রাজ্যপাল এখন তুরুপের তাস, দিল্লির কৌশলে
Governors

রাজ্যের ‘পালক’, না কি...

অবশ্যই রাজ্যপালদের রাজনৈতিক স্বার্থে কাজে লাগাতে ইন্দিরা গান্ধী ছিলেন সিদ্ধহস্ত। তবে রাজভবনকে সরাসরি রাজনীতির আখড়া করে তোলার ক্ষেত্রে নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহরা বোধ হয় চ্যাম্পিয়ন!

Advertisement
দেবাশিস ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ০১ অগস্ট ২০২৪ ০৯:১১
অনাস্থা: রাজ্যপালকে কালো পতাকা দেখালেন বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা। ১৫ ডিসেম্বর ২০২৩।

অনাস্থা: রাজ্যপালকে কালো পতাকা দেখালেন বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা। ১৫ ডিসেম্বর ২০২৩। ছবি: উদিত সিংহ। 

রাজ্যপাল নিয়ে আবার কিছু কথার সময় এসেছে। সরকার এবং রাজভবনের সম্পর্কের বিষয়টি ইদানীং প্রায়ই আলোচনায় আসে। শুধু এই রাজ্যে নয়, বিজেপি-বিরোধী দলের শাসনে থাকা বিভিন্ন রাজ্যে রাজ্যপালেরা এখন ঘোরতর রাজনৈতিক চরিত্র। সবাই দেখছে, তাঁদের মালিক কেন্দ্রীয় শাসকেরা ঠিক কী ভাবে রাজ্যপালদের ব্যবহার করতে চান।

Advertisement

অবশ্যই রাজ্যপালদের রাজনৈতিক স্বার্থে কাজে লাগাতে ইন্দিরা গান্ধী ছিলেন সিদ্ধহস্ত। তবে রাজভবনকে সরাসরি রাজনীতির আখড়া করে তোলার ক্ষেত্রে নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহরা বোধ হয় চ্যাম্পিয়ন! তাঁদের ‘বিকশিত’ ভারতে রাজভবনগুলি যে ভাবে মুখোশ খুলে রাজনীতি করার দলীয় প্রশ্রয় পেয়ে যাচ্ছে, তার জুড়ি মেলা ভার। সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গে জগদীপ ধনখড় ছিলেন এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ। রাজ্যপাল থেকে উপরাষ্ট্রপতি হয়ে পদাধিকারবলে তিনি এখন রাজ্যসভার চেয়ারম্যান। এবং প্রায় সব অধিবেশনেই চেয়ারম্যানের সঙ্গে বিরোধীদের (বিশেষত তৃণমূল) খটাখটি সংবাদের শিরোনাম হয়। এটা নিখাদ বাস্তব।

এই রাজ্যে রাজভবনের বর্তমান কর্তা সি ভি আনন্দ বোস, অনেকের মতে, তাঁর পূর্বসূরিকেও নাকি ছাপিয়ে যাচ্ছেন! তুলনা থাক। তবে এটা নিশ্চিত বলা চলে, রাজভবনের সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক এখন কলতলার ঝগড়ায় পৌঁছেছে। মতভেদ, মনোমালিন্য ইত্যাদি শব্দ সেখানে নেহাত লঘু। হাল এতটাই ন্যক্কারজনক।

লোকসভা ভোটের পরে পরিস্থিতি অনুযায়ী কোন ‘অঙ্ক’ কখন কী ভাবে কষা হচ্ছে, সেটাই এখন লক্ষণীয়। ভোটের পরে এই রাজ্যে বিজেপির বেহাল অবস্থা নিয়ে অধিক আলোচনা আজ নিষ্প্রয়োজন। কেন্দ্রে সরকার গড়েও খুব একটা ‘স্বস্তি’তে নেই নরেন্দ্র মোদী। বাংলার মতো রাজ্যগুলিতে রাজভবন কি তা হলে বিকল্প ‘ভরসা-কেন্দ্র’? বাংলায় রাজ্যপালের ভূমিকা ও গতিবিধি হয়তো বুঝতে হবে সে দিক থেকেই।

