কেবল আবেগ যথেষ্ট নয়
International Mother Language Day

ভাষাকে বাঁচাতে ও সমৃদ্ধ করতে আত্মপ্রত্যয় ও উদ্যোগ জরুরি

বাংলা ভাষার মর্যাদা লাভের কারণ প্রাক্-আধুনিক ও আধুনিক পর্বে এক রকম নয়।

Advertisement
বিশ্বজিৎ রায়
শেষ আপডেট: ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ০৪:৫৫

বা‌ংলা ভাষার বয়স খুব বেশি নয়। বাংলা গদ্যের বিবিধ-বিস্তারের পরিসরটি গড়ে ওঠে আরও পরে। ক্রমে তা সাহিত্যের বাহন এবং জ্ঞানচর্চার উপকরণ হয়ে উঠতে পারে। ভাষীর সংখ্যার বিচারে ও এই ভাষাবাহিত সাহিত্য ও জ্ঞানবিজ্ঞানমূলক রচনার নিরিখে বাংলার এক আন্তর্জাতিক পরিচিতি পেতে অসুবিধে হয়নি।

বাংলা ভাষার মর্যাদা লাভের কারণ প্রাক্-আধুনিক ও আধুনিক পর্বে এক রকম নয়। যখন ছাপাখানা আসেনি, সমুদ্র ডিঙিয়ে আসা সাহেব বণিকরা এ দেশে দৃঢ় ভাবে উপনিবেশ স্থাপন করেনি, তখনও বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল মূলত দু’টি কারণে। প্রথমত, রাজপৃষ্ঠপোষণা লাভ করেছিল এই ভাষা। আরাকান রাজসভা থেকে কৃষ্ণচন্দ্রের সভা, ‘এলিট’দের কাছে ভাষা হিসাবে বাংলা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। সংস্কৃত ভাষাকে কেন্দ্র করে যেমন রাজসভার সাহিত্য গড়ে উঠেছিল, বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করেও নানা মাপের রাজসভার সাহিত্যের পত্তন। দ্বিতীয়ত, এই স্থানীয় ভাষাকেন্দ্রিক উচ্চমর্যাদা সম্পন্ন গোষ্ঠীটি যেমন বাংলা ভাষার মর্যাদা বৃদ্ধি করেছিল, তেমনই প্রাক্-আধুনিক পর্বের ধর্মীয় ও লোকায়ত স্তরেও ভাষাটির প্রয়োগ ছিল যথেষ্ট। এই ভাষা সহজ-ধর্মের পদাবলির ধারক, পল্লিগাথা ও গীতির প্রকাশক। সহজ-ধর্মের লোকেরা উচ্চ-মর্যাদাবাহী পাঠ্যের সঙ্গে তর্ক করতে দ্বিধা করতেন না, কৃষ্ণদাস কবিরাজের বাংলা গ্রন্থ চৈতন্যচরিতামৃত যে ভাবে চৈতন্যদেবের জীবন, কার্য ও অস্তিত্বকে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছিল, তা সংস্কৃত ভাষাবাহিত দর্শন ভাবনার সঙ্গে পরম্পরিত। চৈতন্যদেবের জীবন-কার্য-অস্তিত্বকে সহজবৈষ্ণবেরা বাংলায় ব্যাখ্যা করতে চান। নিজেদের ভাষা ও প্রকাশ সম্বন্ধে তাঁদের মধ্যে বিন্দুমাত্র ঊনতার বোধ ছিল না।

