Coromandel Express accident

উলুখাগড়ার দৃষ্টিকোণ

তদন্ত বিফলে যাবে কি না, দিকভ্রষ্ট হবে কি না, জানা নেই। বলির পাঁঠার খোঁজ পড়বে, নষ্টমতি হিসাবনিকাশ মিটে গেলে পাঁঠা মিলবেও, কেননা দেশে ‘সন্ত্রাসবাদ কম পড়েনি’।

Advertisement
স্থবির দাশগুপ্ত
শেষ আপডেট: ২০ জুন ২০২৩ ০৪:৪৭
An image of the Coromandel Express Accident

দুর্ঘটনার পর দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া ট্রেনের কামরা। —ফাইল চিত্র।

শাসকের হাতে প্রভূত ক্ষমতা থাকলে পাবলিকের কী গতি হয় তার টাটকা, রক্তাক্ত নমুনা সাম্প্রতিক রেল-দুর্ঘটনা। রেলের শরীরস্বাস্থ্য ভাল যাচ্ছে না বহু কাল; বিচিত্র প্রসাধন আর ঢালাও ঠিকাদারি বন্দোবস্তেও তা গোপন থাকছে না। অবশ্য দেশের তেজস্বী আর অনর্গল প্রতিভাবানদের বিলাসব্যসন ছাড়া লোকসমাজের সকল ব্যবস্থাই তদ্রূপ। তবে তার মধ্যে রেল-পরিবহণের সঙ্গে দেশের কপালপোড়া লোকস্বাস্থ্যের সাদৃশ্য বেশ কৌতূহল জাগায়। মনে হয়, এই মর্মান্তিক বিপর্যয় লোকস্বাস্থ্যের পক্ষেও শিক্ষণীয়।

আমাদের সকল সমস্যাই বহুমুখী। তার মধ্যে কোন বিষয়ের উপর সর্বাগ্রে, সবচেয়ে বেশি নজর থাকবে, কোথায় অর্থের জোগান থাকবে সবচেয়ে বেশি, এই সব প্রশ্নের যথাযথ উত্তর যেখানে জমা থাকে সেই লোকসমাজের অন্তরমহলে দিগ্‌গজদের যাতায়াত নেই। তাই লোকস্বাস্থ্যের মতো রেল-পরিবহণ ব্যবস্থার চেহারাটাও হেঁটমুণ্ড ঊর্ধ্বপদ। আর তাই রেলব্যবস্থাকে ঝকঝকে তকতকে করে তুলতে তিন হাজার কোটি টাকা খরচ হবে, এমন তাক লাগানো খবরে বিহ্বলতা কাটতে না-কাটতেই লাশের স্তূপ দেখে আমরা দিশেহারা।

Advertisement

তদন্ত বিফলে যাবে কি না, দিকভ্রষ্ট হবে কি না, জানা নেই। বলির পাঁঠার খোঁজ পড়বে, নষ্টমতি হিসাবনিকাশ মিটে গেলে পাঁঠা মিলবেও, কেননা দেশে ‘সন্ত্রাসবাদ কম পড়েনি’। সংবাদমাধ্যমের আর্তনাদ আর শাসকের কুম্ভীরাশ্রু বিসর্জনের যৎসামান্য আয়ুষ্কাল কেটে গেলে হাতে থাকবে সেই পুরনো পাণ্ডুলিপি— রাজকোষে অর্থের সম্ভার আছে, তার চেয়ে বেশি আছে খরচের দুর্দম নেশা। আছে প্রযুক্তির উপর নির্বোধ নির্ভরতা, সঙ্গে আছে কর্পোরেটরচিত পথনির্দেশ আর চমকপ্রদ প্রকল্প। নিজের তৃণভূমি উচ্ছন্নে যাক। উচ্ছল, সচ্ছল প্রতিবেশী বা ভিনদেশকে নকল করে তার সমকক্ষ হতে হবে, এই আমাদের নীতির নিয়তি— লোকস্বাস্থ্যে, ‘লোকো’স্বাস্থ্যেও। বাজি থাকে সাধারণ লোকজনই, তারাই অঘোরে প্রাণ দেয়। অ-সাধারণরা নিজেদের সুরক্ষিত ভাবেন, অথচ ঘণ্টাধ্বনি তাদের জন্যও। অতিমারিতেও তার নমুনা কম ছিল না।

