উদার বাণিজ্যে সরকারের হঠাৎ আগ্রহ মানুষের স্বার্থবিরোধী
Free Trade

দুই বাণিজ্য নীতির গল্প

২০১৪ সালে এনডিএ সরকার যখন ক্ষমতায় এল, প্রাথমিক ভাবে কিন্তু উদার বাণিজ্য চুক্তি-বিরোধী কোনও অবস্থান চোখে পড়েনি।

Advertisement
বিশ্বজিৎ ধর
শেষ আপডেট: ১৪ মে ২০২৪ ০৮:১৮

—প্রতীকী ছবি।

এনডিএ সরকারের শাসনের এক দশকে ভারত সরকারের বাণিজ্যনীতি প্রকৃত পক্ষে দ্বিপাক্ষিক উদার বাণিজ্য চুক্তির (বাইল্যাটারাল ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট) দু’টি বিপরীত পর্বের গল্প। প্রথম দফায় ক্ষমতায় আসার পর সরকারের অবস্থান ছিল স্পষ্টতই বাণিজ্য চুক্তি-বিরোধী। সে সময় তিনটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি কার্যকর হওয়ার প্রক্রিয়া চলছিল— প্রথম চুক্তিটি দশটি দেশের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব সাউথ-ইস্ট এশিয়ান নেশনস-এর (আসিয়ান) সঙ্গে, অন্য দু’টি যথাক্রমে দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের সঙ্গে। এনডিএ সরকার ক্ষমতায় এসেই সেগুলো পুনর্বিবেচনার সিদ্ধান্ত নিল— বলল, এই চুক্তিগুলি করার সময় ইউপিএ সরকার জাতীয় স্বার্থের কথা যথেষ্ট ভাবেনি।

Advertisement

এনডিএ সরকারের বৈদেশিক বাণিজ্য নীতির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সিদ্ধান্ত সম্ভবত দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় আসার কয়েক মাসের মধ্যেই পূর্ব এশিয়ার অতিবৃহৎ বাণিজ্য চুক্তি— রিজনাল কমপ্রিহেনসিভ ইকনমিক পার্টনারশিপ (আরসিইপি) থেকে সরে দাঁড়ানো। অতিমারি ও লকডাউন-জনিত আর্থিক ধাক্কায় ভারতের ‘একলা চলো’ নীতি আরও জোরদার হল— সরকার ‘আত্মনির্ভর ভারত’ প্রকল্প রূপায়ণ করল। যেন উদারীকরণ-পূর্ব সময়ে ফিরে যাওয়া: প্রোডাকশন লিঙ্কড ইনসেনটিভ-এর (পিএলআই) মাধ্যমে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ শিল্পক্ষেত্রে আর্থিক প্রণোদনা দিয়ে উৎপাদন বাড়ানো ও আমদানি কমানোয় জোর দেওয়া হল।

কিন্তু, কোভিড-পরবর্তী পর্যায়ে অর্থব্যবস্থার স্বাস্থ্য ফিরতেই সরকার মত পাল্টে ফেলল— আগে যে প্রাবল্যে বাণিজ্য চুক্তি-বিরোধী অবস্থান নিয়েছিল, এই পর্যায়ে ঠিক ততটাই এই চুক্তির সমর্থক হয়ে উঠল। ঘোষণা হল যে, ভারত আটটি দেশ বা অঞ্চলের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যিক চুক্তি রূপায়ণের জন্য আলোচনা চালাচ্ছে। তার মধ্যে এমন চুক্তিও আছে, যেগুলো নিয়ে ২০১৪ সালের আগে, ইউপিএ জমানাতেই আলোচনা আরম্ভ হয়েছিল, এবং বিজেপি ক্ষমতায় এসে যে আলোচনা থামিয়ে দেয়। এনডিএ-র বৈদেশিক বাণিজ্য নীতির এই উদারবাদী পর্বে এখনও অবধি দু’টি চুক্তি রূপায়িত হয়েছে— একটি সংযুক্ত আরব আমিরশাহির সঙ্গে, অন্যটি সুইৎজ়ারল্যান্ড, নরওয়ে, লিখটেনস্টাইন ও আইসল্যান্ডের সঙ্গে, যে দেশগুলি ইউরোপিয়ান ফ্রি ট্রেড অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য। সরকার শুধু চুক্তিই করেনি, ভারতের স্বার্থরক্ষা বিষয়েও অবস্থান পাল্টেছে— দ্বিতীয় পর্বে সরকার এমন অনেক আপস করেছে, যা দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির পক্ষে আদৌ গ্রহণযোগ্য নয়।

