দুর্নীতি নিয়ে মানুষ বিরক্ত, তবুও তৃণমূল ভোটে জেতে কেন
West Bengal Assembly By Election Results 2024

দল নয়, সরকার

বিগত জমানার সঙ্গে, অথবা ভারতের অন্যান্য রাজ্যের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ মডেলের মূল পার্থক্য এই জায়গায়— পশ্চিমবঙ্গে দুর্নীতির ব্যবস্থাটি বিকেন্দ্রিত, তার লোকাল-জ়োনাল-রাজ্য স্তরের হায়ারার্কি নেই।

Advertisement
অমিতাভ গুপ্ত
শেষ আপডেট: ২৬ নভেম্বর ২০২৪ ০৫:৫৯
সাফল্য: নৈহাটি কেন্দ্রের উপনির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থীর জয় উদ্‌যাপন করছেন কর্মী-সমর্থকরা। ২৩ নভেম্বর।

সাফল্য: নৈহাটি কেন্দ্রের উপনির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থীর জয় উদ্‌যাপন করছেন কর্মী-সমর্থকরা। ২৩ নভেম্বর। —ফাইল চিত্র।

পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের জমানায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়েছে, এ কথা বললে যাঁরা খুব রেগে যাবেন, তাঁরা এক বার ‘গণতন্ত্র’ কথাটাকে ভেঙে দেখতে পারেন— এটা এমন একটা ব্যবস্থা, যেখানে সবার অধিকার সমান। পশ্চিমবঙ্গে অন্তত দুর্নীতি এখন গণতন্ত্রায়িত। সবার অধিকার আছে দুর্নীতিতে, অবৈধ খাজনা আদায়ে— অন্তত তাদের, যাদের মাথায় শাসক দলের আশীর্বাদী হাত রয়েছে। বিগত জমানার সঙ্গে, অথবা ভারতের অন্যান্য রাজ্যের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ মডেলের মূল পার্থক্য এই জায়গায়— পশ্চিমবঙ্গে দুর্নীতির ব্যবস্থাটি বিকেন্দ্রিত, তার লোকাল-জ়োনাল-রাজ্য স্তরের হায়ারার্কি নেই। বড় জোর, আদায় করা খাজনার একটি অংশ যথাস্থানে প্রণামী দিতে হয়, বাকি অংশের উপরে একচ্ছত্র অধিকার। অতএব, রাজ্যের আনাচেকানাচে গজিয়ে উঠেছে বিভিন্ন মাপের মনসবদার— তাদের মধ্যে কারও দখলে নদীর বালি, কারও সাম্রাজ্য নোনা জলের ভেড়িতে বিস্তৃত, কেউ রেশনের চালের চোরাকারবারি, কারও খাজনা আদায়ের ক্ষেত্র সরকারি চাকরি পাইয়ে দেওয়ার আশ্বাস, কেউ আবার হাসপাতালে রাজত্ব চালায়। খেয়াল করে দেখার, সাম্প্রতিক কালে এই মনসবদারদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ভাবে জনরোষ সংগঠিত হয়েছে। কিন্তু, এক দিকে যেমন কেউ একটা দুর্নীতির সঙ্গে অন্য দুর্নীতির অবিচ্ছেদ্য যোগসূত্রটির দিকে ইঙ্গিত করেননি, ঠিক এমনই এই বিপুল জনরোষও কমাতে পারেনি এদের প্রতি শাসক দলের শীর্ষ স্তরের প্রশ্রয়ের পরিমাণ।

Advertisement

কেন, তার একটা সহজ উত্তর আছে। কিন্তু, তার আগে স্পষ্ট করে বলে রাখা দরকার— পূর্ববর্তী বাম জমানায় দুর্নীতি বা আইনহীনতা ছিল না, অথবা এখন ভারতের অন্য কোনও রাজ্যে আইনহীনতা নেই, এমন দাবি করার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। অতীতের পশ্চিমবঙ্গ বা বর্তমানে অবশিষ্ট ভারতের দুর্নীতির তুলনায় পশ্চিমবঙ্গে দুর্নীতি-আইনহীনতা কম না বেশি, এই প্রশ্নটারও কোনও বস্তুনিষ্ঠ উত্তর দেওয়া অসম্ভব, কারণ কাঠামোগত ভাবে এক-একটি দুর্নীতি এক-এক রকম। যেটা করা সম্ভব, তা হল, পশ্চিমবঙ্গের আজকের অবস্থার পিছনে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক যুক্তিগুলোর সন্ধান।

