Society

এক দুঃসাহসী বাঙালিনি

লেখিকা অনুরূপা দেবী থেকে সুকুমার সেন সকলেই একমত কৃষ্ণকামিনীই প্রথম লেখিকা যাঁর কাব্যগ্রন্থ প্রথম বাংলায় মুদ্রিত আকারে প্রকাশিত হয়।

Advertisement
বিতস্তা ঘোষাল
শেষ আপডেট: ২৩ ডিসেম্বর ২০২৩ ০৮:০৪

—ফাইল চিত্র।

উনিশ শতকের গোড়ায় বাংলার সাধারণ পরিবারে মেয়েদের বিদ্যাশিক্ষার ব্যবস্থা ছিল না। যদিও রেনেসাঁসের প্রভাবে খুব অল্প মাত্রায় স্ত্রীশিক্ষার সূচনা হয়েছিল, কলকাতা ও আশেপাশে কয়েকটি বালিকা বিদ্যালয়ও গড়ে উঠছিল। ফলে মিশনারিদের পাশাপাশি রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, ভগিনী নিবেদিতা, বেথুন সাহেব, আলেকজ়ান্ডার ডাফ প্রমুখের উৎসাহে কিছু নারী শিক্ষার সুযোগ পেয়ে সাহিত্য সাধনায় এসেছিলেন। সংবাদ প্রভাকরসম্বাদ কৌমুদী-তে প্রকাশিত কবিতা ও প্রবন্ধ এ ধরনের সাধনার প্রমাণ। লেখাগুলোতে সাধারণত লেখিকার নামের বদলে পরিচয়জ্ঞাপক অন্য কথা যেমন ‘বরানগরবাসিনী বিরহিণী’, ‘বৃদ্ধা ব্রাহ্মণী’, ‘স্ত্রী’, অমুক দেবী ইত্যাদি থাকত। অনেকেই মনে করতেন কোনও পুরুষ নারীর নামে লিখছেন।

Advertisement

“হায় কত কালের পর এদেশ পণ্ডিতময় হইবে, স্ত্রীলোকেরা গ্রন্থকর্ত্তা হইবে, ...আমাদিগের আশা পরিপূর্ণ হইবে।”— ভারতবর্ষীয় স্ত্রীগণের বিদ্যাশিক্ষা-য় প্রশ্ন তুলেছিলেন তারাশঙ্কর তর্করত্ন। কিন্তু তাঁকে বা শিক্ষিত বাঙালি সমাজকে বেশি অপেক্ষা করতে হয়নি। ১৮৫৬-য় প্রকাশিত হল নাতিদীর্ঘ কাব্যগ্রন্থ— চিত্তবিলাসিনী; লেখিকা হুগলি জেলার বলাগড় অঞ্চলের মিত্র মুস্তৌফী পরিবারের গৃহবধূ কৃষ্ণকামিনী দাসী।

কেন তাঁর নাম বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য, বলার আগে দেখা যাক সেই সময় দেশে নারীর অবস্থান। বাল্যবিবাহ, কুপ্রথা, সহমরণ, বিধবাদের তীর্থস্থানে আশ্রয় নিতে বাধ্য করা, পড়াশোনা আটকাতে একাধিক কুসংস্কার আশৈশব মেয়েদের মাথায় ঢোকানো, নারীকে সর্বতো ভাবে গৃহে বন্দি রাখা— এই ছিল কয়েক শতাব্দীর সমাজ। উনিশ শতকে আমরা সংবাদ প্রভাকর-এর মাধ্যমে মেয়েদের লেখা পেতে শুরু করি। যদিও সেগুলো পুরুষ না নারীর, বিতর্ক রয়েছে।

লেখিকা অনুরূপা দেবী থেকে সুকুমার সেন সকলেই একমত কৃষ্ণকামিনীই প্রথম লেখিকা যাঁর কাব্যগ্রন্থ প্রথম বাংলায় মুদ্রিত আকারে প্রকাশিত হয়। ভূমিকায় লেখিকা তাঁর এই দুঃসাহসী প্রচেষ্টা সম্পর্কে বলেন, “অদ্যাপি অস্মদেশীয় মহিলাগণের কোন পুস্তকই প্রচারিত হয় নাই, সুতরাং প্রথম। এ বিষয়ে হস্তার্পণ করা কেবল লোকের হাস্যাস্পদ হওয়া মাত্র, কিন্তু আমার অন্তঃকরণে যথেষ্ট সাহস জন্মিতেছে যে সামাজিক মহাশয়েরা আপাততঃ স্ত্রীলোকের রচনা শুনিলেই বোধ হয় যৎপরোনাস্তি সন্তুষ্ট হইবেন, আর আমার পুস্তক রচনা করিবার এই এক প্রধান উদ্দেশ্য যে উৎকৃষ্ট হউক বা অপকৃষ্ট একটা দৃষ্টান্ত পাইলে স্ত্রীলোক মাত্রেই বিদ্যানুশীলনে অনুরাগী হইবে, তাহা হইলেই এ দেশের গৌরবের আর পরিসীমা থাকিবেক না...।”

