লক্ষ্মীর ভান্ডারের মহিমা এবং তৃণমূল কংগ্রেসের ভোটবাক্স
Lakshmir Bhandar Scheme

কাল ও পরশুর চিন্তা

নির্বাচনী সাফল্যের কারণ একাধিক হতে পারে। তার মধ্যে ঠিক কোনটি সাফল্য এনে দিয়েছে, নিশ্চিত করে বলা কঠিন। তৃণমূল একটি নয়, অনেক জনহিতকর প্রকল্প চালু করেছে।

Advertisement
অশোক কুমার লাহিড়ী
শেষ আপডেট: ০১ জুলাই ২০২৪ ০৯:১৩
ক্ষমতায়ন: নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামে লক্ষ্মীর ভান্ডার প্রাপকদের সমাবেশ। ৫ মে ২০২২।

ক্ষমতায়ন: নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামে লক্ষ্মীর ভান্ডার প্রাপকদের সমাবেশ। ৫ মে ২০২২।

লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের বিপুল জয়ে শাসক দলের উল্লাস এবং বিরোধীপক্ষের বিষাদ এত দিনে একটু স্তিমিত হয়েছে। এখন হয়তো তৃণমূলের বিজয়ে লক্ষ্মীর ভান্ডারের সম্ভাব্য অবদান বিশ্লেষণ শুরু করা যেতে পারে। কথায় বলে, ‘বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী’— তবে পশ্চিমবঙ্গে তার বেশি হদিস মেলে না রাস্তা-ঘাটে; অথবা ছোটবেলা থেকে দেখে আসা চুনিবাবু বাজারের বানোয়ারির রংচটা মুদির দোকানে। কিন্তু বাঙালির বাণিজ্যে যদি লক্ষ্মীর বসত না-ও হয়, রাজনীতির ক্ষেত্রে কি পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস এবং তার নেত্রী লক্ষ্মীর ভান্ডারের চমৎকারিত্ব দিয়েই মা লক্ষ্মীর কৃপাকে ভোটবাক্সে বন্দি করে ফেলেছেন?

Advertisement

লক্ষ্মীর ভান্ডার প্রকল্প চালু হয়েছিল ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে— বিধানসভা নির্বাচনের ঠিক আগে-আগে। যাঁদের স্বাস্থ্যসাথী কার্ড আছে, ২৫ থেকে ৬০ বছর বয়সি এমন সব বিবাহিত মহিলা এই প্রকল্পের প্রাপক— তাঁদের মধ্যে তফসিলি জাতি ও জনজাতিভুক্ত মহিলাদের ক্ষেত্রে মাসিক ১,০০০ টাকা, এবং অন্যদের ক্ষেত্রে মাসিক ৫০০ টাকা দেওয়া শুরু হয়। এই লোকসভা নির্বাচনের ঠিক আগে বাড়ল প্রকল্পে প্রাপ্তির পরিমাণ— তফসিলি জাতি ও জনজাতির ক্ষেত্রে মাসিক প্রাপ্তি দাঁড়াল ১,২০০ টাকা; এবং অন্যদের মাসিক ১,০০০ টাকা। এই লক্ষ্মীর ভান্ডারের ফলে কী ভাবে মহিলাদের ক্ষমতায়ন হবে, এবং বর্ধিত চাহিদার জন্য চাল, ডাল, গামছার, এমনকি চপ শিল্প এবং কাশফুলের বালাপোশের বিক্রি বাড়বে, সে সব কথা তৃণমূল নেতারা উচ্চৈঃস্বরে প্রচার করেছেন, এবং পশ্চিমবঙ্গের মানুষ ওঁদের এই লক্ষ্মীর ভান্ডারের সিদ্ধান্তের জন্য মুক্তহস্তে ভোটের জয়মাল্য দিয়ে বরণ করেছেন। নির্বাচনের ঠিক আগেই প্রকল্প ঘোষণা বা তার বরাদ্দ বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নিছক কাকতালীয়, তা বিশ্বাস করা কঠিন।

নির্বাচনী সাফল্যের কারণ একাধিক হতে পারে। তার মধ্যে ঠিক কোনটি সাফল্য এনে দিয়েছে, নিশ্চিত করে বলা কঠিন। তৃণমূল একটি নয়, অনেক জনহিতকর প্রকল্প চালু করেছে। এক দিকে লক্ষ্মীর ভান্ডারের মাধ্যমে মহিলাদের সাহায্য এবং ক্ষমতায়ন, আর তার সঙ্গে ছিল দুয়ারে সরকার, সবুজ সাথী, কন্যাশ্রী, গীতাঞ্জলি, এবং আরও অনেক জনকল্যাণমূলক প্রকল্প। তবে, সমস্ত প্রকল্পের মধ্যে ভোটের পুঁজি হিসেবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল লক্ষ্মীর ভান্ডার।

