Teachers - Social Media

শিক্ষক বনাম সমাজমাধ্যম

অবশ্যই রয়েছে যৌনতার পাঠও। যে ধরনের মুদ্রা, শব্দ ‘অশালীন’ বলেই গণ্য হবে যে কোনও সমাজে, অবাধে তা গ্রহণ করছে অপরিণত মন।

Advertisement
শৈবাল বসু
শেষ আপডেট: ১৯ অক্টোবর ২০২৪ ০৮:৩৭

Sourced by the ABP

মফস‌্সলের একটি কো-এড স্কুলে সহপাঠী মেয়েদের উদ্দেশে হাতের আঙুলে যৌন ইশারা করেছে ক্লাস সিক্সের এক বালক। একটু একান্তে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা গেল, সে ওই ভঙ্গিটি শিখেছে একটি ইউটিউব ভিডিয়ো দেখে। বালকের বাবা নেই, মা একটি বেসরকারি সংস্থায় নিরাপত্তা রক্ষীর কাজ করেন। ডিউটি সেরে আসা পরিশ্রান্ত, একাকী মা সংসারের কাজগুলো করতে করতে নিজের মুঠোফোন ছেলের হাতেই দিয়ে রাখেন। হয়তো বা সন্তানকে সময় না দিতে পারার গ্লানিটুকু আড়াল করেন এই বিনোদনের সহজ খেলনাটি তার হাতে দিয়ে। আর সেই বালক, এই প্রজন্মের অজস্র স্কুলপড়ুয়া শিশু-কিশোরের মতো, নিজের ভিতরে গ্রহণ করতে থাকে সমাজমাধ্যমের পাঠক্রম। স্কুলের ক্লাসঘরের বাইরে এ এক সমান্তরাল পাঠক্রম, যার আকর্ষণী শক্তি অনেক বেশি। আমাদের স্কুলশিক্ষার কাঠামোটি ঔপনিবেশিক যুগের ‘কেরানি গড়ার কারখানা’ হিসেবে আজও চালু রয়েছে। সেখানে অন্যের আরোপ করা পাঠই শিক্ষা, ছাত্রের আগ্রহের জায়গা সামান্যই। শিক্ষার সেই ধারণাকে প্রতি মুহূর্তে আঘাত করছে, এবং প্রায় নস্যাৎ করছে, সমাজমাধ্যমের ভিডিয়োগুলি, যার প্রধান উদ্দেশ্য আগ্রহের উদ্দীপন, সরসতা, বিনোদন। সে সব থেকে শিশুরা শিখতে থাকে নিত্যনতুন পাঠ।

Advertisement

তার মধ্যে অবশ্যই রয়েছে যৌনতার পাঠও। যে ধরনের মুদ্রা, শব্দ ‘অশালীন’ বলেই গণ্য হবে যে কোনও সমাজে, অবাধে তা গ্রহণ করছে অপরিণত মন। কিন্তু স্কুলের ভূমিকা এ ক্ষেত্রে কী? ছেলেটিকে বেয়াদবির জন্য তিরস্কার করাই কি যথেষ্ট? না কি সুস্থ যৌনতার পাঠ, সব লিঙ্গ ও যৌনতার মানুষের প্রতি সম্মানের অভ্যাস গড়ে তোলার ব্যবস্থাও করার কথা স্কুলের? কদর্য ইঙ্গিত শেখানো ভিডিয়োর আড়ালে থাকা প্রবল পিতৃতান্ত্রিক সমাজমন কিন্তু উপস্থিত আমাদের স্কুল প্রাঙ্গণেও। যেখানে নিত্য ‘পুরুষ’ আর ‘নারী’ গঠনের পাঠ দেওয়া হয়। বালকদের প্রতি “তুই ছেলে হয়ে কাঁদছিস কেন?” প্রশ্ন, বা বালিকাদের প্রতি নির্দেশ, ‘পিরিয়ড’ না বলে ‘শরীর খারাপ’ বলা উচিত— এ ধরনের কথা আজও বিরল নয় শিক্ষকদের মুখে। “বাবাকে দেখা করতে বলবি”— এই আদেশটির মধ্যেও এই কথাটি লুকিয়ে থাকে যে মা নয়, পুরুষ মানুষটিই সন্তানের প্রকৃত অভিভাবক, পরিবারের বিধাতাপুরুষ। পার্থক্য গড়ে দেওয়া হয় কাজের ধরনেও। গ্রাম মফস‌্সলের কো-এড স্কুলে সরস্বতী পুজোয় মেয়েরা পুজোর বাসন মাজবে কলতলায়, আর ছেলেরা পয়সা নিয়ে বাজারে যাবে, এই রীতি আজও বহাল।

