Earth Summit

কথার পাহাড় তৈরি হয়, বিশ্ব পরিবেশ সম্মেলনগুলিতে কাজের কাজ হয় কতটা

বিশ্ব পরিবেশ সম্মেলনের টেবিলে গালভরা প্রতিশ্রুতি রেখে এলেও ধনী দেশগুলি তা পালন করে না। দূষণের যাবতীয় দায় ঘাড়ে নিয়ে ধুঁকতে থাকে গরিব দেশগুলি।

Advertisement
টি এন নাইনান
টি এন নাইনান
শেষ আপডেট: ১২ নভেম্বর ২০২২ ১১:০১
সম্মেলনগুলি দূষণের বিরুদ্ধে কোনও কাজেই লাগেনি এমন নয়। কিন্তু কতটুকু?

সম্মেলনগুলি দূষণের বিরুদ্ধে কোনও কাজেই লাগেনি এমন নয়। কিন্তু কতটুকু? গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

বিশ্ব পরিবেশ সম্মেলনগুলিতে কী হতে চলেছে, তার অনুমান সাধারণত আগে থেকেই পাওয়া যায়। এমন সব কথাবার্তা এই সম্মেলনগুলিতে হয়ে থাকে, যা থেকে মনে হতে পারে যে, মহাপ্রলয়ের কাল আসন্ন। মনে হতে পারে যে, সভ্যতার যাবতীয় আলাপ-আলোচনা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, এখন কেবল বাকি রয়েছে শেষ মুহূর্তের কিছু কথোপকথন। এবং এর পরেই যা ঘটার তা ঘটে যাবে।

সম্মেলনের শেষে এই সব কথার পাহাড় ঠেলে ক্লান্ত অংশগ্রহণকারীরা ফেরার পথ ধরেন। এ সবের ফলে কী হয় জানা যায় না। সম্মেলনের টেবিলে উত্থাপিত আলাপ-আলোচনার বাস্তব প্রতিফলন খুব কমই দেখা যায়। যদি এই সব সম্মেলনে গৃহিত কর্মসূচি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শেষ করার চাপ না থাকত, তা হলে আরও কম কর্মকাণ্ড নজরে পড়ত। এই সব কারণেই গত অর্ধশতকে (১৯৭২ সালে স্টকহোমে প্রথম পরিবেশ সংক্রান্ত সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল) বেশির ভাগ মানুষ পরিবেশ সংক্রান্ত কর্মসূচির ব্যাপারে হতাশায় ভুগতে থাকেন।

Advertisement

তা সত্ত্বেও এ কথা ভাবা ভুল হবে যে, পরিবেশ সংক্রান্ত সম্মেলনগুলি থেকে কোনও লাভই হয়নি। খুব ধীর গতিতে হলেও বেশ কিছু কাজ সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু এ-ও মনে রাখা দরকার যে, এই গতিহীনতার মূল্য বিশ্বকে, বিশেষ করে গরিব মানুষকে চোকাতে হয়েছে। প্রতি বছর শীতের আগে দিল্লি ও তার পারিপার্শ্বিক এলাকা যে ভাবে এক বৃহৎ গ্যাস চেম্বারে পরিণত হয়, তার সঙ্গে বিশ্ব পরিবেশ সংক্রান্ত দুর্ভাবনার একটা সাযুজ্য রয়েছে। সেটি এই যে, দশকের পর দশক ধরে বিপর্যয় সম্পর্কে সাবধানবাণী শুনিয়ে আসা হচ্ছে, সমস্যা দূর করতে কিছু পদক্ষেপও করা হয়েছে, কিন্তু আজও পরিস্থিতি ‘ন যযৌ ন তস্থৌ’ অবস্থাতেই রয়ে গিয়েছে।