Advertisement

সাহেবদের বাণিজ্য ও প্রশাসনিকতা অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ থেকে ক্রমে ঔপনিবেশিক ব্যবস্থাপনাকে সুদৃঢ় করে। বাংলা ছাপাখানার পত্তন হল, বাংলা গদ্য নানা শাখায় বিস্তার লাভ করল। ঔপনিবেশিক ব্যবস্থায় উনিশ শতকে বাঙালি ভদ্রলোক শ্রেণির ক্রম-উত্থান। বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করে এই ভদ্রলোকদের নানা প্রকল্প: রামমোহন, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র, হেমচন্দ্র, নবীনচন্দ্র, রঙ্গলাল, মধুসূদন, দীনবন্ধু, রমেশচন্দ্র, ত্রৈলোক্যনাথ, উনিশ শতকে বাংলা ভাষার প্রধান লেখকরা সবাই ইংরেজিশিক্ষিত, নতুন প্রশাসনিক ব্যবস্থায় কোনও না কোনও ভাবে কর্মরত উচ্চপদস্থ। এঁরা বাংলা ভাষার জন্য ভাবছেন, লিখছেন, শুধু সাহিত্য সৃষ্টি করছেন না, বাংলা ভাষাকে ভাবের পাশাপাশি জ্ঞানের ভাষাও করে তুলছেন। রামমোহন বিদ্যাসাগরের সমাজসংস্কার-কর্মের যুক্তি বাংলা ভাষায় প্রকাশিত। বঙ্কিমচন্দ্রের বঙ্গদর্শন বাংলা ভাষাকে নানা বিষয়ের জ্ঞান প্রকাশের উপযুক্ত করে তুলতে চেয়েছে। ভারতীয় রাজনীতিতে গান্ধীর প্রবেশের আগেই রবীন্দ্রনাথ কংগ্রেসের প্রাদেশিক সম্মিলনের ভাষা যাতে বাংলা হয়, সে বিষয়ে সরব। উনিশ শতকের শেষ দশকে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের কার্যক্রমের সূত্রপাত। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে ভাষা ও বিষয় হিসাবে যথাক্রমে বাংলা ও বাংলা সাহিত্যকে জায়গা দেওয়ার দাবি উঠল। উনিশ শতকের প্রথমার্ধে কলকাতা ও কলকাতার বাইরে ভদ্রলোকের হাতে গড়ে ওঠা নতুন সাহিত্যধারা ছাড়া জনপ্রিয় সাহিত্যধারার যে রূপ জীবিত ছিল সেই যাত্রা, কবিগান, সঙের গান, বটতলার সামাজিক কেচ্ছা, রসিকতা ইংরেজি-শিক্ষিত বাঙালি এলিটদের কাছে মান্যতা পায়নি। ধারাটি শুকিয়েও যায়নি। বাঙালি এলিটরা সাধারণের রুচির নবায়ন ঘটাতে চেয়েছিলেন। তাঁদের ভদ্রলোকের সাহিত্যধারার পরিসরে টেনে আনতে চেয়েছিলেন। খানিক সফলও হয়েছিলেন। ভদ্রলোকদের ভূমিকা ও বাংলা ভাষাভিত্তিক জাতীয়তার বোধ এই ভাষাকে যে প্রতিষ্ঠা উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ক্রমশ প্রদান করে তা বিশ শতকে সম্প্রসারিত হয়। বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে যে রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও শিক্ষাবিষয়ক আয়োজন তাতে বাংলা ভাষায় নতুন জোয়ার এল।

ফাঁক একটা থেকে গিয়েছিল। সে ফাঁক উনিশ শতকে বাঙালি মুসলমানদের বাংলা ভাষার আঙিনায় সাদরে গ্রহণ না করার মধ্যেই নিহিত ছিল। মীর মশাররফ হোসেন বঙ্কিমচন্দ্রের সমকালীন। তাঁর উপন্যাস রত্নবতী প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৬৯ সালে, বঙ্কিমের দুর্গেশনন্দিনী প্রকাশের বছর চারেক পরেই। মীরের বাংলা গদ্য খুবই আকর্ষণীয়। অথচ বিষাদসিন্ধুর লেখক মীরের বাংলা কিন্তু হিন্দু ভদ্রলোকদের আদর পায়নি। সুকুমার সেন বিশ শতকে বঙ্গশ্রী পত্রিকায় বাংলা সাহিত্যের গদ্যের ধারাবাহিক ইতিহাস লেখেন। পরে সজনীকান্ত রঞ্জন প্রকাশনালয় থেকে সুকুমার সেনের বাংলা সাহিত্যে গদ্য বই হিসাবে প্রকাশ করেন। শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে উৎসর্গীকৃত এই বইটিতে উনিশ শতকের নানা সামর্থ্যের হিন্দু বাঙালি লেখকদের কথা আছে, কিন্তু মীরের উল্লেখ নেই। মীরের আত্মজীবনীমূলক রচনা ‘বিবি কুলসুম’-এ মীর লিখেছিলেন, “কুলসুম বিবি... আমার সঙ্গে কথা কহিয়াছেন বিশুদ্ধ বাঙ্গালা ভাষায়... মুসলমানি কথাও কথার মধ্যে আছে ঈশ্বরের নামও আছে। আমার পরণ পরিচ্ছদ কোট পেণ্টুলন, মাথায় কাল রঙ্গের ইরাণী টুপি। মহা গোলে পড়িয়া আমাদের উভয়ের কথা বিশেষ মনোযোগের সহিত শুনিতে লাগিলেন...।” মীর আর তাঁর স্ত্রী বিবি কুলসুমের কথা স্টেশনে মনোযোগ দিয়ে যে হিন্দুরা শুনছিলেন তাঁরা আসলে বাঙালি মুসলমান ভদ্রলোকদের এই আধুনিক বাংলা ভাষাকেন্দ্রিক আত্মনির্মাণের বিষয়টিকে সামাজিক ভাবে গ্রহণ করেননি। ফলে বিশ শতকে ইংরেজদের দুই বাঙালির প্রকল্প প্রবল হয়ে গেল। ন্যাশনালিস্ট মুসলমান ও উদার হিন্দুদের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হল। দেশভাগের পর পূর্ব-পাকিস্তানের শিক্ষিত ভদ্রলোক বাঙালি মুসলমানেরা ভাষাকেন্দ্রিক আত্মপরিচয়কে নতুন ভাবে প্রতিষ্ঠিত করেন। মনে রাখতে হবে সেখানকার ভাষা আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ— শিক্ষিত ভদ্রলোক বাঙালি মুসলমানেরা ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। সেই আত্মপরিচয়ই রাজনৈতিক মুক্তির পথে এগোয়।