রাজভবনের সঙ্গে সরকারের মতের অমিল তো কতই হয়। এই রাজ্যেও ভূরি ভূরি হয়েছে। তবে এখন সাধারণ ভাবে একটি ধারণা তৈরি হয়ে যাচ্ছে যে, সরকারের সঙ্গে নিরন্তর সংঘাত এবং সরকারকে যেন তেন উত্ত্যক্ত করাতেই বুঝি এই রাজ্যপালের ‘আনন্দ’। অনেকে হয়তো বলবেন, এটাই তাঁর জন্য ‘নির্ধারিত’ কর্তব্য! ও সব কূট তর্কে কাজ নেই। আমরা বরং এটা দেখে বিস্মিত হতে পারি যে, রাজ্যপালের বিরুদ্ধে ‘অবমাননাকর’ মন্তব্য না করতে মুখ্যমন্ত্রীকে সতর্ক করেছে আদালত। তবে সমালোচনা করার অধিকার কাড়েনি। স্মরণকালে এমন হয়েছে বলে মনে পড়ে না। যেমন মনে পড়ে না, এক রাজ্যপালের বিরুদ্ধে যৌন নিগ্রহের একাধিক অভিযোগ উঠেছে এবং তাঁর সাংবিধানিক রক্ষাকবচ সত্ত্বেও তদন্তে ছাড়পত্র চেয়ে এক অভিযোগকারিণীর মামলা গ্রহণ করেছে দেশের সর্বোচ্চ ন্যায়ালয়। এগুলি স্বাধীনতার অমৃতকাল-এ বাংলার প্রাপ্তি!

স্বাধীনতা-উত্তর ভারতে কেন্দ্র ও রাজ্যগুলিতে যখন একদলীয় সরকার— এখনকার ভাষায় ‘ডাবল ইঞ্জিন’— কংগ্রেস সরকার চলেছে, তত দিন বিশেষ সংঘাত ছিল না। ১৯৫৯-এ কেরলে নাম্বুদ্রিপাদের কমিউনিস্ট সরকার ফেলার সময় রাজ্যপালের ভূমিকা বোধ হয় প্রথম ‘অর্থবহ’ হয়। তার পরে এই রাজ্যে ষাটের দশকের মধ্যভাগে অ-কংগ্রেসি যুক্তফ্রন্ট সরকার বসার পর্ব থেকে নানা সময় সরকার এবং রাজ্যপালের মধ্যে বিরোধ আলোড়ন ফেলেছে। সেই ধারা এখনও চলছে। বদলাচ্ছে শুধু তার চরিত্র ও অভিঘাত।

অজয় মুখোপাধ্যায়-জ্যোতি বসুদের প্রথম যুক্তফ্রন্ট সরকার পতনের নেপথ্যে তৎকালীন রাজ্যপাল ধর্মবীরের বিতর্কিত কার্যকলাপ প্রায় বিস্মৃত অতীত। কিন্তু তার দু’দশক পরে ১৯৮৪-তে বামফ্রন্ট আমলে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ কেন্দ্র করে তৎকালীন রাজ্যপাল অনন্তপ্রসাদ শর্মার সঙ্গে জ্যোতি বসু-সরকারের লড়াই আজও কিছুটা প্রাসঙ্গিক। কারণ তার সঙ্গে এখনকার পরিস্থিতি কিছুটা মিলতে পারে।

সংক্ষেপে ঘটনা ছিল, সরকারের পাঠানো উপাচার্যের প্যানেল থেকে আচার্য-রাজ্যপাল শর্মা সিপিএমের ‘পছন্দ’-এর রমেন পোদ্দারকে বেছে না-নিয়ে সন্তোষ ভট্টাচার্যকে বেছেছিলেন। ক্ষিপ্ত সিপিএম এক দিকে সন্তোষবাবুর জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছিল। অন্য দিকে, জ্যোতিবাবু রাজ্যপালকে ‘বয়কট’ করার সরকারি সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছিলেন। বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যেমন রাজভবন ‘বয়কট’ করে আছেন। যদিও তার পরিপ্রেক্ষিত সম্পূর্ণ আলাদা।

শর্মার বেলায় ছিল পূর্ণাঙ্গ বয়কট। কোনও মন্ত্রী তাঁর সঙ্গে এক মঞ্চে থাকতেন না। তিনি ডাকলে যেতেন না। সেই সময় কয়েক বার তাঁর সঙ্গে ব্যক্তিগত আলাপের সুযোগ হয়েছিল। বুঝতাম, রাজনীতির মূল স্রোতে ফিরে যেতে কংগ্রেসের শ্রমিক নেতা অনন্তপ্রসাদ কত ব্যগ্র।

বছরখানেক এখানে থাকার পরে যে সন্ধ্যায় হঠাৎ দিল্লি তাঁকে ফিরিয়ে নেয়, সে দিনও জ্যোতিবাবুরা কেউ তাঁকে বিদায় জানাতে যাননি। হাওড়া স্টেশনে গিয়েছিলেন তৎকালীন মুখ্যসচিব এস ভি কৃষ্ণন। এই জ্যোতিবাবুরাই আবার আদ্যন্ত গান্ধীবাদী রাজ্যপাল ত্রিভুবন নারায়ণ সিংহকে হাওড়ায় বিদায় জানিয়েছিলেন লাল গোলাপের তোড়া হাতে দিয়ে। গিয়েছিলেন প্রমোদ দাশগুপ্তও। স্লোগান উঠেছিল, ‘কমরেড ত্রিভুবন নারায়ণ সিংহ লাল সেলাম।’ অর্থ পরিষ্কার, সরকারের কাছে রাজ্যপাল কতটা ‘বন্ধু’ হতে পারলেন। বিষয়টি পারস্পরিকও বটে।