২০১৪ সালে এনডিএ সরকার যখন ক্ষমতায় এল, প্রাথমিক ভাবে কিন্তু উদার বাণিজ্য চুক্তি-বিরোধী কোনও অবস্থান চোখে পড়েনি। প্রথম কয়েক মাসে সরকার পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে ক্রমবর্ধমান আর্থিক সম্পর্কের উপর জোর দিয়েছিল— ১৯৯০-এর দশকের গোড়ার দিকে গৃহীত ‘লুক ইস্ট’ নীতির থেকে এক ধাপ এগিয়ে তৈরি হয়েছিল ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ নীতি। পূর্ব এশিয়ার দেশগুলির সঙ্গে আর্থিক সম্পর্ক মজবুততর করতে, কৌশলগত সম্পর্ক তৈরি করতে, এবং সর্বার্থেই যোগাযোগ ব্যবস্থা গভীরতর করতে নীতি রূপায়ণের কথা বলেছিল সরকার। আরও গুরুত্বপূর্ণ ছিল আরসিইপি-র প্রতি সরকারের রাজনৈতিক সমর্থন— ভারতের শীর্ষ নেতৃত্ব আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, এই অতিবৃহৎ বাণিজ্য চুক্তি দ্রুত কার্যকর করার জন্য ভারত সক্রিয় ভাবে চেষ্টা করবে।

কিন্তু, এই পূর্ব এশিয়া-নীতি ধাক্কা খেল উল্লিখিত তিনটি বাণিজ্য চুক্তি— আসিয়ান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং জাপানের সঙ্গে— কার্যকর করার পরে। দেখা গেল, পণ্য বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সেই চুক্তিগুলি ভারতের স্বার্থের পরিপন্থী; প্রায় প্রতিটি দেশের সঙ্গে বাণিজ্যেই ভারতের বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ বেড়েছে। তার চেয়েও বড় উদ্বেগের কারণ হল, দেখা গেল যে, বাণিজ্যদোসর দেশগুলির বাজারে ভারতের রফতানি তেমন জায়গা করে নিতে না পারলেও সে দেশগুলি থেকে পণ্য আমদানির পরিমাণ বাড়ছে। ভারতের বেশির ভাগ রফতানি পণ্যই ছিল হয় কাঁচামাল, নয় অন্তর্বর্তী পণ্য; কিন্তু সে দেশগুলি থেকে আমদানি করা হচ্ছিল মূলত চূড়ান্ত পণ্য, যা সরাসরি বাজারে বিক্রি করা যায়। অর্থাৎ বলা চলে যে, এই বাণিজ্য চুক্তির ফলে দেশের কলকারখানার ক্ষতি হচ্ছিল, কর্মসংস্থান হ্রাস পাচ্ছিল। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে, এই পর্যায়ে পরিষেবা রফতানি বিষয়ে কোনও তথ্য পাওয়া যায় না। হতেই পারে যে, এই সময়ে পূর্ব এশিয়ার দেশগুলিতে ভারতের পরিষেবা রফতানি বাড়ছিল, কারণ পণ্য রফতানির তুলনায় পরিষেবা রফতানির ক্ষেত্রে ভারত চিরকালই আন্তর্জাতিক বাজারে দক্ষতর। কিন্তু, পরিষেবা রফতানির তথ্য না থাকায়, এমনকি সে সব ক্ষেত্রে ভারতের বাণিজ্য-সাফল্যের চেহারা কেমন তার কোনও সরকারি মাপজোক না হওয়ায় এই চুক্তিগুলি বিষয়ে নেতিবাচক মনোভাব গভীরতর হল।

আরসিইপি-র প্রতি সরকারের প্রচ্ছন্ন সমর্থন ছিল। কিন্তু ভারতের অভ্যন্তরীণ একাধিক স্বার্থগোষ্ঠী এই চুক্তির বিরোধী ছিল। তাদের আশঙ্কা ছিল যে, এই চুক্তি রূপায়িত হলে অস্ট্রেলিয়া ও নিউ জ়িল্যান্ড থেকে যেমন কৃষি ও ডেয়ারি পণ্যের আমদানি বাড়বে, তেমনই চিন থেকে আমদানি বাড়বে শিল্পজাত পণ্যের। কাজেই, বলা হতে থাকল যে, আরসিইপি-র অন্তর্ভুক্ত হলে ভারতের কৃষি ও শিল্পের সর্বনাশ হবে। এর মধ্যে, এনডিএ সরকারের প্রথম দফার শেষ পর্যায়ে, চিনের সঙ্গে সীমান্ত-উত্তেজনা বাড়তে থাকল। চিনের সঙ্গে দূরত্ব বৃদ্ধির বৃহত্তর নীতির অঙ্গ হিসাবে স্থির হল, ভারত আরসিইপি থেকে সরে দাঁড়াবে।

