সুন্দর পিচাই রয়েছেন গুগল-এর শীর্ষ পদে, সত্য নাদেলা ‘মাইক্রোসফট’-এর, এ বার পরাগ আগরওয়াল ‘টুইটার’-এর সিইও হলেন। ভারতের লক্ষ লক্ষ বাবা-মা স্বপ্ন দেখছেন, তাঁদের সন্তানও এক দিন তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের সেরা স্থান দখল করবে। কিন্তু তাঁরাই যখন দেখেন যে, ছেলেমেয়ে মোবাইলে বা কম্পিউটারে ভিডিয়ো গেম খেলছে, তখনই রেগে ওঠেন। গেম খেলা মানে নাকি কেবল সময় নষ্ট। অথচ তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করেই তৈরি হয় ভিডিয়ো গেম, এবং গেম তৈরি আজ একটা শিল্প, যাতে বিশ্বের কয়েক লক্ষ মানুষ কাজ করছেন— এটা ভারতীয়রা খেয়ালই করেন না। গত বছর অতিমারি সত্ত্বেও এই শিল্পের ব্যবসার পরিমাণ ছিল ১৬,২০০ কোটি ডলার। প্রতি বছর নতুন গেম বানানো হয় হাজারেরও বেশি। কেবল প্রোগ্রামিং-এ দক্ষতাই নয়, ভিডিয়ো গেম বানানোর জন্য লাগে গল্প লেখক, যিনি একটা ‘প্লট’ করবেন; থ্রি-ডি আর্টিস্ট, যিনি দৃশ্যগুলিকে জীবন্ত করে তুলবেন; সঙ্গীত প্রযোজক, পরিচালক— সিনেমা তৈরিতে যা যা প্রয়োজন তার সবই। একটি ভিডিয়ো গেম তৈরি করতে কয়েক হাজার কর্মীও দরকার হতে পারে, কয়েক বছর ধরে পরিশ্রম করতে হয়। আর ভাল গেম-এর চাহিদা সব সময়েই রয়েছে।
বিশেষত বাঙালিদের মধ্যে ভিডিয়ো গেম-এর প্রতি তাচ্ছিল্যের ভাবটা একটু অবাক করে, কারণ গল্পের প্রতি বাঙালির ভালবাসা চিরকালের। গল্প শুনতে, পড়তে, দেখতে বা বানাতে বাঙালির জুড়ি নেই। আগে মুখেমুখে গল্প বানানো হত পাড়ার আড্ডায়, এখন হচ্ছে সমাজমাধ্যমে। ভিডিয়ো গেম-এ কিন্তু সেটাই করা হয়। কিছু চরিত্র কিছু সম্ভাবনার সামনে দাঁড়ায়, তার পর খেলুড়ের নির্বাচন অনুযায়ী এক এক দিকে গল্প যায়। হ্যারি পটার, ন্যান্সি ড্রু, শার্লক হোমস-এর মতো চরিত্রদের নিয়ে গেম তৈরি হয়েছে, অথচ ব্যোমকেশ, ফেলুদা বা দস্যু মোহন এখনও আসেনি। বিশ্বসাহিত্যের অনেক বিখ্যাত গল্পও রয়েছে এই জগতে। যেমন, অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড, চার্লি অ্যান্ড দ্য চকলেট ফ্যাক্টরি, সোফি’জ় ওয়ার্ল্ড, দ্য গডফাদার।
আজও ভারত ও বাংলার বহু মানুষ মনে করেন যে, ভিডিয়ো গেম শুধুমাত্র একটি বিনোদন, তা থেকে জ্ঞান লাভ অসম্ভব। কিন্তু এ ধারণা ভুল। আজ অনেক দেশের স্কুলে ভিডিয়ো গেম খেলা শেখানো হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, ভিডিয়ো গেম খেলা মস্তিষ্কের জন্যে উপকারী। তা পড়ুয়াদের দলবদ্ধ হয়ে কার্যোদ্ধার করতে শেখায়। বাড়ায় বোধশক্তি (কগনিটিভ এবিলিটি)। কিছু গেম এমন ভাবে তৈরি হয় যাতে কৌশল (স্ট্র্যাটেজি) স্থির করার ক্ষমতা তৈরি হয়। কল্পনাশক্তি, ভাবপ্রকাশের ক্ষমতা বাড়াতে পারে ভিডিয়ো গেম। দেশ-বিদেশের রীতিনীতি সম্পর্কেও জানা হয়ে যায়।