তৃণমূল কংগ্রেসের আদর্শগত অবস্থান কী, এই প্রশ্ন করলে ঘোর সমর্থকেরও মাথা চুলকানো ছাড়া উপায় থাকবে না। বিরোধী থাকাকালীন অন্তত সিপিএমের শাসনের অবসান ঘটানোর একটা রাজনৈতিক লক্ষ্য ছিল, কিন্তু ২০১১-পরবর্তী পর্যায়ে সেটুকুও রইল না। ফলে, তৃণমূল করার কারণ খুঁজতে গেলে একটিই সম্ভাব্য উত্তর— খাজনা আদায় করার অধিকার অর্জন করা। আজ যদি দলের শীর্ষ নেতৃত্ব সেই অধিকারটাই কেড়ে নিতে চান, তা হলে রাজ্য জুড়ে দলের কাঠামো তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়বে না, সেই গ্যারান্টি দেওয়া মুশকিল। অতএব, যতই হল্লা হোক, প্রশ্রয় অব্যাহত থাকে।

উত্তরটা সহজ, কিন্তু সম্পূর্ণ নয়। দুর্নীতির অধিকার এমন অনুভূমিক না হয়ে যদি উল্লম্ব হত— মানে, যদি শীর্ষ স্তর থেকে ধাপে ধাপে দুর্নীতির নিয়ন্ত্রণ নীচের স্তরে পৌঁছত, আবার দুর্নীতিবাবদ উপার্জিত অর্থও প্রথমে শীর্ষ স্তরে পৌঁছত এবং পরে তার হিস্যা নামত নীচের স্তরে, তা হলেও কিন্তু রাজনীতির দুর্নীতিভিত্তিক আকর্ষণ বজায় রাখা সম্ভব হত। এক অর্থে সে কাঠামো অনেক বেশি কর্পোরেট, এবং অনেক বেশি কুশলীও বটে। স্পষ্ট জানা থাকত যে, কোথায় কতখানি কাঞ্চনমূল্যে কতটা কাজ হবে। শিল্প মহলও এমন দুর্নীতিতে খুব আপত্তি করে না। তা সত্ত্বেও এমন অনুভূমিক গণতান্ত্রিক দুর্নীতির ব্যবস্থাটিই পশ্চিমবঙ্গে চালু রইল কেন?

সে প্রশ্নের উত্তর দুর্নীতির রকমসকমে নেই, বরং শাসক দলের রাজনৈতিক চরিত্রে রয়েছে। তৃণমূল কংগ্রেস যে এককেন্দ্রিক দল, তা দলের জন্মলগ্ন থেকেই স্পষ্ট। ইদানীং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতার দ্বিতীয় মেরু হিসাবে উঠে এসেছেন বটে, কিন্তু তাতে দলের মূলগত চরিত্রটি পাল্টায়নি। তৃণমূল কংগ্রেসে ধাপে ধাপে ক্ষমতার বিন্যাস নেই— শীর্ষ নেতৃত্ব ও জনগণের মধ্যে অনেক মাপের নেতা আছেন বটে, কিন্তু কোনও স্তরেই তাঁরা কোনও যৌথ ধাপ গঠন করেন না। শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে মেজো-সেজো-ছোট-চুনো নেতার মধ্যে রয়েছে আনুগত্যের এক-একটি সূত্র— প্রতিটি আনুগত্যের সূত্র একে অন্যের থেকে বিচ্ছিন্ন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই একে অন্যের প্রতিদ্বন্দ্বীও বটে। কংগ্রেসের থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার সময় তৃণমূলের জিন-শৃঙ্খলায় বাহিত হয়েছিল একটি পুরনো ব্যাধি— গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, দলের অভ্যন্তরে পারস্পরিক বিদ্বেষ ও প্রতিযোগিতা। মমতা বা অভিষেক সে ব্যাধি নিরাময়ের বিন্দুমাত্র চেষ্টা করেছেন, বললে অন্যায় হবে। সনাতন কংগ্রেসি সংস্কৃতিতে শীর্ষ নেতৃত্ব এই গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের ভরসায় থাকে— নীচের স্তর পারস্পরিক প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত থাকায় কখনও শীর্ষ নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করার পরিস্থিতি তৈরিই হয় না। এই ক্ষেত্রেও তৃণমূলের সংস্কৃতি তার উৎস থেকে খুব দূরে যেতে পেরেছে বলে মনে হয় না। ফলে, দলে যেমন রাজনৈতিক ক্ষমতার স্তরবিন্যাস তৈরিই হয়নি, তেমনই দুর্নীতির ‘কর্পোরেট কাঠামো’-ও তৈরি করা অসম্ভব। এ রাজ্যে রাজনৈতিক ক্ষমতাই হোক বা দুর্নীতির মডেল, তার উল্লম্ব বিন্যাস হতে পারে না। অনুভূমিক বিন্যাসই একমাত্র বিকল্প।

