পদার্থবিদ্যা ও রসায়নের নোবেল পেল কৃত্রিম মেধার গবেষণা
Nobel Prize 2024

স্নায়ুর পথ, কাগজের পাখি

কম্পিউটেশনাল ফিজ়িক্স বা কেমিস্ট্রির মতো ফলিত বিজ্ঞানের শাখায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ অনেকটা গালিলেয়োর হাতে অত্যাধুনিক টেলিস্কোপ তুলে দেওয়ার মতো। গালিলেয়ো তাঁর সময়ে এমন একটা যন্ত্র পেলে মহাবিশ্বের কত রহস্য আরও আগেই উন্মোচিত হত!

Advertisement
স্বাগতম দাস
শেষ আপডেট: ২০ অক্টোবর ২০২৪ ০৬:২৬
শিরোপা: এ বছর পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার ঘোষণার সাংবাদিক সম্মেলন। স্টকহোম, ৮ অক্টোবর ২০২৪।

শিরোপা: এ বছর পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার ঘোষণার সাংবাদিক সম্মেলন। স্টকহোম, ৮ অক্টোবর ২০২৪। ছবি: রয়টার্স।

এ বছর জোড়া নোবেল পেল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা— পদার্থবিদ্যা এবং রসায়নে। মানবমস্তিষ্কের কার্যপ্রণালীর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে, প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির জন হপফিল্ড এবং ইউনিভার্সিটি অব টরন্টো-র জেফ্রি এভারেস্ট হিন্টন এমন কৃত্রিম নিউরাল নেটওয়ার্ক তৈরি করেন, যা মানুষের মস্তিষ্কের মতোই স্মৃতি সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধার করে এবং সরবরাহকৃত তথ্যভান্ডার বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নিতে শেখে। চ্যাটজিপিটি বা স্টেবল ডিফিউশনের মতো আজকের আধুনিক জেনারেটিভ এআই-এর তুলনায় অনেক সহজ এই নেটওয়ার্কগুলোই তৈরি করেছিল যন্ত্রমেধার যাবতীয় পরবর্তী গবেষণার ভিত্তি। সেই অবদানের জন্য এই দুই বিজ্ঞানী পেলেন পদার্থবিদ্যার নোবেল পুরস্কারটি।

Advertisement

রসায়নে পুরস্কারটি দেওয়া হয়েছে গুগল ডিপমাইন্ড ও আইসোমরফিক ল্যাবসের সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং সিইও স্যর ডেমিস হাসাবিস এবং গুগল ডিপমাইন্ড-এর ডিরেক্টর জন জাম্পারকে। তাঁরা আলফা-ফোল্ড নামে একটি যুগান্তকারী কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর ব্যবস্থা তৈরি করেছেন, যা অ্যামিনো অ্যাসিডের সিকোয়েন্স থেকে প্রোটিনের ত্রিমাত্রিক গঠনের পূর্বাভাস দিতে পারে। এঁদের সঙ্গেই পুরস্কৃত হয়েছেন ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটন, সিয়াটল-এর ডেভিড বেকার, কম্পিউটেশনাল প্রোটিন ডিজ়াইনে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য, যা গত কয়েক বছরে এআই-এর ব্যবহারে সমৃদ্ধ হয়েছে অনেক গুণ।

আমাদের মস্তিষ্ক ও স্নায়ুতন্ত্রের গঠনগত একক হল নিউরন বা স্নায়ুকোষ। এই কোষগুলো তথ্য পাঠায় এবং গ্রহণ করে। মনে করতে পারেন, একটি নিউরন হল এমন এক ব্যক্তি, যার হাতে রয়েছে একটি ওয়াকিটকি। সে ওই ওয়াকিটকির মাধ্যমে বার্তা গ্রহণ করতে পারে, বার্তাটিকে পরিবর্তন করতে পারে, এবং তার পর অন্য কাউকে সেই বার্তা পাঠাতে পারে। আমাদের মস্তিষ্কে কোটি কোটি নিউরন জটিল ভাবে সংযুক্ত থাকে, যা একে অপরের সঙ্গে মিলে বানিয়ে ফেলে একটি নেটওয়ার্ক। এই নিউরাল নেটওয়ার্কগুলোই আমাদের মস্তিষ্ককে বিভিন্ন কাজ করতে সাহায্য করে, যেমন কারও মুখ চিনতে পারা, একটি নাম মনে রাখা, বা কোনও গাণিতিক সমস্যা সমাধান করা।