বিশ্বের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে বিশদে আলোচনা করার জন্য ১৯৬৮ সালে বুদ্ধিজীবী এবং ব্যবসায়ীদের সংগঠন ‘ক্লাব অফ রোম’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ১৯৭২ সালে এই প্রতিষ্ঠান থেকে ‘লিমিটস অফ গ্রোথ’ নামে একটি বই প্রকাশিত হয়। বিপুল পরিমাণে বিক্রি হওয়া সত্ত্বেও বইটির কেন্দ্রীয় বক্তব্য নিয়ে অনেকেই সে সময় হাসাহাসি করেছিলেন। এই বইয়ে দূষণ ও প্রাকৃতিক সম্পদের অবক্ষয়ের প্রতি বিশেষ দৃষ্টিপাত করা হয়েছিল। সেই বছরই স্টকহোমে পরিবেশ সংক্রান্ত সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সেই সম্মেলনকে বহু বিশেষজ্ঞই (বিশেষ করে ইউরোপের বিশেষজ্ঞরা) তখন খুবই তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছিলেন। সম্মেলনে প্রায় শতাধিক রাষ্ট্র অংশ নিয়েছিল, কিন্তু মাত্র দু’টি রাষ্ট্রের প্রধানকে সেখানে দেখা গিয়েছিল। যাঁদের মধ্যে এক জন ছিলেন আয়োজক দেশের রাষ্ট্রপ্রধান। অন্য জন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। কিন্তু ইন্দিরার তরফে এক মারাত্মক ভুল হয়েছিল। সম্মেলনে তিনি বলে বসেছিলেন, দারিদ্রই নাকি দূষণের সব থেকে বড় উৎস।

যেটুকুই হয়ে থাক, যা-ই হয়ে থাক, স্টকহোমের এই সম্মেলন ছিল এক পথপ্রদর্শনকারী ঘটনা। এই সম্মেলনের কুড়ি বছর পূর্তি উপলক্ষে ১৯৯২ সালে ব্রাজিলের রিও ডি জেনেইরোতে আয়োজিত হয় ‘আর্থ সামিট’। এই সম্মেলনেই প্রথম জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত বিষয়ে অনুসরণযোগ্য কর্মপন্থার পরিকাঠামো নির্ণয় করা হয়। আরও কিছু সম্মেলন পেরিয়ে ১৯৯৭-এর ‘কিয়োটো প্রটোকল’ পরিণতি পায়, যা এগিয়ে থাকা অর্থনীতির প্রায় তিন ডজন দেশকে ১৯৯০ সালের হিসাবের নিরিখে তাদের কার্বন নির্গমনের মাত্রা কমাতে বলে।

এই সম্মেলনের ৮ বছর পর, ২০০৫ সালে নির্দিষ্ট সময় অন্তর কার্বন নির্গমনের লক্ষ্যমাত্রা স্থির করা হয়। এই লক্ষ্যমাত্রা পুরণ হয়নি। লক্ষ্য পূরণের জন্য ভিত্তির বছরটিকে নতুন করে নির্ধারিত করতে আরও বেশ কিছু সম্মেলন (কোপেনহেগেনে ২০০৯ সালে, প্যারিসে ২০১৫ সালে ইত্যাদি) অনুষ্ঠিত হয়। ইদানীং লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে নীতি নির্ধারণের বিষয়টি বাতিলের খাতায় চলে গিয়েছে। তবে এ কথা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, দূষণের জন্য দায়ী প্রধানতম দেশগুলিই সর্বাগ্রে এই সব বিধিনিষেধ প্রণয়ন করেছিল। তাদের অনেকেই আজ এই বিষয়টি নিয়ে হাসাহাসি করে।

তা হলে প্রশ্ন এখানেই যে, আমরা ঠিক কোথায় দাঁড়িয়ে রয়েছি? পৃথিবী বিপর্যয়ের পথে ৮০ শতাংশ পথ এগিয়ে গিয়েছে, প্রাক-শিল্প পরিস্থিতির তুলনায় বিশ্বের তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে সতর্কতার সীমারেখা পার করেও কার্বন নির্গমন অব্যাহত থাকবে এবং প্রাক-শিল্প পরিস্থিতির তুলনায় বিশ্বের তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পাবে বলেই মনে হয়। বায়ুমণ্ডলে কার্বনের সার্বিক পরিমাণ দুই-তৃতীয়াংশ বাড়ানোর দিকে পৃথিবী এগিয়ে চলেছে। জলবায়ুর পরিবর্তন অনিবার্য হয়ে পড়েছে। আর এর মূল্য চোকাতে হচ্ছে বা হবে লক্ষ-কোটি মানুষকে, যাঁদের বেশির ভাগই গরিব। পৃথিবীর অনেক জায়গাই অচিরে বাসযোগ্যতা হারাবে। বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর অবলুপ্তি বাড়তে থাকবে। বিভিন্ন দেশের সরকার টের পাবে যে, এই সব পরিবেশগত, অর্থনৈতিক এবং মানবিক সমস্যাগুলির মোকাবিলা করার মতো অর্থ বা সম্পদ তাদের হাতে নেই। সব মিলিয়ে বিপর্যয় ঘনীভূত হয়ে উঠবে।