শুধু ক্লাসরুম দেখলে হবে না, দেখতে হবে স্টাফরুমও। রাজনীতির আলোচনা চলতে চলতে পুরুষ শিক্ষকরা স্বচ্ছন্দে বলেন, “পুলিশ কি চুড়ি পরে বসেছিল?” ভার্চুয়াল বিনিময়ে চলতে থাকে অজস্র নারীবিরোধী, প্রান্তিক যৌনতা-বিরোধী বয়ানের চটুল উদ্‌যাপন। আমাদের ব্যবস্থায় শিক্ষকের চাকরির শর্তে বই পড়ার কোনও বাধ্যতা নেই। বহু স্কুলে সে পরিবেশও নেই। অনেক স্কুলে গ্রন্থাগার নেই, থাকলেও তার ব্যবহার নেই। স্কুল লাইব্রেরি কেবল ছাত্রছাত্রীদের জন্য, এমনই ভাবা হয়। অথচ, বই পড়েই হোক বা অন্য ভাবে, রাষ্ট্র ও সমাজে ন্যায়-নৈতিকতা নিয়ে কী বিতর্ক চলছে, কোন আচরণ বাতিল হচ্ছে, কোনটি গৃহীত হচ্ছে, তার স্পর্শে থাকা চাই শিক্ষকদের। না হলে নতুন ভারতের উপযুক্ত নাগরিক তৈরি হবে কী করে?

ভুলে গেলে চলবে না, আমাদের শিক্ষকেরা এসেছেন এই সমাজের আঙিনা থেকেই, যেখানে পিতৃতন্ত্রের নানা বয়ান সহজে উচ্চারিত হয়। শিক্ষকদের প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া, এমনকি শিক্ষক হিসাবে বিশেষ প্রশিক্ষণের পরিসরেও কখনও আসে না লিঙ্গ রাজনীতির কোনও পাঠ। তাঁরাও প্রাতিষ্ঠানিক পরিসর থেকে শিখে আসতে পারেননি— কোন ধরনের কথাবার্তা সামাজিক ক্ষমতার ভারসাম্যের নিরিখে দুর্বলের প্রতি অন্যায় (পলিটিক্যালি ইনকারেক্ট), আর কোনটি ন্যায়সম্মত। পাঠ্যক্রম প্রণেতারাও কি তা মনে রাখেন? উচ্চ মাধ্যমিকে ইংরেজির সিলেবাসে ঠাঁই পেয়েছে সরোজিনী নায়ডুর ‘দ্য ব্যাঙ্গল সেলার্স’ কবিতা, যেখানে রঙিন কাচের চুড়ি হয়ে ওঠে বাড়ির সুখী কন্যাটির এবং বরসোহাগী গৃহিণীর উজ্জ্বল অলঙ্কার।

সামাজিক ভাবে ধর্ষণবিরোধী জনমানস তৈরি করতে বিদ্যালয় স্তরের সিলেবাসে আনা দরকার লিঙ্গ সাম্যের পাঠ। তার সঙ্গে রাখতে হবে লিঙ্গপরিচয় ও প্রান্তিক যৌনতার সসম্মান উল্লেখ। পুরুষালি, মেয়েলি ইত্যাদি পিতৃতান্ত্রিক নির্মাণগুলি নিয়েও নতুন আখ্যান পৌঁছে দিতে হবে নতুন প্রজন্মের পড়ুয়ার কাছে। পূর্বতন বামফ্রন্ট সরকার ‘জীবনশৈলী’ নাম দিয়ে একটি বিষয় চালু করেছিল, কিন্তু সমবেত শ্রদ্ধার অভাবে সেই বিষয়টি সিলেবাস থেকে সরে যায়। সেই সময় যৌনশিক্ষা নিয়ে অনেক শিক্ষক-শিক্ষিকা আপত্তি করেছিলেন।

আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে শিক্ষকদের ন্যায়-অন্যায়ের বোধের অভিমুখ কী, এবং কী হওয়া দরকার, তা নিয়ে নিরন্তর অনলাইন আলোচনা সভা, শিবির ভাবা দরকার। আয়োজক হতে পারে শিক্ষা দফতর। সেখানে সমাজবিদ, মনোবিদ এবং অবশ্যই মানবীবিদ্যার বিশেষজ্ঞদের নিতে হবে প্রশিক্ষক হিসাবে। আর তৈরি হোক স্কুলগুলির জন্য একটি আধুনিক, মান্য আচরণবিধি। পড়ুয়াদের জন্যও, শিক্ষকদের জন্যও। সেই আচরণবিধি রচিত হোক সব মানুষের সংবেদনকে শ্রদ্ধা করে, পুরাতন আধিপত্যের ভাষাকে সরিয়ে রেখে। কারও মনের মধ্যে যেন একটি ধর্ষক তৈরি না হয়ে ওঠে, সেই লড়াইতে প্রথমেই এগিয়ে আসতে হবে আমাদের, শিক্ষকদের।

আরও পড়ুন
Advertisement