপির সম্মানবৃদ্ধি (২০১৬ সালে বিধানসভা নির্বাচনে ১০ শতাংশ ভোট, যা ২০১১-র থেকে ৫ শতাংশ বেশি), এবং জাতীয় নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির বিরাট শক্তিবৃদ্ধি (২০১৯ সালে তাকলাগানো ৪০ শতাংশ ভোট)— এর সঙ্গে কাঁটায় কাঁটায় মিলিয়ে দেওয়া যায় রামনবমী উদ্যাপনের অস্ত্র ঝনঝনানির ডেসিবেল-এর ঊর্ধ্বমুখী গ্রাফকে। ২০১৭, ২০১৮, ২০১৯ এবং তার পর ২০২৩, ২০২৪, এই বছরগুলিতে দেখা গেল অস্ত্রধারী রামভক্তদের ভয়ঙ্কর তাণ্ডব, সংখ্যালঘু-বাসাঞ্চলে দাঙ্গা পরিস্থিতি। অর্থাৎ আগেকার নীরব, প্রচ্ছন্ন, কিন্তু নিরবচ্ছিন্ন, বিদ্বেষপ্রসারী হিন্দুত্ববাদের জায়গা যখন থেকে নিয়ে নিল প্রকাশ্য, সক্রিয়, বিজেপি-ক্ষমতায়িত, মরিয়া হিন্দুত্ববাদ, সংখ্যালঘুকে সরাসরি আক্রমণে আগ্রহী ও উদ্যত হিন্দুত্ববাদ— তখন থেকেই পশ্চিমবঙ্গের ‘উৎসব’ তালিকায় জ্বলজ্বল করে উঠল রামনবমী।
পরিস্থিতি যা দাঁড়াল, তাতে ২০২৪-এ এ রাজ্যে ‘সরকারি ছুটি’ও পেয়ে গেল রামনবমী। এই সিদ্ধান্ত একটা বিরাট ভুল— নিশ্চয় জেনেবুঝেই ‘ভুল’। বাংলায় অনেক হিন্দু পুজো বা ইসলামি পরবে ছুটি দেওয়া হয় না, সেই যুক্তিতেই স্থিত থাকা যেত। উল্টে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সিদ্ধান্তে রামমন্দির রাজনীতি আরও অক্সিজেন পেল।
এ বছর অবশ্য অতিরিক্ত অক্সিজেন। বাংলাদেশের পরিবর্তনশীল পরিস্থিতিতে সীমান্তের ওপার থেকে সমানেই ভেসে আসছে সংখ্যালঘু নির্যাতন বিষয়ক তথ্য কিংবা গুজব। এ পারে বাঙালি হিন্দু উত্তেজিত, আবেগতাড়িত। এই সময়ে খাপখোলা তরোয়াল নিয়ে সংখ্যালঘু পাড়াগুলো দিয়ে শোভাযাত্রা করলে ভোট বাড়বে না অনেকটাই? রামনবমীর রাম— বিজেপি নেতাদের কথানুযায়ী— ‘অশুভ’ বা ‘অসুর’ (পড়তে পারি, ‘মুসলমান’) দমন করেন, ‘ধর্ম’ স্থাপনের জন্যই নাকি অস্ত্র ধরেন!
এ বার আসি দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ তথ্যে। রামনবমী-তে যে সব স্লোগান শোনা যায়, খেয়াল করে দেখব, তার অধিকাংশই হিন্দি। ‘জয় শ্রী রাম’, ‘রাম কহো’, ‘রামলালা কি জয়’ ইত্যাদির সঙ্গে দিলীপ ঘোষের ‘রাম-জাদা বনাম হারাম-জাদা’ স্লোগানেও বাংলা অমিল। উত্তেজনা শাণাতে হিন্দি হুঙ্কার। গেরুয়া রামপতাকায় দেবনাগরী। কেউ নিশ্চয় বলবেন না, আহা তাতে কী, সংস্কৃতেও তো দেবনাগরী! বাঙালির সংস্কৃত-প্রীতি শুনি না, শূন্যই বলা যায়। উল্টো দিকে, বাঙালির হিন্দিপ্রীতি নিয়ে বলতে গেলে কবিতার আশ্রয় নিতে ইচ্ছে করে: ‘বঁধু কি আর বলিব আমি। মরণে জীবনে জনমে জনমে প্রাণনাথ হৈও তুমি’!
