মেয়েদের সহনাগরিক হিসাবে দেখুন, ‘মায়ের জাত’ হিসাবে নয়
Women

‘দিতেছি কতই যন্ত্রণা’

উত্তর ভারতীয় কট্টর হিন্দুত্ববাদীদের মতো উগ্র ধার্মিকতা বাঙালি হিন্দুদের নয়। আমরা শ্লাঘাবোধ করি ভেবে যে, দেবতাদের আমরা নিজের ঘরের লোকের মতোই আপন করে দেখি।

Advertisement
সীমন্তিনী মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৯ অক্টোবর ২০২৪ ০৭:২৬

আমার মেয়ে যখন খুব ছোট তখন তার সঙ্গে আমি এক দিন লুডো খেলতে বসেছিলাম। ঘরলুডোর জটিলতা কচি মাথায় ঢুকবে না বলে দু’টি গুটি সম্বল করে সাপলুডোর পাতাটাই খুলেছিলাম। খেলার নিয়ম বুঝিয়ে দানের পর দান ছক্কা নেড়েই চলি, পুট আর পড়ে না। মেয়ে অস্থির হয়ে ওঠে। জীবনে ধৈর্য ধরার গুরুত্ব বোঝাতে বোঝাতে হঠাৎ দেখি আমার ভাগ্য সুপ্রসন্ন। আমি চাল দেওয়ার পরে বোর্ডের উপরে ঘুরে ঘুরে ছক্কা এসে দাঁড়িয়েছে এক নম্বরে। আমার গুটি বার করতেই দেখি মেয়েও অমনি তার গুটিখানা বার করছে। বলি, “তোর তো পুট পড়েনি, তুই এখন অপেক্ষা কর।” মেয়ে বলে ওঠে, “মা কি বেবিকে রেখে একা একা বেরিয়ে যাবে নাকি? মা বেরোলে বেবিও বেরোবে।” এমন অকাট্য যুক্তির পিঠে কোনও আপত্তিই টেকে না। দু’টি গুটিই তাই কদম কদম এগিয়ে চলে সিঁড়ির লোভ আর সাপের ভয় দেখানো দুর্গম পথে।

Advertisement

বাচ্চার মায়েদের পক্ষে একা বেরোনো সহজ নয়। খোদ দেবতারা যাঁর সঙ্গে এঁটে উঠতে পারছিলেন না, এমন এক দুর্দান্ত অসুরকে লড়াইয়ে ঘায়েল করলেন যে দেবী, সেই দুর্গা ঠাকুরও বছরে এক বার পুজো নিতে আসেন বাচ্চা-কাচ্চা-পুষ্যি-সমেত। ছেলেপুলেরা একা একা এসে পুজো নিয়ে যায় যে যার সময় মতো, স্বামীটিও আসেন ফি-বছর, শুধু দুর্গাদেবীর বেলা নিয়ম অন্য। সত্যি কথা বলতে কী, সায়েন্স-ফিকশনের কায়দায় পুরুষ-দেবতারা এক মহিলা-রোবটকে তৈরি করলেন, অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত করে পাঠালেন পুরুষ-অসুরকে পরাস্ত করতে, এ গল্পটা তেমন টানে না পাবলিককে। বছরে এক বার মহালয়ার ভোরে সে আখ্যান শোনা হয় বটে, তবে আমরা ভালবাসি পতি-গরবে গরবিনি গৌরী, শ্বশুরালয়বাসিনী প্রবাসী মেয়ে উমা বা সংসারী জননী দুর্গার গল্প। সেই কবে মধুসূদন-বঙ্কিম নারীবাহুর বল নিয়ে মসিক্ষয় করেছিলেন। ইদানীং কালে মেয়েদের ক্যারাটে শেখা উচিত বলে সময়বিশেষে খানিক গলা ফাটানো হলেও অস্বীকার করার উপায় নেই, দশপ্রহরণধারিণীর চেয়ে দশভুজাই আজ আমাদের কাছের।

‘সব মেয়েই দুর্গা’-জাতীয় ক্যাচলাইনে বিজ্ঞাপন, টিভির অনুষ্ঠান, সমাজমাধ্যম যখন মুখর হয়ে উঠেছে তখন ভেবে দেখলে মনে হয়, দুর্গাদেবীকে নারীশক্তির আইকন বানাতে বিশেষ সমস্যা হওয়ার কথা নয় পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থার। অসমশক্তিশালিনী, অথচ যে লড়াই তিনি লড়লেন তা পুরুষে পুরুষে লড়াই, তাঁর নিজস্ব লড়াই নয়।