এখন তৈরি হচ্ছে ভার্চুয়াল রিয়ালিটি গেমস, যাতে ঘরে বসে আসল ম্যাপ ব্যবহার করে ভার্চুয়াল জগতে গাড়ি চালিয়ে বিশ্বের যে কোনও শহর থেকে অন্য শহরে যাওয়া যায়, প্লেন ওড়ানো যায়। সেই অভিজ্ঞতা কতটা বাস্তবের কাছাকাছি, তা হয়তো অনেকে কল্পনাও করতে পারেন না। আছে ‘অগমেন্টেড রিয়ালিটি’ গেম, যেখানে ফোনের ক্যামেরার সাহায্যে আসল দুনিয়ার সঙ্গে গেমের দুনিয়ার সংযোগ ঘটানো সম্ভব। উদাহরণ, ‘পোকেমন গো’— যেখানে বাড়ির পিছনের ঝোপ কিংবা পাড়ার বাসস্ট্যান্ডে খুঁজে পাওয়া যেতে পারে চরিত্রদের।
এ ধরনের খেলাগুলোতে বাস্তব দুনিয়ার সঙ্গে খেলার দুনিয়ার দূরত্ব মিলিয়ে যেতে চায় বলে অনেকের মনে ভিডিয়ো গেম সম্পর্কে একটা ভয় আছে। অনেকে গেম খেলে প্রচুর টাকা হারিয়েছেন, কিংবা আত্মহত্যা করেছেন, এমন খবর বেরোয় মাঝেমাঝে। অনেকে মনে করেন, কিছু ভিডিয়ো গেম বেশ হিংসাত্মক, খেললে খুন-জখম বেড়ে যাবে। কিংবা, গেম খেললেই খেলার নেশা ধরে যাবে। স্মরণ করিয়ে দেওয়া যাক, এ ধরনের আপত্তি এক সময়ে গল্পের বই, হিন্দি সিনেমা, টিভি সিরিয়াল সম্পর্কেও করা হত। কিছু লোক সব সময়েই কল্পনার জগতের সঙ্গে বাস্তবের জগতের তফাত ভুলে গিয়ে সুপারম্যানের মতো উড়তে চান। কল্পনার জগৎকে ভালবেসে বাস্তবকে প্রায় ভুলে যেতে চান। তাঁদের অবশ্যই সতর্ক করতে হবে। কোথা থেকে গেম ডাউনলোড করা নিরাপদ, তা-ও শিখতে হবে। কিন্তু ভিডিয়ো গেম যে অপূর্ব সম্ভাবনাময় দুনিয়াকে সামনে নিয়ে এসেছে, তা থেকে বাংলার মানুষ মুখ ঘুরিয়ে থাকবে কি না, সেটা ভেবে দেখা উচিত।
তবে এর একটা অর্থনৈতিক দিকও আছে। বহুজাতিক সংস্থার যন্ত্রগুলির দাম প্রায় একটি ভাল কম্পিউটারের সমান। একটি ভাল গেমের দাম কয়েক হাজার টাকা। আবার, ভিডিয়ো গেম তৈরির প্রশিক্ষণের জন্য উপযুক্ত তাঁরাই, যাঁরা ‘গেম ডেভলপমেন্ট কোর্স’ করেছেন। প্রচলন না থাকায় অনেকের কাছেই এই পাঠ্যক্রম অপরিচিত। এই কর্মদক্ষতায় ভারত, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ, অনেক পিছিয়ে। পরিচয় কম বলে বিনিয়োগ হচ্ছে কম। অথচ, কম্পিউটার সায়েন্স ব্যবহার করে রোজগার, হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ ও বিনোদনের সুযোগ বিশ্ব জুড়ে এগিয়েই চলেছে।