স্বাধীন ভারতে রাজ্যপালের ভূমিকা এবং আচরণবিধি নিয়ে সাংবিধানিক স্তরে বিতর্ক হয়েছে অনেক। এক সময় আইনসভায় প্রস্তাব উঠেছিল, রাজ্যপাল নির্বাচিত হবেন, মনোনীত নন। স্বাধীনতার মাস দুয়েক আগে আইনসভায় রাজ্যপাল বিষয়ক সাব-কমিটির সদস্য বি জি খের, কৈলাসনাথ কাটজু ও পি সুব্বারায়ানের সেই প্রস্তাব অবশ্য শেষ পর্যন্ত কার্যকর হয়নি। তবে বাবাসাহেব আম্বেডকর থেকে শুরু করে বল্লভভাই পটেল প্রমুখ সবাই একটি বিষয়ে একমত হন যে, রাজ্যপাল চলবেন মন্ত্রিসভার পরামর্শ নিয়ে। তাঁর কাজ মুখ্যমন্ত্রীকে ‘সহায়তা’ করা, সরকারের কাজে সমস্যা সৃষ্টি করা নয়।

এই সূত্রে আরও এক বার জ্যোতিবাবুর কথা বলতে হয়। বিজেপির বীরেন জে শাহ সদ্য রাজ্যপাল হয়ে এসেছেন। প্রথম বাজেট। মন্ত্রিসভায় অনুমোদন করা রাজ্যপালের বাজেট বক্তৃতার খসড়া নিয়ে রাজভবনে গেলেন তখনকার মুখ্যসচিব মণীশ গুপ্ত। শাহ ভাষণের বয়ানে কিছু পরিবর্তন করতে চাইলেন। মুখ্যসচিব সে কথা মুখ্যমন্ত্রীকে জানাতেই জ্যোতিবাবু সাফ বললেন, “রাজ্যপালের সেই এক্তিয়ার নেই। কারণ এটি মন্ত্রিসভার অনুমোদিত।”

মণীশ আবার ফিরলেন রাজভবনে। শাহকে বোঝালেন, রাজ্যপালের এই জোরাজুরি ধোপে টিকবে না। এবং জ্যোতিবাবুকে আলাদা ভাবে অনুরোধ করলেন, রাজ্যপালের ‘সম্মান’ রক্ষার্থে বক্তব্যের মর্ম ঠিক রেখে দু’-একটি বাক্য বদল করা ভাল। সেটা হয়েছিল। বীরেন শাহ-ও আর কখনও সরকারকে ‘বিব্রত’ করার পথে যাননি।

সবাই জানি, রাজ্যপাল নামক ‘নিরপেক্ষ’ সাংবিধানিক পদাধিকারীকে সচেতন ভাবে (রাজনৈতিক) সংবাদের উপকরণ করে তোলার ক্ষেত্রে অগ্রণী ছিলেন ধনখড়। আপাতত এটুকু বলাই হয়তো যথেষ্ট হবে যে, তাঁর আমলে রাজভবন কার্যত বিজেপি নেতাদের সমান্তরাল দফতর হয়ে উঠেছিল। আইনজ্ঞ ধনখড় আগে পেশাদার রাজনীতি করেছেন। প্রায় একই সময়ে বাংলার বিজেপি সভাপতির পদ অলঙ্কৃত করে যাওয়া আর এক ভদ্রলোক উত্তর-পূর্বের একাধিক রাজ্যে রাজ্যপাল থাকাকালীন অবাধে সমাজমাধ্যমে লিখে এই রাজ্যের রাজনীতিতে ইন্ধন জোগাতেন।

আর আনন্দ বোস? উপাচার্য নিয়োগ নিয়ে এই প্রাক্তন আইএএস কী করেছেন, বিধানসভায় পাশ হওয়া ক’টা বিল ‘আটকে’ আছে, রাজ্যপালের বিরুদ্ধে ওঠা শ্লীলতাহানির অভিযোগের গতি কী হবে, সে সব নাহয় বাদই দিলাম। কেউ কি ভাবতে পারে, নীতি আয়োগের বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রীর ভূমিকাকে কটাক্ষ করে রাজভবন ‘এক্স’ হ্যান্ডল-এ বার্তা দিচ্ছে! রাজভবনের এর চেয়ে কদর্য রাজনৈতিক চেহারা আর কী হতে পারে, জানা নেই।

তবে ইঙ্গিত পরিষ্কার। আনন্দ বোস রাজ্যপাল আছেন। শাসক বিজেপির এটাই কৌশল। শেক্সপিয়রের জুলিয়াস সিজ়ার নাটকের উক্তি ধার করে বলা যায়, বোস ‘ইজ় অ্যান অনারেবল ম্যান’।

আরও পড়ুন
Advertisement