—প্রতীকী ছবি।
শহরে এসেছে নতুন সার্কাস। কোনও প্রবেশমূল্য নেই। তাই প্রতি দিনই বাড়ছে দর্শকের ভিড়। দর্শকাসন কানায় কানায় পূর্ণ, এমন এক দিনে তাঁবুর মধ্যে খাঁচা খুলে ছেড়ে দেওয়া হল সার্কাসের বাঘটিকে। মুহূর্তে হুড়োহুড়ি। সকলেই বেরোতে চান। এ বার জানা গেল, বেরোতে হলে দিতে হবে মোটা রকম মাসুল!
এটি নিছকই এক কাল্পনিক গল্প। ২০১৬ সালে একটি বিশেষ টেলিকম সংস্থা ‘বিলকুল মুফত’ টেলিফোন পরিষেবা চালু করার পরে শুনেছিলাম।
সম্পূর্ণ নিখরচায় সারা দিন ইন্টারনেট ব্যবহার করা যাচ্ছে, কথা বলা যাচ্ছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, এই আকর্ষণ উপেক্ষা করার সাধ্য কার! দেশে সরকারি-বেসরকারি সব টেলি-পরিষেবা প্রদানকারী সংস্থাই এই ‘বিনি পয়সার ভোজ’-এর ধাক্কায় টেলিফোন এবং ইন্টারনেটের মাসুল কমাতে বাধ্য হল।
স্বাধীনতা-উত্তর ভারতে দীর্ঘকাল টেলিকম পরিষেবা ছিল একান্ত ভাবে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে। বহু দিন অবধি বাড়িতে ল্যান্ডলাইন থাকা ছিল ‘স্টেটাস সিম্বল’। ১৯৮১ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী প্রতি বছর পাঁচ লক্ষ টেলিফোন লাইন স্থাপনের লক্ষ্যে ফ্রান্সের এক সংস্থার সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েও বিরোধীদের চাপে তা বাতিল করতে বাধ্য হয়েছিলেন। তবে টেলি-পরিষেবায় উদারীকরণ তথা সংস্কার প্রচেষ্টা থেমে থাকেনি। টেলিকমের বিষয়টিকে বাড়তি গুরুত্ব দিতে ১৯৮৫ সালে টেলিকমকে ভারতীয় ডাক থেকে পৃথক করা হল। ১৯৯০ সালে ভারত সরকার যে ‘উদারীকরণ-বেসরকারিকরণ-বিশ্বায়ন’ নীতি গ্রহণ করল, তারই হাত ধরে ১৯৯১ সালে অসরকারি সংস্থার জন্যে টেলিকম শিল্পে বিনিয়োগের দরজা খুলে দেওয়া হল। একচেটিয়া সরকারি পরিষেবা কিছুটা হলেও এই সময় থেকে প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হয় এবং কিছুটা সুলভ হতে শুরু করে টেলিফোন পরিষেবা। এর পরে বাজারে এল মোবাইল। ১৯৯৫ সালের ৩১ জুলাই পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু প্রথম মোবাইল ফোনে কথা বলেন কেন্দ্রীয় টেলিকম মন্ত্রী সুখরামের সঙ্গে। কানেকশনটি ছিল বেসরকারি, ভারতের ‘বিকে মোদী গোষ্ঠী’ এবং অস্ট্রেলিয়ার ‘টেলস্ট্রা’-র যৌথ উদ্যোগে। তখন অবশ্য ইনকামিং ও আউটগোয়িং কল— দুইয়েরই চড়া মাসুল ছিল।
বর্তমানে ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্ট কিংবা আধার কার্ড, সব ক্ষেত্রেই মোবাইল নম্বর সংযুক্তিকরণ বাধ্যতামূলক। এ দিকে লক্ষ্মীর ভান্ডার, প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার ঘর, গ্যাসের ভর্তুকি কিংবা একশো দিনের কাজের মজুরি-সহ যাবতীয় টাকা ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ছাড়া পাওয়ার উপায় নেই। ফলে দেশের দরিদ্রতম মানুষটিকেও অন্তত একটি মোবাইল সংযোগ বজায় রাখতে হচ্ছে— জীবনধারণের অপরিহার্য উপকরণ।
