দিল্লির উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে যে সাঙ্ঘাতিক সাম্প্রদায়িক সংঘাত ঘটেছিল, সে বিষয়ে দিন কয়েক আগেই দিল্লি বিধানসভার শান্তি ও সম্প্রীতি কমিটি একগুচ্ছ প্রশ্ন করল ফেসবুককে। কার্যত সব প্রশ্নের উত্তরেই ফেসবুক মৌন। বৈঠকে ফেসবুকের প্রতিনিধিত্ব করছিলেন শিবনাথ ঠুকরাল। দিল্লির প্রসঙ্গটি তুলে কমিটি প্রধান রাঘব চড্ডা তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ভারতের প্রেক্ষিতে হেটস্পিচ বা ঘৃণাসূচক তথ্যের কি কোনও সংজ্ঞায়ন হয়েছে? দিল্লির অশান্তির সময়ে বেশ কিছু বিদ্বেষমূলক পোস্ট ফেসবুকে দেখা গিয়েছিল। এই বিষয়ে ফেসবুক কী ব্যবস্থা করল? এই ধরনের প্রতিটি প্রশ্নের ক্ষেত্রেই শিবনাথ বললেন, “আমি এ ক্ষেত্রে উত্তর না দেওয়ার অধিকার প্রয়োগ করতে চাইছি।”
ফেসবুকের বিশ্বব্যাপী গ্রাহকদের ৪০ শতাংশই ভারতীয়। অর্থাৎ ফেসবুকের ব্যবসার সিংহভাগ উপার্জনই আসে ভারতীয় বাজার থেকে— তা হলে সে দেশের আইন মানতে বা আইনের শাসনকে সুস্থিত রাখতে কেন বাধ্য নয় ফেসবুক, কেন এই প্ল্যাটফর্মকে ব্যবহার করে দিনেদুপুরে মানুষ খুনের রাজনীতি করা হলে দায় তার উপর বর্তাবে না? শিবনাথ ঠুকরাল উত্তর এড়িয়ে গিয়েছেন।
যুক্তিসঙ্গত জবাব দিতে তিনি অপারগ, এমনটা মনে করা মোটেই ভুল হবে না। এমনিতে তাঁরা সব সময়েই দাবি করেন যে, অপতথ্য দেখলেই ব্যবস্থা করা হয়। এই বৈঠকে তিনি বলেছেন, ফেসবুকের হাতে এখন ১১টি ভাষার ফ্যাক্ট-চেকার রয়েছে। কিন্তু তথ্য বলছে, এই মুহূর্তে ফেসবুকে ব্যবহার করা যায় ২০টি ভারতীয় ভাষা। তা হলে কী ভাবে সম্ভব বাকি ন’টি ভাষায় তথ্য যাচাই? এই ভাষাগুলিতে হিংসা উদ্রেককারী কিছু ছড়ানো হলে ফেসবুক বুঝতেও পারবে না।
হীরেন যোশীর নেতৃত্বাধীন নরেন্দ্র মোদীর সোশ্যাল মিডিয়া স্ট্র্যাটেজিক টিমের সদস্য ছিলেন শিবনাথ ঠুকরাল। ফেসবুক ইন্ডিয়ার ম্যানেজিং ডিরেক্টর অজিত মোহন বারংবার বলেন, “আমাদের কর্মীরা কর্তব্যনিষ্ঠ, কোনও দলমতের প্রতি তাঁদের ঝোঁক নেই।” কিন্তু ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটের আগে শিবনাথ যে আদাজল খেয়ে মোদীর প্রচারে নেমেছিলেন, তার প্রমাণ এখনও রাখা রয়েছে নরেন্দ্র মোদীর ব্যক্তিগত ওয়েবসাইটেই।
শিবনাথ ফেসবুকের দায়িত্বে এসেছেন আঁখি দাসের পরিবর্ত হিসাবে। অতীতে বিজেপি নেতা টি রাজা সিংহ মুসলিম অনুপ্রবেশকারীদের গুলি মারার নিদান দিলেও আঁখি দাস ফেসবুকের সহকর্মীদের বুঝিয়েছিলেন যে, কিছুতেই টি রাজার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা করা যাবে না, কারণ তাতে ব্যবসায়িক ক্ষতি হতে পারে। এই আঁখি দাসই মোদীর জয়ের কারণ দর্শাতে ২০১৪ সালে কলমও ধরেছিলেন। তিনি মোদীর কৃতিত্বে ফেসবুকের অংশীদারি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন নিজের লেখায়।