এই প্রকল্পের বৈশিষ্ট্য হল সর্বজনীন শর্তহীন নগদ টাকা হস্তান্তর। প্রথমে প্রকল্পটি টার্গেটেড, অর্থাৎ শুধুমাত্র গরিবদের জন্য ভাবা হয়েছিল। কিন্তু, কে গরিব আর কে বড়লোক সেটা নির্ধারণ করার ব্যবহারিক অসুবিধার কারণে— এবং হয়তো ভোটের রাজনীতিতে প্রকল্পটিকে কার্যকর করার জন্য— যাঁদের স্বাস্থ্যসাথী কার্ড আছে, ২৫ থেকে ৬০ বছর বয়সি এমন সব বিবাহিত মহিলাকে এই প্রকল্পের আওতায় আনা হয়। শর্তহীন নগদ টাকায় লভ্যার্থীরা নিশ্চয়ই খুশি। শর্ত থাকলে যা করতে হত, তা তো ওঁরা করতেই পারেন— কিন্তু তা ব্যতিরেকে অন্য কিছুও করতে পারেন। বীরভূমের নলহাটির ছেলে মাহফুজ আলম, বাবার সঙ্গে চায়ের দোকান সামলে, মায়ের লক্ষ্মীর ভান্ডারের টাকায় নেট রিচার্জ করে এবং রাতে পড়াশোনা করে মেডিক্যাল প্রবেশিকায় ভাল ফল করেছে, এই খবরে আমরা সবাই আহ্লাদিত হয়েছি। তবে এ রকম সুখবর ব্যতিক্রমী কি না, জানা দরকার।

২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল শুধু লক্ষ্মীর ভান্ডার চালু করার কৃতিত্বই যথাযথ ভাবে দাবি করেনি, একই সঙ্গে এই ভীতিরও সঞ্চার করেছে যে, ভারতীয় জনতা পার্টি ক্ষমতায় এলে লক্ষ্মীর ভান্ডার বন্ধ হয়ে যাবে। বিজেপির এই গোপন অভিসন্ধি ওরা কী ভাবে আবিষ্কার করল, সেটি একটি রহস্য। এমন একটি আপাত-জনহিতকর এবং জনপ্রিয় প্রকল্প এক বার চালু হলে সেটি বন্ধ করা যে কোনও রাজনৈতিক দলের জন্য শুধু কঠিন নয়, আত্মহত্যার সমতুল। তা ছাড়া, তৃণমূল কংগ্রেস ভাল ভাবেই জানে যে, লোকসভা নির্বাচনে কেন্দ্রে জয়ী সরকার রাজ্যের কোনও প্রকল্প বন্ধ করতে পারে না। মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচনে ‘খেলা হবে’, ‘খেলা হবে’ বলতে ভালবাসেন। ২০২৪-এর নির্বাচন যদি ফুটবল খেলা হয়, এবং তৃণমূল যদি হয় ১৯৫৮ সালের ব্রাজ়িলের ফুটবল টিম, তবে লক্ষ্মীর ভান্ডার ছিল সে দলের পেলে। বিজেপি জয়ী হলে লক্ষ্মীর ভান্ডার বন্ধ হয়ে যাবে, এই প্রচার ছিল পেলের ড্রিবলিং, জনতার জন্য বিভ্রান্তির মায়াজাল।

শুধু নারীদের জন্য প্রযোজ্য লক্ষ্মীর ভান্ডারের মতো সর্বজনীন শর্তহীন নগদ হস্তান্তর প্রকল্প চালু করায় ভারতে পশ্চিমবঙ্গই প্রথম। এর সুবিধা পান ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবাই, এবং এই টাকার ব্যবহারে কোনও সীমাবদ্ধতা নেই। এর অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক উপকারিতা উপলব্ধি করেই হয়তো মধ্যপ্রদেশে মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিংহ চৌহান ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে ‘লাডলি বহেন’ যোজনা, এবং সেপ্টেম্বরে তামিলনাড়ুতে মুখ্যমন্ত্রী স্ট্যালিন ‘কালাইগনার মাগালির উড়িমাই ঠগাই থিত্তম না’ প্রকল্প চালু করেন।

