—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
শিক্ষার সংস্কার আগে না শিক্ষা আগে? মুরগি ও ডিমের উৎপত্তি সংক্রান্ত প্রশ্নটির মতোই এ বিবাদও অসমাপ্য হলেও বেশ তেজিয়ান। এক দিকে অভিযোগ, কিছুই হচ্ছে না। অন্য দিকে দাবি, শিক্ষা ক্ষেত্রে আমরা ফার্স্ট। এই আবর্তে শিক্ষা কূল খুঁজতে হয়রান। অথচ অভিযোগ ও দাবি, দুইয়ের মধ্যে কিছু না কিছু সত্য আছে, খণ্ডসত্যও আছে। সমস্যা হল, এর বাইরে যে বিরাট সত্যটা শিক্ষার অর্থ ও অস্তিত্ব বিষয়ে প্রশ্ন তোলে, সেটা প্রায়ই অলক্ষ্যে থেকে যায়।
এটা সত্য যে, সরকারি স্কুলে ভর্তির দিক দিয়ে এ-রাজ্য ফার্স্ট, পাঁচ জনের মধ্যে চার জন ছাত্রছাত্রী সরকারি স্কুলে পড়ে। কিন্তু, পাশাপাশি এটাও সত্য যে, প্রাইভেট টিউশনের মাত্রায় এ রাজ্য প্রথম। স্কুলের পরিসরে শিক্ষা অর্জনের ব্যাপারে ছাত্রছাত্রী, তাদের মা-বাবা, শিক্ষা দফতর ও শিক্ষক সম্প্রদায় এতটাই সন্দিহান যে, ‘প্রাইভেট টিউশন না দিলে লেখাপড়া হবে না’— এই বিশ্বাস লোকেদের মাথায় শিকড় গেড়ে বসে যায়। এর মধ্যে আমরা কোন বিষয়ে ফার্স্ট হওয়াকে মাপকাঠি মানব?
উল্টো দিকে, অভিযোগের দিক দিয়ে দেখলে যে সত্যগুলো শিক্ষা সম্পর্কিত আলোচনাকে পরিচালিত করে তা হল শিক্ষক নিয়োগ, তাতে দুর্নীতি, অন্যান্য পরিকাঠামোগত ব্যাপার, স্কুলছুট, এবং সরকারি স্কুল উঠে যাওয়ার আশঙ্কা। কিন্তু, স্কুল কেন ছাত্রছাত্রীদের কাছে আকর্ষণীয় হয়নি, এই প্রশ্নটি ওঠেই না। যে কোনও দিনে রাজ্যের স্কুলগুলোর গড় ছাত্রছাত্রী হাজিরার অঙ্ক ৬০-৭০ শতাংশের উপরে ওঠে না। কেন? নানা মুখস্থ করা উত্তর আছে: মা-বাবা অসচেতন, ছোট ভাইবোনদের দেখার জন্য বাড়িতে থাকে, ছাগল চরায়, ইত্যাদি। কিন্তু, তা হলে তো সাধারণ ভাবে সব স্কুলেই এগুলো ঘটবার কথা। অথচ, এমন অনেক ব্যতিক্রমী স্কুল আমাদের দেখার সৌভাগ্য হয়েছে, যেখানে রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করেও নব্বই শতাংশ ছাত্রছাত্রী হাজির থাকে। এ-সব স্কুলের শিশুদের বাড়িতেও নিরক্ষর মা-বাবা, ছোট ভাই-বোন, চরানোর মতো ছাগল আছে। তবু, স্কুলের টান এমন যে, মা-বাবাদের উচ্ছ্বাস: “বাচ্চারা স্কুল থেকে বাড়ি ফিরতে চায় না।” এই যে বাচ্চারা বাড়ি ফিরতে চায় না, এর সঙ্গে শিক্ষার অর্জনের বড় যোগ আছে: প্রথমত তারা শিক্ষা বিভাগের ঠিক করে দেওয়া পাঠ্য বিষয়ের বাইরে নানা জিনিস করতে করতে শেখে। এর মধ্যে পড়ে, বিশ্ব-প্রকৃতিকে চেনা, স্বাস্থ্য বিষয়ক অনুশীলন, খেলাধুলা, পরোপকার, সমাজের সমস্যা সমাধানে যোগদান ইত্যাদি।