এর অর্থ এই নয় যে, ভাষা কেবল ভদ্রলোক এলিটদের ব্যবহারের উপরেই নির্ভরশীল। তবে অস্বীকার করার উপায় নেই, আধুনিক পৃথিবীতে শিক্ষিত ভদ্রলোকেরা তাঁদের স্বভাষাকে জ্ঞানতন্ত্রের, চিন্তার, রাজনীতির ভাষা হিসাবে ব্যবহার করলে সে ভাষার মর্যাদাবৃদ্ধি ও প্রতিষ্ঠা প্রাপ্তি হয়। কেবল লোকায়তের প্রয়োগে ভাষার সিদ্ধি ঘটে না। আর এ কথাও সত্য উপনিবেশের প্যাঁচ-পয়জারে, আধুনিকতা ও ভুবনায়নের দাপটে বাংলা ভাষার লোকায়ত পরিসরটি তার বলিষ্ঠতাই শুধু হারায়নি, প্রত্যয়হীন একটেরে হয়ে পড়েছে। লোকায়তের পুনর্জীবন উপর থেকে হয় না, তা ভিতর থেকে তলা থেকে স্বতঃস্ফূর্ত সংহতি লাভ করে। সে জন্যই রবীন্দ্রনাথ লোকসাহিত্য সংগ্রহ করতেন, বাউলের সুরে কান পাততেন, কিন্তু লোকসাহিত্য রচনার ব্যর্থ চেষ্টা করতেন না।

দুই বাংলাতেই বাংলাভাষাকে এই মুহূর্তে যদি মর্যাদা ও প্রতিষ্ঠায় স্থিতি দান করতে হয়, তা হলে শিক্ষিত ভদ্রলোকের চিন্তা-চেতনায়, রাজনীতিতে, জ্ঞানকাণ্ডে, কর্মে বাংলা ভাষাকে প্রতিষ্ঠা দিতে হবে। এ-বাংলায় আজ থেকে বছর ত্রিশ-চল্লিশ আগেও যে ভাবে শিক্ষিত বাঙালি বাংলা ভাষাকে জ্ঞানচর্চায় প্রয়োগ করতেন এখন কি তা করেন? কেউ যে করেন না তা নয়। এমনকি বিশ্বের জ্ঞান-দরবারে সুপ্রতিষ্ঠ প্রাজ্ঞ বাঙালির অনেকেই এখন বাংলা লেখায় ‘ফিরছেন’। তবু তা যথেষ্ট নয়।

বাস্তবিক, লাভের খাতিরেই বাঙালি শিক্ষিত ভদ্রলোকেরা বাংলা ভাষাকেন্দ্রিক জ্ঞানচর্চায় প্রবেশ করতে পারেন। পাশ্চাত্যকেন্দ্রিক জ্ঞানচর্চার পদ্ধতি নিয়ে কথা অনেক দিন থেকেই উঠছে। নিজের ভাষা-সংস্কৃতির সঙ্গে সুগভীর পরিচয়সম্পন্ন বাঙালি চিন্তকদের কাছ থেকে তাঁদের ভাবনার কথা শোনার আগ্রহ এখন অনেক। তাই মুখের ভাষার সংস্কৃতি শুধু জানলেই হবে না, সেই ভাষার গভীরে যাওয়া জরুরি। বিভিন্ন বিদ্যাবিষয়ের বাঙালি গবেষকরা যদি তা মনে রাখেন, ইংরেজির পাশাপাশি স্বভাষাতেও তাঁরা মনোযোগী হবেন। ভাষাকে প্রযুক্তির উপযোগী করে তুলবেন। কাজ অনেক। ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ চাই, কেবল আবেগই যথেষ্ট নয়।

বাংলা বিভাগ, বিশ্বভারতী

আরও পড়ুন
Advertisement