এনডিএ-র প্রথম দফায় দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি-বিরোধী অবস্থান যতখানি বিস্ময়কর ছিল, দ্বিতীয় দফায় সেই চুক্তির পথে ফিরে আসাও ততখানিই বিস্ময়কর। ২০২১ সালের শেষ দিকে সরকার ঘোষণা করল, ভারত এবং সংযুক্ত আরব আমিরশাহি একটি উদার বাণিজ্য চুক্তি রূপায়ণের জন্য আলোচনা শুরু করছে। এর পর একে একে ব্রিটেন, ইউরেশিয়ান ইকনমিক ইউনিয়ন-সহ (রাশিয়া যার সদস্য) একাধিক দেশ এবং অঞ্চলের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তির আলোচনা শুরু করল ভারত। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, কানাডা এবং অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে দীর্ঘ দিন স্থগিত থাকা কমপ্রিহেনসিভ ইকনমিক পার্টনারশিপ এগ্রিমেন্টের আলোচনাও ফের শুরু হল।

এই পর্বের তিনটি স্পষ্ট চরিত্রলক্ষণ রয়েছে। এক, এনডিএ-র প্রথম পর্বে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি বিষয়ে যে সংশয় ছিল, তা উধাও হয়ে গেল। দুই, সরকারি ক্রয় বা মেধাস্বত্বের মতো ‘সংবেদনশীল’ বিষয়কে বাণিজ্য চুক্তির অন্তর্ভুক্ত করতে রাজি হল সরকার, প্রথম দফায় যাতে স্পষ্ট আপত্তি ছিল। এবং তিন, দ্রুত চুক্তি রূপায়ণের তাগিদ দেখা গেল। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, সংযুক্ত আরব আমিরশাহির সঙ্গে চুক্তিটি সম্পূর্ণ করতে সময় লেগেছে মাত্র তিন মাস।

ইউরোপিয়ান ফ্রি ট্রেড অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে সদ্য-রূপায়িত চুক্তিটি এনডিএ সরকারের পরিবর্তিত অবস্থানের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ উদাহরণ। প্রথমত, আর্থিক ভাবে উন্নত কোনও পশ্চিমি দেশের সঙ্গে এটাই ভারতের প্রথম মুক্ত-বাণিজ্য চুক্তি। দ্বিতীয়ত, ভারত মেধাস্বত্ব, শ্রম এবং পরিবেশ বিষয়ক মাপকাঠিকে এই চুক্তির অন্তর্ভুক্ত করতে সম্মত হয়েছে, যা অতীতে কোনও দ্বিপাক্ষিক চুক্তিতে করেনি। এই বিষয়গুলিতে কোনও ছাড় দিতে হলে ভারতকে অভ্যন্তরীণ আইন পাল্টাতে হবে— অর্থাৎ, এই চুক্তির ফলে শুধু যে এই চারটি দেশ সুবিধা পাবে এমন নয়, ভবিষ্যতে অন্য যে কোনও দেশ সমান ভাবে লাভবান হবে।

পেটেন্ট আইনের কথাই ধরুন। ভারত নিজের পেটেন্ট আইন সংশোধন করে অধিকতর একচেটিয়া অধিকার দিতে সম্মত হয়েছে। সরকার সংসদে কোনও আলোচনা না করেই এই গুরুত্বপূর্ণ আইন সংশোধনে সম্মতি জানিয়েছে। প্রসঙ্গত বলা প্রয়োজন যে, পেটেন্ট আইন ২০০৫-এ যা সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়েছিল, তা এই সরকার একতরফা ভাবে বদলানোর উদ্যোগ করেছে, বিরোধীপক্ষ ও নাগরিকদের অন্ধকারে রেখে।

জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে এই নীতিগত পরিবর্তনের প্রভাব মারাত্মক। কারণ, পেটেন্ট অধিকার মজবুততর হলে বিদেশি ওষুধ উৎপাদনকারী সংস্থাগুলি দেশের বাজারে তাদের নিয়ন্ত্রণ কঠোরতর করবে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে ভারতীয় সংস্থাগুলির উপরে, যার ফলে দেশের বাজারে ওষুধের দাম বাড়তে পারে। এমনিতেই দেশের অধিকাংশ মানুষ চিকিৎসা খাতের বিপুল ব্যয়ের বোঝা বহনে অক্ষম। ওষুধের দাম আরও বাড়লে তাঁদের কী অবস্থা হবে? বাণিজ্য চুক্তি রূপায়ণের সময় তাঁদের স্বার্থরক্ষা করা সরকারের কর্তব্য ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ভাবে, হঠাৎ উদার বাণিজ্য-পন্থী হয়ে সরকার সেই স্বার্থের সঙ্গেই আপস করে বসল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
আরও পড়ুন
Advertisement