ব্যতিক্রমী এই স্কুলগুলোতে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে শিক্ষাগত সামর্থ্য যেমন বিস্মিত করে, তেমনই আনন্দিত করে তাদের মধ্যে ‘প্রাইভেট টিউশন না হলে লেখাপড়া হবে না’, এই বোধ জন্মাতে না পারা। এই স্কুলগুলোতে অগ্রগতির কাহিনিগুলো আলাদা আলাদা, কোথাও একক কোনও শিক্ষকের হাত ধরে, কোথাও কয়েক জনের মিলিত চেষ্টায়, আবার কোথাও স্থানীয় কোনও উদ্যোগীর সহযোগিতায়। কিন্তু, সর্বত্রই যে জিনিসটার উপর জোর পড়েছে, তা হল হাজিরা। এক শিক্ষকের কথায়, “আমরা যদি এক জন বাচ্চাকে দিনে চার-পাঁচ ঘণ্টা পাই, এবং রোজ রোজ পাই, তা হলে সে কিছু শিখবে না, এটা হতেই পারে না।” অথচ, শিক্ষা-বিবাদে এই হাজিরার ব্যাপারটি আদৌ গুরুত্ব পায় না।
এটা ঠিক যে, ব্যতিক্রমী স্কুলগুলোর কর্মপ্রক্রিয়া ব্যতিক্রমীই, সকলের পক্ষে এ ভাবে কাজ করার মতো মানসিক ও বাস্তবিক সামর্থ্য নেই। কিন্তু, তাদের কাছ থেকে সকলেরই যেটা শিখবার আছে, তা হল পরিবর্তনের সম্ভবপরতা। যে সরকারি কর্তা মনে করেন, প্রাইভেট টিউশন সমাজের অঙ্গ হয়ে গেছে, একে দূর করা যাবে না, বা যে শিক্ষাকর্মী মনে করেন, সকলের বিদ্যা হয় না, কারও কারও হয়, কিংবা, যে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় মনে করেন প্রাইভেট স্কুলই একমাত্র উপায়, তাঁরা প্রত্যেকেই এই স্কুলগুলোর কাছ থেকে শিখতে পারেন যে, অবস্থাটা যত খারাপই হোক না কেন, একে বদলানো সম্ভব।
দ্বিতীয়, যে জিনিসটা এই স্কুলগুলোর কাছ থেকে শেখার আছে তা হল, শিক্ষা কেবল আইনি অধিকার নয়, শিক্ষার অধিকার জন্মগত। তাই কোন শিশু কোন পরিবারে জন্মেছে, শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে সেটা আদৌ বিবেচ্য নয়। স্কুলের ধারণার মধ্যেই আছে সমতার সন্ধান। স্কুলের পরিবার, পরিবেশ, জন্মজাত সামর্থ্য, ইত্যাদি পার্থক্যগুলো মুছে দেওয়ার প্রয়াস স্কুলের অন্যতম কর্তব্য। ব্যতিক্রমী স্কুলগুলোর উদ্যোক্তারা এই দিকটাকে প্রাথমিক স্বীকৃতি দেন, যার ক্রমে প্রথম স্কুলে আসা একাকী, নির্বাক, মনোযোগ-হারা শিশুটিও সকলের সঙ্গে মিলেমিশে নিজের ব্যক্তিত্বকে আবিষ্কার করতে শেখে। আবার, এই স্বীকৃতি থেকে আসে শিক্ষার সর্বব্যাপী ধারণা, যা স্কুলের দেওয়াল, মাঠ, শৌচালয়, রান্নাঘর থেকে শুরু করে মিড-ডে মিল খাওয়া, খেলা, গান গাওয়া, ছবি আঁকা, সব কিছুর মধ্যে পরিস্ফুট। এটা অর্জন করা খুব কঠিন নয়। সমস্যা হচ্ছে, অনেকেই এগুলোকে শিক্ষার কাজ বলে মনেই করেন না। তা যদি মনে করতেন তা হলে রাজ্যের বহু স্কুলের দেওয়ালগুলো ভুল বানানে লেখা বাণী বা বিজ্ঞপ্তিতে ভরা থাকত না। ভুলগুলো দেখিয়ে দিলে অজুহাত শোনা যায়, “আমরা তো ঠিক লিখে দিয়েছিলাম, আর্টিস্ট গোলমাল করে গেছে।” অনেক জায়গায় শুনেছি, “এগুলো কেউ দেখে না, আপনারা প্রথম বললেন!” অন্তত, সহজে পরিহার করা যায় এমন ভুলগুলো এড়াতে তো পারি! ছাত্রছাত্রীদের চোখ তো এই ভুলগুলোতেই অভ্যস্ত হয়ে যায়, এবং স্কুলশিক্ষা অর্জিত হোক বা না হোক, ‘এগুলো কোনও ব্যাপার নয়’— এই শিক্ষাটি তাদের ভবিষ্যৎ জীবনের ‘সম্পদ’ হয়ে ওঠে।