সুখবর বলতে এইটুকুই যে, বহু শিল্পায়িত এবং ধনী অর্থনীতির দেশ তাদের কার্বন নির্গমণের মাত্রা কমাতে সচেষ্ট হয়েছে। ভারত-সহ অনেকেই তাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের পিছনে খরচ হওয়া শক্তির পরিমাণ কমাতে পেরেছে এবং ব্যবহৃত শক্তিকে দূষণহীন ভাবে উৎপাদনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ‘নেট জ়িরো এমিশন’ বা বায়ুদূষণের পরিমাণকে শূন্যের কাছাকাছি নিয়ে যাওয়ার অবস্থানে পৌঁছতে এখনও বেশ কয়েক দশক সময় লাগবে। কিন্তু, দেরি করে হলেও এই ‘নেট জ়িরো’-কে লক্ষ্য হিসেবে স্থির করার বিষয়টি যে অবশ্যই এক যুগান্তর, তা স্বীকার করতেই হবে।

তা হলে গত অর্ধ শতকের অভিজ্ঞতা আমাদের কী শিক্ষা দিল? এর উত্তরে প্রথমেই যা মনে আসে, সেটি হল— মিশরের শার্ম এল-শেখে এই মুহূর্তে আয়োজিত পরিবেশ সম্মেলনের মতো সমাবেশে আলোচনা-পর্যালোচনা মাঝে মাঝে বিবেকের দংশনকে জাগিয়ে তুলবে। অবশ্য সচেতনতার প্রহর অনেক আগেই শেষ হয়ে গিয়েছে। কখনও কখনও বিবেকের দংশন সময়ের কাঁটাকে খানিক পিছু হাঁটাবে। বিশেষ করে উইক্রেন যুদ্ধের মতো সময়ে জ্বালানি হিসেবে কয়লার বিরোধিতা করে আসা দেশগুলিকে আবার তাদের তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলি পুনরায় সক্রিয় করে তোলার পরামর্শ দেওয়া হবে। সেই সঙ্গে বার বার প্রতিশ্রুতি প্রদান করা সত্ত্বেও কোনও ধনী দেশ জলবায়ুগত পরিবর্তনের ব্যাপারে দরিদ্র দেশগুলিকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থের জোগান দেবে না। এবং এ কথা মনে রাখা হবে না যে, দূষণের জন্য দরিদ্র দেশগুলি আদৌ দায়ী নয়।

সর্বোপরি, খুব কম মানুষই কার্বন-ঘটিত দূষণ রহিত জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত হতে রাজি (খাদ্যাভ্যাসের বিষয়টিকে মনে রেখেই বলছি)। এ সব না ঘটলে প্রযুক্তির প্রয়োগে হয়তো সমস্যার খানিক সমাধান হবে, কিন্তু সম্পূর্ণ বিষয়টির নিষ্পত্তি হবে না।

পরিশেষে, ‘বৃদ্ধি’র ধ্বংসাত্মক দিকটিকে তত ক্ষণ ঠেকিয়ে রাখা যাবে না, যত ক্ষণ না জাতীয় তহবিলগুলি প্রাকৃতিক সম্পদের উপরে ঘটে যাওয়া ধ্বংসলীলাকে তার হিসাবের মধ্যে নতুন করে স্থান দিচ্ছে। ২০১৩ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যলয়ের অর্থনীতিবিদ পার্থ দাশগুপ্তের নেতৃত্বাধীন একটি কমিটি বিষয়টির পুনর্মূল্যায়ন এবং সংযোজনের বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছিল। কিন্তু, তাঁদের রিপোর্ট পরিবেশ মন্ত্রকের অগণিত ফাইলের নীচে সম্ভবত চাপা পড়ে থাকতে থাকতে বিস্মৃতির অতলে চলে গিয়েছে।

আরও পড়ুন
Advertisement