অতএব, পশ্চিমবঙ্গে দুর্নীতির অনুভূমিক, ‘গণতান্ত্রিক’ কাঠামো চলছে। যে মনসবদারের অধীনে যতখানি জমি, তিনি সেখান থেকে খাজনা আদায় করছেন। আর, খাজনা তুলতে হলে যে মাঝেমধ্যে লেঠেলের প্রয়োজনও পড়ে, সে কথা কে না জানে! সুতরাং, গা-জোয়ারিও চলছে। ইদানীং তার একটা নতুন নাম হয়েছে— থ্রেট কালচার। তবে, জিনিসটা যে নতুন নয়, এবং মৌখিক থ্রেটে কাজ না হলে মারধর বা গুলি-বোমাও যে চলেই থাকে, পশ্চিমবঙ্গ অভিজ্ঞতায় জানে। প্রশ্ন হল, এই সর্বগ্রাসী দুর্নীতি এবং গা-জোয়ারির প্রভাব ভোটব্যাঙ্কে পড়ে না কেন? লোকসভা নির্বাচনের আগে সন্দেশখালিতে যে বিপুল জনরোষ তৈরি হল, এবং যার রাজনৈতিক সুবিধা ঘরে তুলতে সর্বশক্তিতে ঝাঁপাল বিজেপি, সেই বসিরহাট লোকসভা কেন্দ্রে তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী জিতলেন তিন লক্ষ তেত্রিশ হাজার ভোটে। সন্দেশখালির ঘটনা নাহয় কলকাতার সুশীল সমাজকে তেমন আলোড়িত করতে পারেনি, ফলে রাজ্য রাজনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কণ্ঠস্বর— মহানগরের মধ্যবিত্তদের কণ্ঠস্বর— তখন শোনা যায়নি। কিন্তু অগস্ট মাস থেকে আর জি কর-কাণ্ডকে কেন্দ্র করে যে রাত দখল আর দ্রোহের উৎসব চলল, ছ’টি কেন্দ্রে বিধানসভা উপনির্বাচনে তার বিন্দুমাত্র প্রভাব পড়ল না কেন? এই প্রশ্নের উত্তর না-খুঁজে উপায় নেই, কারণ রাজনীতি ও দুর্নীতির পারস্পরিক মিথোজীবী সম্পর্ক ভাঙতে পারে শুধুমাত্র ভোটবাক্সে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়লেই।

এই প্রশ্নের উত্তরও, কী আশ্চর্য, রয়েছে শাসক দলের কাঠামোর মধ্যেই। পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আমলে যে প্রত্যক্ষ নগদ হস্তান্তরভিত্তিক উন্নয়ন নীতি চালু হয়েছে (এবং, রাজ্যের মানব উন্নয়নে, বিক্ষিপ্ত ভাবে হলেও, তার তাৎপর্যপূর্ণ সুপ্রভাব পড়েছে), সেটি চরিত্রগত ভাবে সম্পূর্ণ প্রশাসননির্ভর। সেই সুবিধাগুলি পেতে হলে স্থানীয় স্তরে কাটমানি বিলক্ষণ দিতে হয়, কিন্তু যাবতীয় দুর্নীতি সত্ত্বেও প্রকল্পগুলি চলে প্রশাসনিক ভাবে, দলীয় স্তরে নয়। অর্থাৎ, দলে সর্বব্যাপী কাঠামোকে বাইপাস করে মুখ্যমন্ত্রী সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে যেতে পারেন ‘সরাসরি’। কেউ বলতে পারেন, এটি সচেতন ভাবে বেছে নেওয়া পন্থা— আবার কেউ বলতে পারেন, এটি নান্যঃ পন্থাঃ। দলের সেই কাঠামোই নেই, যার মাধ্যমে ধাপে ধাপে মানুষের কাছে পৌঁছনো যায়— ফলে, রাজনৈতিক ভাবেও যদি মানুষের কাছে পৌঁছতে হয়, তা হলেও প্রশাসনই ভরসা। মানুষের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের ক্ষেত্রে দলকে সম্পূর্ণ ছেঁটে ফেলার উদাহরণ চোখের সামনেই আছে— সাম্প্রতিক কালে এ রাজ্যের দু’টি অতি সফল রাজনৈতিক কার্যক্রম ছিল ‘দিদিকে বলো’ আর ‘সরাসরি মুখ্যমন্ত্রী’।

রাজ্যের মানুষও এক ভাবে এই কথাটি বুঝে নিয়েছেন। তাঁরা তৃণমূলের মনসবদারদের দাপটে বিরক্ত, ক্ষুব্ধ— সামান্যতম ঘটনাতেই এখন সেই ক্ষোভ বেরিয়ে আসে প্রকাশ্যে। কিন্তু, একই সঙ্গে এই অত্যাচারকে তাঁরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজ্য সরকারের থেকে আলাদা করে দেখেন। এবং সেই কারণেই, ভোট দেওয়ার সময় তাঁরা সরকারকে বাছেন, দলকে নয়। কথাটা ‘সোনার পাথরবাটি’র মতো হল বটে, কিন্তু এই বাস্তবকে অস্বীকার করে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি অথবা দুর্নীতিকে বোঝার উপায় নেই।

আরও পড়ুন
Advertisement