বানানের উদাহরণটি আমাদের একটি বড় সমস্যাকে তুলে ধরে, তা হল জবাবদিহির সমস্যা। ছাত্রছাত্রীদের ভুল শেখানো হচ্ছে, অথচ দিনের পর দিন তা কারও চোখে পড়ে না, এটা যেমন একটা ‘তুচ্ছ ব্যাপার’, তেমনই দিনের পর দিন স্কুলে এসে, এবং না এসে, ছাত্রছাত্রীদের বিরাট এক অংশ লেখাপড়া শিখতে পারছে না, সেটাও একটা ‘ছোট ঘটনা’ হয়ে থাকছে। শুধু তা-ই নয়, তারা বড় হয়ে উঠছে এক নিকৃষ্টতর প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে, যেখানে ফাঁকিই জীবনের ধন।
এই পর্যন্ত পড়ে কর্তাব্যক্তিরা সোল্লাসে বলবেন, এই তো, আমরা তো এটাই বলছি, মাস্টাররা পড়ায় না! সবিনয়ে প্রশ্ন করব, শিক্ষার দায়িত্ব কেবল শিক্ষকের? এ-দায়িত্ব তো গোটা শিক্ষা দফতরের, পরিদর্শক থেকে মন্ত্রী পর্যন্ত প্রত্যেকের। সে-দায়িত্ব কি দফতর স্বীকার করে? দফতরের থেকে ভাল ভাবে কে জানে যে, রাজ্যে গড় ছাত্রছাত্রী হাজিরার হার এত কম? জেনেও, দফতর কি হাজিরা বাড়ানোর জন্য কিছু করেছে? এই সহস্রাব্দের গোড়ায়, পিইউসিএল-এর করা মামলার পরিপ্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের উপর ভিত্তি করে সারা দেশে সরকারি স্কুলগুলোতে রান্না করা খাবার, বা মিড-ডে মিল, হাজিরার হারে কিছু উন্নতি ঘটায়, কিন্তু সেটা কিছুটাই। এবং, মিড-ডে মিল তো হাজিরা বাড়াবার উপকরণ নয়, বাচ্চাদের হকের খাবারের প্রশ্ন। স্কুলের হাজিরা যদি প্রকৃতই বাড়াতে হয়, তা হলে স্কুলকে ছাত্রছাত্রীদের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলতে হবে।
ব্যতিক্রমী স্কুলগুলোতে যেটা সম্ভব হয়েছে, সমস্ত স্কুলে সেটা সম্ভব করা নিয়ে ভাবতে গেলে, দুটো জিনিস মাথায় না রাখলেই নয়। এক, প্রত্যেকের জবাবদিহি: ছাত্রছাত্রীরা পাঁচ বছর বা আট বছর স্কুলে কাটানোর পরও যদি তাদের শিক্ষাগত অর্জনে ঘাটতি থাকে, তার দায়িত্ব কেবল শিক্ষক বা মা-বাবাদের উপর চাপালে চলবে না। গোটা শিক্ষা দফতরকেই এই ব্যর্থতার দায় স্বীকার করতে হবে। দুই, পরিকল্পনাগুলোকে উঠে আসতে হবে স্কুল-স্তর থেকে: প্রতিটি স্কুলকে নিজের মতো পরিকল্পনা করার স্বাধীনতা দিতে হবে, এবং তাদের প্রয়োজনমতো সংসাধনের ব্যবস্থা করতে হবে। এমন অনেক শিক্ষক আছেন, যাঁরা দফতরের প্রতাপের কাছে নিজেদের উদ্ভাবনী শক্তিকে কুলুঙ্গিতে তুলে রাখেন। দফতরে টাকার ঘাটতি আছে, কিন্তু সরকার বনিয়াদি স্তর থেকে পরিকল্পনার স্বাধীনতা দেওয়ার ঝুঁকি নিতে রাজি থাকলে আর্থিক সমস্যাটিও খুব বড় বাধা না-ও হয়ে উঠতে পারে।
সরকারকে যদি এই ভাবে ভাবাতে হয়, তা হলে সমাজকেও তার জবাবদিহির দায় স্বীকার করতে হবে, এবং দায়িত্ব নিতে হবে। যার পক্ষে যতটুকু করা সম্ভব সেটুকু না করে কেবল সরকারের শুভেচ্ছা-জাগরণের অপেক্ষায় থাকলে বিঘত পরিমাণ দূরত্বও অতিক্রম করা যাবে না। ডিমের জন্য মুরগি যেমন দরকারি, তেমনই ডিম ছাড়া মুরগিও পাওয়া যায় না। ডিম ও মুরগি দুটোর কথা এক সঙ্গেই ভাবতে হবে।