এখানে উল্লেখ করা যাক, ২০১৯ সালের একটি ঘটনার কথা। আভাজ় নামক ফ্যাক্ট চেকিং সংস্থার প্রতিনিধি আলফিয়া জোয়াব ফেসবুকের ভারতীয় কর্মীদের সঙ্গে একটি ভিডিয়ো মিটিং সারছিলেন। তিনি এমন ১৮০টি পোস্টের উদাহরণ দেন, যেখানে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে ঘৃণা ছড়ানো হয়েছে। জোয়াব দেখান, অসমে এক বিজেপি নেতা ধর্ষণের খবর ফেসবুকে উপস্থাপন করে লিখেছেন, এ ভাবেই বাংলাদেশি মুসলিমরা আমাদের ঘরের মেয়েদের টার্গেট করে। কোনও ব্যবস্থা করা হয়নি এই ধরনের পোস্টগুলির বিরুদ্ধে। হবেই বা কী করে, অসমিয়া ভাষায় কোনও আৰ্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নির্ভর ফ্যাক্ট-চেকারই তো ছিল না ফেসবুকের কাছে।
ফেসবুকের এই অসুখের কার্যকারণ কিন্তু ধরেছিলেন ফেসবুকের অভ্যন্তরীণ প্রতিনিধিই। ফেসবুকের প্রাক্তন মুখ্য নিরাপত্তা আধিকারিক অ্যালেক্স স্টামোস বছর দুয়েক আগে টুইটারে লেখেন, “ফেসবুকের মুখ্য সমস্যা হল আমাদের নীতিনির্ধারকদের সরকারকে খুশি করতে হয়, আবার নিজেদের প্রতিষ্ঠানের নিয়মও মানতে হয়।” স্টামোস বলেছিলেন, স্থানীয় ভাবে ফেসবুকে যাঁদের পলিসি হেড হিসাবে নিয়োগ করা হয়, তাঁরা বেশির ভাগ শাসক দল ঘনিষ্ঠ হন। “সমাজের নিচুতলা থেকে, কোনও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী থেকে নীতিনির্ধারক তুলে আনা হয়েছে, এমন ঘটনা অতি বিরল।” এই স্বীকারোক্তির পর ভারতেই যা ঘটেছে তাতে তাঁকে নিরহং ভবিষ্যৎদ্রষ্টা বলতে হয় বইকি।
উল্লেখ করতেই হয় আরও দু’জনের কথা— সোফি ঝ্যাং ও ফ্রান্সিস হাউগেন। দু’জনেই ফেসবুককে নিবিড় ভাবে জেনেছেন। এক জন বীতশ্রদ্ধ হয়ে বেরিয়ে আসার আগে যা দেখেছেন তা নিয়ে নোট রেখে এসেছেন, অন্য জন নথি ঘেঁটে সব তথ্য সামনে নিয়ে এসেছেন। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে দিল্লির হিংসার জন্য ফেসবুককে কাঠগড়ায় তুলেছিলেন সোফি। হাউগেনের রিপোর্ট তুলে ধরেছে সে সময় ফেসবুকে কী ভাবে মুসলিম বিরোধী প্রচার, ভুয়ো তথ্যের বান ডেকেছিল। অথচ বহু ক্ষেত্রে মুখে কুলুপ এঁটেছিল ফেসবুক। অনেকেই মনে করতে পারবেন কপিল মিশ্র, অনুরাগ ঠাকুর এবং প্রবেশ বর্মার মতো বিজেপি নেতাকে এই হিংসার অব্যবহিত পূর্বে উস্কানিমূলক মন্তব্য করতে দেখা গিয়েছিল। তাঁদের বিরুদ্ধে একটিও ব্যবস্থা করা হয়নি কোনও তরফ থেকেই।
অবশ্য সব দোষ শাসক দল আর ফেসবুকের ঘাড়ে চাপিয়ে দিলেই এ আখ্যান শেষ হয় না। দেশে এই মুহূর্তে বিরোধী স্বর ঠিক কতটা দুর্বল, তা বুঝতে ফেসবুকের এই চুপ করে থাকার ধৃষ্টতাই যথেষ্ট। ফেসবুককে ব্যবহার করে গণচিতা সাজানো রুখতে এই মুহূর্তে ভারতে বিরোধী শক্তির উঠে আসা প্রয়োজন। হাতে রক্ত নিয়ে ফেসবুক চুপ করে থাকলে কি নাগরিক সমাজও চুপ করে থাকবে, এ প্রশ্ন করতে হবে নিজেদেরই।