প্রশ্ন হচ্ছে, দেশে তো ২৮টি রাজ্য আছে— তা হলে শুধু তিন-চারটি রাজ্যই কেন এই সুবুদ্ধিসম্পন্ন প্রকল্প চালু করল? সবাই কেন লক্ষ্মীর ভান্ডারের মতো জনহিতকর এবং জনপ্রিয় প্রকল্প চালু করছে না? আর, হাজার-বারোশো টাকায় যদি এত লাভ, তবে এটা বাড়িয়ে পাঁচ, সাত বা দশ হাজার করতে কী অসুবিধা? এর উত্তর নিহিত আছে তিনটি বিষয়ে। প্রথমত, প্রায় সবাই একমত যে, দারিদ্রের জন্য শর্তহীন নগদ টাকা অনুদানের একান্ত প্রয়োজন আছে— কিন্তু তার সঙ্গে আছে গরিব-বড়লোক নির্ধারণ করার ব্যবহারিক সমস্যা। সবাইকে দিতে গেলে খরচ অনেক। প্রয়োজনের তুলনায় রাজ্যগুলির আর্থিক সঙ্গতি সীমিত। এই সীমিত সঙ্গতিতে অনেক প্রতিশ্রুতি দিলে করতে হয় ক্রিয়েটিভ অ্যাকাউন্টিং বা সৃজনশীল হিসাব, এবং প্রকল্পের জন্য অপ্রতুল অর্থবরাদ্দ। অনেকের মতে, পশ্চিমবঙ্গে লক্ষ্মীর ভান্ডারে তা-ই হচ্ছে। লক্ষ্মীর ভান্ডারে লভ্যার্থীর সংখ্যা ২ কোটি ১১ লক্ষের বেশি। মাসে গড়ে ১,০০০ টাকা করে দিলেও, লক্ষ্মীর ভান্ডারের জন্য প্রয়োজন বছরে ২৫,৩২০ কোটি টাকা। কিন্তু, কোনও রহস্যময় কারণে চলতি বছরের বাজেটে লক্ষ্মীর ভান্ডারের বরাদ্দ দেখানো হয়েছে মাত্র ১৪,৪০০ কোটি টাকা!

দ্বিতীয়ত, লক্ষ্মীর ভান্ডারের মতো শর্তহীন নগদ অনুদানের ফলে চাহিদা বাড়বে ঠিকই, কিন্তু এই বর্ধিত চাহিদা মিটবে কোথা থেকে? যে রাজ্য অনুদান দিচ্ছে তারই উৎপাদন থেকে, না কি দেশের বিভিন্ন উন্নত প্রদেশের শিল্পপণ্য এনে চাহিদা মেটানো হবে? অনুন্নত অঞ্চলের সমস্যা হয়তো অপর্যাপ্ত চাহিদার থেকে বেশি অপর্যাপ্ত জোগানের। বীরভূমের নলহাটির যে মাহফুজ মেডিক্যাল প্রবেশিকায় ভাল ফল করেছে, সে যে ফোন বা কম্পিউটারটি কিনেছিল, সেটি কি পশ্চিমবঙ্গে নির্মিত, না অন্য রাজ্য থেকে এনে এখানে বিক্রি করা? পশ্চিমবঙ্গ যে রাজ্যের চাহিদা মেটাতে অনেক শিল্পপণ্য অন্যান্য প্রদেশ থেকে আমদানি করে, জিএসটি ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর সেটা পরিষ্কার হয়ে গেছে। চাহিদার তুলনায় রাজ্যে যথেষ্ট উৎপাদন হলে অন্য প্রদেশ থেকে এত শিল্পপণ্য পশ্চিমবঙ্গে আসত না। লক্ষ্মীর ভান্ডারের সঙ্গে উৎপাদন বাড়ানোর কোনও আপাত-বিরোধ না থাকলেও, সমস্যা হচ্ছে রাজ্যের আর্থিক সঙ্গতির। লক্ষ্মীর ভান্ডারের অতিরিক্ত অর্থ জোগাতে রাস্তা-ঘাট, ব্রিজ, এবং শিল্পায়নের অন্যান্য মৌলিক পরিকাঠামো সরবরাহের পয়সা থাকবে তো?

তৃতীয়ত, দরিদ্র মানুষ শুধু জমিদারবাবুর বাড়িতে হরিনাম সঙ্কীর্তনের পর পঙ্‌ক্তিভোজনে পূর্ণিমার দিন খিচুড়ি আর চচ্চড়ি খেতে চান না। দরিদ্র মানুষও চান নিজের পায়ে দাঁড়াতে, পরিবারের জন্য স্বাস্থ্য পরিষেবা, ছেলেমেয়েদের জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা করতে। তাই প্রয়োজন আজকের দরিদ্রের কষ্ট ঘোচানোর পাশাপাশি কালকের দারিদ্রকে সমূলে উৎখাত করার। মসনদে যে দল আছে, তারা চেষ্টা করবে আজকের সমস্যায় মলম লাগিয়ে আসন্ন নির্বাচনে আবার মসনদে ফেরার। কিন্তু, আজকের পরে একটা কাল আর পরশু আছে— রাজনীতির ময়দানে নেতাদের কাল আর পরশুও জনতার প্রশ্নের সম্মুখীন হতেই হবে। কিন্তু, অত দূরের কথা ভাবার সময় জনবাদী রাজনীতিকদের কোথায়?

আরও পড়ুন
Advertisement