আর ঠিক এখানেই বিপদ। রাষ্ট্রায়ত্ত বিএসএনএল অনেক আগে থেকেই ধুঁকছে। সেই বিশেষ টেলিকম সংস্থার ‘বিনামূল্যে পরিষেবা’-র ধাক্কায় এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত অন্য বেসরকারি সংস্থাগুলিও ধীরে ধীরে রুগ্ণ হতে শুরু করল। যে দু’-একটি সংস্থা টিকে আছে, সেগুলির অস্তিত্বও চরম সঙ্কটে। যে সব গ্রাহক লাইফটাইম ইনকামিং সুবিধা লাভের জন্যে ২০০৫-০৭ সালে ৯৯৯ টাকা অথবা ২০০৮-১০ পর্যন্ত ৪৯৫ টাকার রিচার্জ করিয়েছিলেন, তাঁদের সেই সুবিধা লুপ্ত হয়েছে। টেলি-সংযোগ বজায় রাখার ন্যূনতম শুল্ক মাসে ৩৫ টাকা থেকে ধাপে ধাপে ৪৯ টাকা, ৭৯ টাকা, ৯৯ টাকা থেকে বর্তমানে ২৮ দিনের জন্যে ১৭৯ টাকার প্যাকেজে এসে দাঁড়িয়েছে। শুরুর দিকে ন্যূনতম ১০ টাকা দিয়ে রিচার্জ করেও কথা বলা যেত, সেই সুবিধাও আর নেই।
বর্তমান প্যাকেজগুলিতে কথা বলার পাশাপাশি কিছুটা ডেটা এবং এসএমএস-এর সুবিধা যুক্ত থাকছে। ফলে শুধুমাত্র সংযোগটি বজায় রাখার বাধ্যবাধকতায় প্রয়োজন না থাকলেও সকলকে ডেটা এবং এসএমএস-এর সুবিধা কিনতে হচ্ছে। এ ধরনের প্যাকেজ ‘উপভোক্তা সুরক্ষা আইন’ ২০১৯-এর ২(৪১)(২) ধারায় বর্ণিত ‘রেস্ট্রিক্টিভ ট্রেড প্র্যাক্টিস’ তো বটেই, একই সঙ্গে ওই আইনের ২(৯)(৩) ধারায় উপভোক্তার জন্যে প্রদত্ত প্রতিযোগিতামূলক মূল্যে পছন্দের পরিষেবা গ্রহণের অধিকারটিকেও হরণ করা হচ্ছে।
এমনটা যে ঘটতে পারে, সেটা আঁচ করে ভারত সরকার ১৯৯৭ সালে ‘টেলিকম রেগুলেটরি অথরিটি অব ইন্ডিয়া’ (ট্রাই) নামে এক নিয়ন্ত্রক সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিল। উদ্দেশ্য ছিল, উপভোক্তার স্বার্থ সুরক্ষিত রাখার পাশাপাশি টেলিযোগাযোগ, সম্প্রচার এবং কেব্ল পরিষেবার উন্নতি ও সম্প্রসারণের মাধ্যমে অধিকতর উপভোক্তাকে উন্নততর পরিষেবা পৌঁছে দেওয়া। একই সঙ্গে প্রতিযোগিতামূলক বাজার সৃষ্টির (মাসুল নিয়ন্ত্রণের অন্যতম হাতিয়ার) কথাও বলা হয়েছিল। কিন্তু এই বজ্র আঁটুনি আদতে গ্রাহকদের কোনও কাজেই আসেনি। অবশ্য ২০০০ সালে ট্রাই (অ্যামেন্ডমেন্ট) অর্ডিন্যান্স জারির মাধ্যমে ট্রাই-এর ক্ষমতা কিছুটা লঘু করা হয়। এই সংশোধনী অর্ডিন্যান্সে ট্রাই-এর উপর অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে উপভোক্তা ও পরিষেবা প্রদানকারী, উভয়ের স্বার্থ সুরক্ষিত করার দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে, যা বস্তুত সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী। ট্রাই যে কাদের স্বার্থ সুরক্ষায় তৎপর, তা কতিপয় টেলিকম কোম্পানির উপর্যুপরি বাধাহীন মাসুল বৃদ্ধি থেকেই স্পষ্ট।
টেলিকম গ্রাহকরা এখন প্রকৃত অর্থেই সেই সার্কাসের তাঁবুর মধ্যে বাঘের সামনে অসহায় ভাবে বন্দি। সঙ্ঘবদ্ধ গ্রাহক-জাগরণ ছাড়া এই ক্রমবর্ধমান জুলুম থেকে পরিত্রাণ মেলা দুরূহ।