যখন আপনি একটি কুকুর দেখেন, আপনার মস্তিষ্কে সক্রিয় হয়ে ওঠে বিভিন্ন নিউরন— এদের মধ্যে কিছু নিউরন কুকুরের আকৃতি চেনায়, অন্য কিছু নিউরন আপনাকে মনে করিয়ে দেয় যে, কুকুরটি পরিচিত এবং বন্ধুসুলভ। আবার আর এক দল নিউরন সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে যে, কুকুরটিকে আদর করবেন কি না। এই সব নিউরন এক সঙ্গে কাজ করে একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করে, যা আপনাকে সাহায্য করে কুকুরটি চিনতে, মনে রাখতে এবং প্রতিক্রিয়া দিতে। যে কোনও কাজই আপনি যত বেশি শিখবেন বা অনুশীলন করবেন, এই নেটওয়ার্কগুলো ততই শক্তিশালী হবে এবং আপনাকে সেই কাজে করে তুলবে আরও দক্ষ। কম্পিউটারকে দিয়ে মানুষের মতো পারিপার্শ্বিক তথ্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়াতে গেলে দরকার এই আসল স্নায়ুজালের একটি গণনাগত মডেল— কৃত্রিম নিউরাল নেটওয়ার্ক। এইখানেই অতুলনীয় হয়ে রয়েছে হপফিল্ড ও হিন্টনের অবদান।

আমাদের মাথাকে ভাবা যেতে পারে একটি বিশাল লকার রুম, যার প্রতিটি লকারে থরে থরে সাজানো থাকে স্মৃতি, ধারণা, বা তথ্য। এই লকারগুলো (অর্থাৎ মস্তিষ্কের নিউরনগুলো) পরস্পরের সঙ্গে পথ দিয়ে সংযুক্ত। যখন আমাদের কিছু মনে করতে হয়, তখন মস্তিষ্ক বৈদ্যুতিক সকেটের মাধ্যমে এই পথ ধরে হাঁটে এবং সঠিক লকারটি খোলে। কিন্তু, যদি পথগুলো খুব জটিল বা এলোমেলো হয়ে পড়ে, সঠিক লকার খুঁজে পাওয়াও হয়ে যায় খুব শক্ত। আমরা হয়তো ভুলে যাই কোন লকারে কোন স্মৃতি আছে। হপফিল্ড ১৯৮২ সালে কৃত্রিম নিউরাল নেটওয়ার্কগুলোর জন্য এই সমস্যার একটি সহজ, গাণিতিক সমাধান প্রস্তাব করেন, যা আজ ‘হপফিল্ড নেটওয়ার্ক’ নামে পরিচিত। হপফিল্ডের নেটওয়ার্কে নিউরনগুলোর সংযোগের পথগুলো এমন ভাবে সাজানো থাকে, যাতে যদি কিছু পথ একটু এলোমেলো হয়েও যায়, তবুও মস্তিষ্ক সঠিক লকারটি খুঁজে পেতে পারে, অর্থাৎ স্মৃতিটি মনে রাখতে পারে। এই নেটওয়ার্কে সব লকার একটি স্তরে পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত থাকে।

হপফিল্ড-এর কাজের উপর ভিত্তি করে ১৯৮০-র দশকেই হিন্টন কৃত্রিম নিউরাল নেটওয়ার্কের পরিসরটি করে তোলেন আরও অনেক বিস্তৃত। স্কুলের কোনও ক্লাসে যদি মাস্টারমশাই শুধু একতরফা পড়িয়েই যান, তবে তিনি যতই গুরুত্বপূর্ণ কথা বলুন না কেন, লেখাপড়া বিষয়টা এক সময় একঘেয়ে, ক্লান্তিকর হয়ে ওঠে। শিক্ষাবিজ্ঞান বলছে, ছেলেমেয়েরা যদি নিজেদের মধ্যেও অধীত বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনা করতে পারে, তারা আরও গভীর ভাবে শিখতে পারবে এবং আরও জটিল সমস্যার সমাধান করতে সক্ষম হবে। নিউরনের ক্ষেত্রেও তেমনই। হিন্টন কৃত্রিম নিউরাল নেটওয়ার্কে শুরুর ইনপুট এবং শেষের আউটপুট স্তরগুলোর মাঝখানে জুড়ে দেন আরও এক বা একাধিক এমন স্তর, যা সরাসরি তথ্য গ্রহণ বা প্রদান না করলেও, মাঝখানে থেকে তথ্যকে পরিমার্জনা ও বিশ্লেষণ করতে সাহায্য করে। ঠিক যেমন শ্রেণিকক্ষের শিক্ষার্থীরা নিজেরা আলোচনা করে কিছু জিনিস আরও ভাল ভাবে বোঝার চেষ্টা করে, তেমনই নিউরাল নেটওয়ার্কেও এই ‘হিডন ইউনিট’ নেটওয়ার্ককে আরও জটিল কাজগুলো ভাল ভাবে করতে সাহায্য করে। ধরুন, আপনি একটি কুকুরের ছবি চিনতে চান। সাধারণ ভাবে, আপনার মস্তিষ্ক সরাসরি কান, লেজ, চার পায়ের মতো চেহারার বৈশিষ্ট্যগুলো নিয়ে চিন্তা করবে। কিন্তু, হিন্টনের তৈরি করা এই ‘হিডন ইউনিট’-বিশিষ্ট নেটওয়ার্কের মাধ্যমে, একটি কম্পিউটার কুকুরটি কেমন আচরণ করে, তার সাধারণ আকার বা অন্যান্য জটিল বৈশিষ্ট্যগুলোও শিখতে পারে। এই কারণে, এমন বৈশিষ্ট্য যা সরাসরি দেখা বা সহজে বোঝা যায় না, সেগুলোও আজকের দিনের শক্তিশালী কৃত্রিম নিউরাল নেটওয়ার্ক জটিল গাণিতিক প্রক্রিয়ায় অনুধাবন করতে পারে।