উত্তর ভারতীয় কট্টর হিন্দুত্ববাদীদের মতো উগ্র ধার্মিকতা বাঙালি হিন্দুদের নয়। আমরা শ্লাঘাবোধ করি ভেবে যে, দেবতাদের আমরা নিজের ঘরের লোকের মতোই আপন করে দেখি। ফল-বাতাসা দিয়ে পুজো করলেও আমাদের ছেলেমেয়েদের মুখে মুখে ফেরে দেবতাদের নিয়ে হাসিঠাট্টা। ‘গণেশদাদার পেটটি নাদা’ বা ‘কার্তিক ঠাকুর হ্যাংলা’র মতো লাইন চিরকালই অতি জনপ্রিয়। সেই একই ধরনের স্পিরিটে দুর্গাদেবীর উমা রূপটি আমাদের বিশেষ পছন্দের। কিশোরীবেলায় পতিগৃহে যাত্রা, বছরে মাত্র ক’টি দিনের জন্য বাপের বাড়ি আসা। শরৎচন্দ্র-আশাপূর্ণা-বিভূতিভূষণ, বাংলা সাহিত্যের পাতা ওল্টালেই শুনতে পাই আগমনী গানের বুক মোচড়ানো মিঠে-করুণ সুর— পুজোয় মেয়েকে বাড়িতে আনার জন্য বাবা-মায়ের আকুতি, সাধ্যের অতিরিক্ত খরচ করে তত্ত্ব পাঠানো, শ্বশুরবাড়ির ক্ষমতা-প্রদর্শন এবং বাপের বাড়ি আসার জন্য মেয়ের ছটফটানি। পুজো জুড়েই থাকে সধবা মেয়েদের পালনীয় লোকাচার। বিয়ের বয়স পার করা মেয়ে, বিয়ে ভেঙে বাপের বাড়িতে ফিরে আসা সধবা মেয়ে, বা নিজস্ব বাসস্থানহীন বিধবা মেয়ে, পরিবারে
এঁদের উপস্থিতি রীতিসিদ্ধ নয়। বিবাহিতা কন্যা অবস্থার গতিকে বাপের বাড়িতে থাকতে চাইলে কী হয়, তার আভাস মেলে ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল-এ। খোদ দেবী দুর্গাকে তাঁর প্রিয়সখী জয়া বলছেন, “জননীর আশে যাবে পিতৃবাসে, ভাজে দিবে সদা তাড়া। বাপে না জিজ্ঞাসে, মায়ে না সম্ভাষে যদি দেখে লক্ষ্মীছাড়া।”

এমন ‘ঘরের মেয়ে’র খোলস ছেড়ে বেরোনো বোহেমিয়ান দেবীও আমাদের আছেন, অস্থানে কুস্থানে একা ঘুরে বেড়ান, কারণবারি পান করেন। শুধু বিপদে আপদেই তাঁর ডাক পড়ে, ঘরের মেয়েদের অত ‘সোয়্যাগ’ আমাদের সয় না। ‘সব মেয়েই কালী’ বা ‘কালীর মতো হয়ে ওঠো’, এমন কথা আমরা শুনি না। আমাদের বিজ্ঞাপন বরং গৃহকর্ত্রীর দশ হাত দেখিয়ে স্বস্তি পায়— মেয়েদের কানে মাথায় জপের মন্ত্রের মতো ঢুকিয়ে দেয়, যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে! পিতৃতন্ত্র মেয়েদের যে শুধু বকুনি দিয়ে ধমকে বশ মানায় তা তো নয়, অনেক সময়ে বন্ধুর মতো পাশে থেকে কানে মন্ত্র পড়ে দেয়। মস্তিষ্ক প্রক্ষালন যন্ত্রে ঢুকিয়ে শিখিয়ে দেয় ‘ভাল মেয়ে’ হয়ে ওঠার মন্ত্র— সেবাই ধর্ম, ত্যাগ-তিতিক্ষাই আদর্শ। সেই কারণেই অনেক পুরুষের মতো অনেক মহিলাও ধর্ষণের কারণ খুঁজে পান মেয়েদের পোশাকে, স্বামী সন্তানদের বলেন “তোমরা খেলেই আমার খাওয়া।” আদর্শ আর কর্তব্যের জামাকাপড় পরিয়ে দিলে বঞ্চনাকেও করে তোলা যায় গৌরবের— যে যত বঞ্চিত, সে তত মহান।