কেবল শব্দ নয়, ছবিও অনেক কথা বলে। হাতে শনশনে তরবারি কিংবা উঁচানো তিরধনুক নিয়ে রাম— এই ছবি কি বাঙালির কাছে পরিচিত? কবে থেকে এ ছবি দেখছেন তাঁরা, কী বলেন রামভক্তরা? এই শতকের আগে পশ্চিমবঙ্গে এই ছবি দেখা যেত কি? বাংলায় রাম-ঐতিহ্য যতটুকুই থাকুক, সেই রামের হাতে কিন্তু কোনও অস্ত্র থাকত না। বাল্মীকি থেকে কৃত্তিবাস, সকলের রামের পাশেই থাকতেন সীতা, লক্ষ্মণ। নেহাত ঘরোয়া মেজাজের, কোমলমতি, শান্ত, প্রজাপালক রাজা রামকেই চিনত বাংলা। আর এই যুদ্ধবাজ রামকে তৈরি করেছে উত্তর ভারত, আরও স্পষ্ট করে বললে, উত্তরপ্রদেশ। অর্থাৎ বিজেপি আগ্রাসনে বাংলা ক্রমশই উত্তরপ্রদেশের সাংস্কৃতিক উপনিবেশে পরিণত হচ্ছে— এই বিরাট রাম-ন্যারেটিভ তার বাহন।
মনে রাখা ভাল, কেবল রাম-সংস্কৃতি বাংলার অচেনা ছিল এত কাল, এইটুকুই সবটা নয়। বাংলার দুর্গা-সরস্বতী-কালীর এই সংস্কৃতি ছিল গোবলয়ের অচেনা, এখনও তারা পুরোটা বুঝে উঠতে পারে না। আর সেটাই আসল কথা। হিন্দু ধর্মই যেমন হিন্দুত্ববাদ নয়, হিন্দুত্ববাদও তেমন একটিমাত্র ধারা নয়। গোবলয়ের হিন্দুত্ববাদ এখন মহাবিক্রমে বাংলার হিন্দু ধর্ম এবং হিন্দুত্ববাদকে গ্রাস করছে। আর সেই আগমার্কা হিন্দুত্ব অর্জনের অভিলাষী বাঙালি তাতে মহা খুশি। এ হল বাঙালি সংস্কৃতির বিরুদ্ধে উত্তর ভারতীয় সংস্কৃতির জয়। আরও স্পষ্টত, বাঙালি হিন্দুধর্মের বিরুদ্ধে উত্তর ভারতীয় হিন্দুধর্মের জয়। এটাই হল সেই বড় ‘ন্যারেটিভ’। এই কারণেই পশ্চিমবঙ্গের অবাঙালি-অধ্যুষিত অঞ্চলে রামনবমীর বাড়বাড়ন্ত। আর, অবাঙালি হতে আকুল বাঙালি অঞ্চলে, কিংবা মুসলিমবিদ্বেষী লড়াইখ্যাপা বাঙালির কাছে এর আকর্ষণ দুর্দমনীয়। না, রামনবমী উন্মাদনা শুধু ধর্মের বিষয় নয়— বাঙালি সংস্কৃতির, বাঙালি সত্তার সঙ্কটের ন্যারেটিভ।
শেষ অবধি হাতে তা হলে একটিই প্রশ্ন। বাঙালি নিজেরাই তবে অবাঙালি হতে ছুটবে, এক বিশেষ ধরনের অবাঙালি হতে? ‘ঈশ্বর আল্লা তেরা নাম, সবকো সন্মতি দে ভগবান’-এর বদলে ‘মন্দির ওহি বনায়েঙ্গে’র রামভক্তিকেই বেছে নেবে?
উত্তর দিক বাঙালিই।