এই আশা ও বিশ্বাস যে মিথ্যে ছিল না তার প্রমাণ ১৮৬১ থেকে ১৮৬৬-র মধ্যে আরও সাত জন লেখিকার আবির্ভাবে। বামাসুন্দরী দেবী, হরকুমারী দেবী, কৈলাসবাসিনী দেবী, মার্থা সৌদামিনী সিংহ, কোনও সদ্বংশীয়া কুলবধূ (রাখালমণি গুপ্ত), কামিনীসুন্দরী দেবী ও বসন্তকুমারী দাসী। বঙ্গের শিক্ষাধিকারিকের রিপোর্টে আছে যে চিত্তবিলাসিনী-র সব মুদ্রিত কপি নিঃশেষিত, শিক্ষাকর্তাও কোনও কপি সংগ্রহ করতে পারেননি।

কাব্যগ্রন্থে কৃষ্ণকামিনী দেবী পয়ার ছন্দে কবিতায় লিখেছেন শ্বশুরকুলের কথা। বাপের বাড়ির প্রসঙ্গ আসেনি। জানিয়েছেন— “...এই ক্ষুদ্র পুস্তক রচনার সময় আমার প্রাণবল্লভ যথেষ্ট সাহায্য করিয়াছেন এবং তিনি এ-বিষয়ে মনোযোগী না হইলে কেবল আমা হইতে ইহা সম্পন্ন হইবার কোন প্রকার সম্ভাবনা ছিল না।”

অন্তঃপুরবাসিনী গৃহবধূ, আগ্রহ থাকলেও প্রতিকূল পরিবেশে শিক্ষার উদার সুযোগ পাননি এবং দেখার চোখ থাকলেও প্রচলিত ‘অবরোধ প্রথা’র কারণে পরিচিতির জগৎ সীমাবদ্ধ ছিল। তবুও চিত্তবিলাসিনী বিষয়বস্তুর গৌরবে ও রচনার আঙ্গিকের বৈচিত্রে অসাধারণ। গদ্য রচনাতেই তিনি দক্ষ। তবুও কবিতার শরণ নিয়েছেন, কারণ জানিয়েছেন ছন্দে লিখলে পাঠকের মনে বেশি স্থায়ী হতে পারে। কাব্যগ্রন্থটিতে বহুবিবাহ, কৌলীন্য প্রথার বিরোধিতা করেছেন। পয়ার, ত্রিপদী, লঘু ত্রিপদী, পয়ার-মিশ্র ত্রিপদী, একাবলী ও দীর্ঘ ললিত ছন্দ, মালতী ছন্দ ব্যবহার করেছেন। গদ্য রচনা, গদ্য-পদ্য মিশ্রণে নাট্য-সংলাপ এবং ‘ডায়ালগ’ও ব্যবহার করেছেন। বিধবাবিবাহ আইন পাশ তাঁর মনে কী আলোড়ন তুলেছিল তার প্রকাশ ঈশ্বরচন্দ্রের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদনে।

“সৌদামিনী। হেঁ লো, এমন গুণমণি গুণের সাগর কে আছে যে আমাদের দুখের দুখী হয়ে এ কাণ্ড কল্লে।

মাতঙ্গিনী। শুনিচি নাকি সে গুণের সাগরের নাম বিদ্যাসাগর...।”

বালিকাবধূর স্বামী বিরহে একাকী জীবনের কারণ যে বল্লালী কৌলীন্য প্রথা— এ কথা পুরুষশাসিত সমাজে বাস করেও নির্ভয়ে প্রকাশ করেছেন। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত ১৮৫৬-র ২৮ নভেম্বর সংবাদ প্রভাকর-এ লিখলেন: “...অঙ্গনাগনের বিদ্যানুশীলন বিষয়ে যে সুপ্রণালী এদেশে প্রচলিতা হইতেছে, তাহার ফল স্বরূপ এই গ্রন্থ,... অবলাগণ বিদ্যানুশীলন পূর্ব্বক অবনী মণ্ডলে প্রতিষ্ঠিতা হয়েন ইহাই আমারদিগের প্রার্থনা।”

প্রথম মহিলা লেখিকা কৃষ্ণকামিনী দেবীর জন্ম বা মৃত্যুদিন— সময়ের সেই হিসাবপত্র জানা না গেলেও, তাঁর প্রচেষ্টা আজও প্রাসঙ্গিক, প্রতি দিন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
আরও পড়ুন
Advertisement