এ বার ফিরি রসায়নে। ধরুন, আপনাকে একটি কাগজ ভাঁজ করে করে একটি জটিল পাখির আদল (অরিগামি ক্রেন) বানাতে বলা হয়েছে, কিন্তু কী ভাবে ভাঁজ করতে হবে তা বলা হয়নি। কাগজটি ভাঁজ করার অসংখ্য উপায় আছে, কিন্তু একটি নির্দিষ্ট উপায়ে ভাঁজ করে গেলেই শেষে তৈরি হবে একটি সুন্দর পাখি। যদি মাঝের কিছু ভাঁজে ভুল হয়, তা হলে শেষে পাবেন একটা হিজিবিজি আকৃতি। আমাদের দেহের অন্যতম পৌষ্টিক উপাদান প্রোটিনও ওই কাগজের মতো। আমাদের কোষের রাইবোজ়োম প্রোটিন তৈরি করে অ্যামিনো অ্যাসিডের একটি লম্বা, রৈখিক শৃঙ্খল হিসাবে। তার পর কাগজ ভাঁজ করার মতোই, স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে প্রোটিন একটি জটিল ত্রিমাত্রিক আকারে ভাঁজ হতে শুরু করে। এক-একটি প্রোটিনের শারীরবৃত্তীয় কাজ (যেমন শরীরের খাবার হজম করা বা রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করা) পুরোপুরি নির্ভর করে তার ভাঁজ হওয়ার উপরে। ভুল ভাবে ভাঁজ হওয়া প্রোটিন ঠিক ভাবে কাজ নাও করতে পারে; সৃষ্টি করতে পারে অ্যালঝাইমার’স বা সিস্টিক ফাইব্রোসিসের মতো রোগ।

কম্পিউটেশনাল কেমিস্ট্রিতে মূল লক্ষ্য হল কোনও প্রোটিন কী ভাবে ভাঁজ হবে তার সঠিক পূর্বাভাস দেওয়া। যদি একটি প্রোটিন শৃঙ্খলে ১০০টি অ্যামিনো অ্যাসিড থাকে, তা হলে সম্ভাব্য ভাঁজের মোট সংখ্যা দাঁড়ায় গোটা ব্রহ্মাণ্ডে যত পরমাণু আছে তারও অনেক গুণ বেশি। সুতরাং, এই সুবিশাল খড়ের গাদায় সঠিক ভাঁজের সুচটি খুঁজে বার করা কতটা কঠিন, অনুমান করা যায়। এ যেন কাগজটি ক্রমান্বয়ে ভাঁজ করার আগেই অনুমান করার চেষ্টা— চূড়ান্ত পর্যায়ে তৈরি অরিগামি পাখিটা দেখতে কেমন হবে। এ বছর রসায়নের নোবেলটি এসেছে এই সমস্যার সমাধানের জন্যই। হাসাবিস ও জাম্পার-এর নেতৃত্বে ডিপ মাইন্ডের বিজ্ঞানীরা তৈরি করেছেন ‘আলফা-ফোল্ড’— যার মূলে রয়েছে সেই সুবিশাল একটি কৃত্রিম নিউরাল নেটওয়ার্ক। আলফা-ফোল্ড বিশাল পরিমাণ তথ্যের সমুদ্র মন্থন করে অনুমান করতে পারে, কী ভাবে কোনও প্রোটিন সঠিক ভাবে ভাঁজ হবে। এর ফলে প্রোটিনের জটিল গঠন দ্রুত এবং নির্ভুল ভাবে বার করা সম্ভব, যা দ্রুততর করে তোলে ওষুধ আবিষ্কার, রোগ নির্ণয়, এবং জৈবরসায়নের সামগ্রিক গবেষণা।

কম্পিউটেশনাল ফিজ়িক্স বা কেমিস্ট্রির মতো ফলিত বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ অনেকটা যেন গালিলেয়োর হাতে একটা অত্যাধুনিক টেলিস্কোপ তুলে দেওয়ার মতো। ভাবতে শিহরন হয় যে, গালিলেয়ো গালিলেইয়ের মতো মহাবিজ্ঞানী তাঁর সময়ে হাতে এই রকম একটা যন্ত্র পেলে মহাবিশ্বের কত রহস্য আরও কত আগেই উন্মোচিত হত! ২০২৪ সালের নোবেল পুরস্কার তেমনই এক অনন্ত সম্ভাবনার স্বীকৃতি।

ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট, কলকাতা

আরও পড়ুন
Advertisement