তাই বলে কি উন্নয়ন হবে না, পুরনো বিধিব্যবস্থাই একমাত্র সম্বল? নতুন নতুন ট্রেন হবে, আশ্চর্য গতিতে আমরা মাতোয়ারা হবে, সুপার-ডুপার ‘স্পেশ্যালিটি’ হবে, তবে না অগ্রগতি! সাধ-আহ্লাদ মিথ্যে না; কিন্তু তার আগে নিজের জমিটা শক্ত হওয়া দরকার। উনপাঁজুরে রেল-এর উপর নবতম প্রযুক্তির বৈদগ্ধ চাপিয়ে দিলে হাততালিও ক্ষণস্থায়ী হবে। ঠিক যেমন, কিছু দিন আগেই দেখেছি, লোকস্বাস্থ্যের নড়বড়ে অবকাঠামোর উপর নতুন নতুন পরিকল্পনার তোড়জোড়। টিকাকরণের একটা জাতীয় কর্মসূচি আছে, অতিমারিতে তার বিধ্বস্ত চেহারা নজর কেড়েছে। টিকা দিতে হবে সকলকে, বিশেষ করে লক্ষকোটি শিশু আর কিশোররাই হবে প্রধান গ্রহীতা। বিপুল জনসংখ্যা আর জনঘনত্বে বিশিষ্ট আমাদের মতো বৃহদায়তনের দেশে নতুন ওষুধ ব্যবহারের আগে দরকার ছিল প্রখর নজরদারি। ‘প্রথমেই খেয়াল রেখো যেন কোনও ক্ষতি না-হয়ে যায়’, চিকিৎসা শাস্ত্রের এই সুপ্রাচীন মুনিবাক্য না ভুলে ব্যবহারের আগে টিকার যাচাই পর্ব যথেষ্ট হতে হত। যথার্থ উপযোগিতা বুঝে নেওয়ার চেয়েও বেশি সতর্ক থাকতে হত, কুফলের আশঙ্কায়। সেই নজরদারির ব্যবস্থা দেশে আছে— লাল সঙ্কেত বা রেড সিগন্যাল, রেলপথে ভ্রমণের মতো। কিন্তু তার রক্ষণাবেক্ষণ নেই, আছে আলস্যের অভিশাপ। এই ভাবে লোকস্বাস্থ্যের আঙিনা যখন অবিবেচক ফরমানদারদের দখলে যায় তখন লাল সঙ্কেতের কাঠামোও ক্ষীণজীবী হয়ে পড়ে। দুর্বল সঙ্কেতযন্ত্র রেলের মতো লোকস্বাস্থ্যকেও বিপথগামী করে দেয়। নতুন ট্রেন আর নতুন ওষুধ নতুন প্রযুক্তিসিদ্ধ হলেও তা লোকজীবনে সর্বনাশ ডেকে আনতে পারে।

এ দিকে, আধুনিক লোকজীবনের প্রায় সমস্ত উপাদানই মুনাফাযোগ্য; যথেষ্ট যাচাই-রহিত টিকার মতো নবতম রেলনীতিও মুনাফাপ্রসবিনী, অনবরত। শ্রেষ্ঠীর দৃষ্টিও নিষ্পলক। বহুতর সংক্রমণে অধ্যুষিত আমাদের লোকসমাজকে টিকার বর্মে সজ্জিত করে তুলতে কলঙ্কপ্রসিদ্ধ ফার্মা কোম্পানিগুলির আগ্রহ চোখে পড়ার মতো। মনে পড়ে, আমেরিকার মিশিগান প্রদেশে কয়েক বছর আগে ঘটে যাওয়া জলসঙ্কটের কথা। ‘ফ্লিন্ট ওয়াটার ক্রাইসিস’ নামে পরিচিত ওই সঙ্কটে শিশু ও অন্তঃসত্ত্বা সমেত আমেরিকার প্রায় এক লক্ষ মানুষের জীবন বিপন্ন হয়েছিল।

আর ও দিকে, আমাদের দ্বিচারিতা। লাশের স্তূপ দেখে আজ আমাদের চোখে জল, কিন্তু বিদ্যুৎগতি রেলমূর্ছনার কথা ভেবে আমরা আনন্দাশ্রুতে ভাসি। আমাদের স্বাস্থ্য তদারকির সর্দারদের বুদ্ধিবৃত্তি অতুলনীয় বলে আমরা গর্বিত। এ দিকে সর্পাঘাতের চিকিৎসার জীবনদায়ী ওষুধ ‘অ্যান্টিভেনম’ পেয়েও তা অতি যত্নে পড়ে থাকে বড় শহরের কুলীন হাসপাতালের তালাবন্ধ সিন্দুকে, দূর গ্রামাঞ্চল মোটেই তার নাগাল পায় না— এ সব নিয়ে আমাদের কিছুই আসে যায় না।

চালু স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলি এমনিতেই পরিকাঠামোর অভাবে ধুঁকছে, অথচ অঙ্গীকার শুনলাম, আগামী পাঁচ বছরে দশ হাজার উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্র তৈরি হয়ে যাবে। তাতে যে বোঝার চাপে স্বাস্থ্যব্যবস্থার রুগ্‌ণ শরীর আরও ন্যুব্জ হবে, সে কথা বুঝতে তো ঈশ্বরপ্রদত্ত ব্যুৎপত্তি লাগে না।

অগত্যা লোকস্বাস্থ্যের মতো ‘লোকো’যাত্রাও সমানেই বিঘ্নসঙ্কুল হবে। আমাদের বিদ্বৎসমাজ তথাপি নির্লিপ্ত, অন্যমনা। বেদম অশিক্ষিত ধনকুবেরদের হাতে কাণ্ডজ্ঞান সমেত সব কিছু বন্ধক রেখে দিয়ে আমরা বোধ হয় সর্বস্বান্ত হয়ে গেলাম।

আরও পড়ুন
Advertisement