ধরুন দুর্গা তাঁর নির্মাতা দেবতাদের বললেন, “তোমার শত্রু আমার শত্রু নয়। মানে-মর্যাদায় তোমার চেয়ে অনেক নিচুতে যে, তার কাছে পরাজয় আসলে আঘাত হেনেছে তোমার বংশমর্যাদায়। সে গ্লানি মেনে নিতে না পেরেই নির্মাণ করেছ আমাকে, পাঠাতে চেয়েছ যুদ্ধক্ষেত্রে। তোমার সে অহংবোধই বেঁধে দিয়েছে আমারও কর্তব্য-অকর্তব্যের সীমানা। আমি জননী বসুন্ধরার মাটির কন্যা। আমি জানি যুদ্ধ আমাদের জন্য আনে অনন্ত দুর্গতি। মাটির কাছাকাছি থাকা রক্ষ-দানব-দৈত্য-অসুর বরং আমার সহোদর।” এমন প্রতিস্পর্ধার মুখে পড়লে পুরুষতন্ত্র কি তাঁকে নারী-শক্তির আইকন বানাতে চাইত?

লিঙ্গরাজনীতি নিয়ে এত চর্চা হচ্ছে চার দিকে, মেয়েদের দুর্গা বলে অভিহিত করে সম্মান দেওয়ার অভ্যাসটা এ বছর বরং ত্যাগ করা যাক। যে মেয়েটি দায়িত্বজ্ঞানহীন স্বামীর সম্পর্কে অভিযোগ জানায় বাপের বাড়িতে এসে, যে মেয়েটি যুদ্ধ চায় না, যে মেয়েটি সম্পত্তির অধিকার বুঝে নিতে চায়, যে মেয়েটি সন্তানের জন্ম দিতে চায় না, যে মেয়েটির পরিবার নেই, তাকে এক বার জিজ্ঞাসা করে দেখুন, সে ‘মা দুর্গা’ হতে চায় কি না।

মনে পড়ে যায় বিকেলে ভোরের ফুল ছবিতে ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের ভূমিকায় উৎপল দত্তের সংলাপ। ছাত্রীদের উদ্দেশে বক্তৃতা দিতে গিয়ে যিনি বলেন, “তোমরা মেয়েরা, তোমরা কী? তোমরা হলে মায়ের জাত। আমি বেশ দেখতে পাচ্ছি, কিছু দিনের মধ্যেই তোমরা সবাই মা হবে।” মেয়েরা এমন বেখাপ্পা কথা শুনে মুখ চাওয়াচাওয়ি করে মুখ টিপে হাসে। তিনি বলে চলেন, “তোমরা এখন কলেজে পড়ছ, আনন্দ করছ, কিন্তু এ কথাও মনে রাখা দরকার, তোমরা ভবিষ্যতের মা।” তার পর চড়া গলায় বেসুরে রামপ্রসাদী গান ধরেন, ‘মা হওয়া কি মুখের কথা...’।

আজও বহু মানুষ ধরতে পারেন না যে, এতে অসুবিধা কোথায়। পুরুষেরা অপরিচিত মেয়েদের মা বা বোন হিসাবে দেখতে পারলেই যেন সোনার সমাজ তৈরি হবে। নেতাদের ভাষণও শুরু হয় বন্ধুগণ এবং মা-বোনেদের উদ্দেশে। পারিবারিক ভূমিকার ঘেরাটোপে মেয়েদের বসাতে চাওয়ার মধ্যেই যে রয়েছে চরম অসাম্য, তা বোঝার মানসিকতাই তৈরি হয়নি সমাজের বড় অংশের। প্রতিষ্ঠান হিসাবে পরিবারের মাহাত্ম্য আজও আমাদের গণপরিসরের আলোচনায় প্রশ্নাতীত। পরিবারের অন্দরে শ্রম এবং সম্পদের অসম বণ্টন, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতার অসাম্য, মেয়েদের উপরে বাধানিষেধ, গার্হস্থ হিংসা, যৌন নির্যাতন, এ সব বিষয় চর্চায় আসে না বললেই চলে।

মেয়েদের সহনাগরিক হিসাবে দেখুন, ‘মায়ের জাত’ হিসাবে নয়। মা ভাবলেই মনে হবে তারা দশভুজা, ত্যাগ আর সেবাই তাদের ব্রত। তাদের চাহিদা নেই, দাবি নেই, ক্ষোভ নেই। এ বার পুজোয় রামপ্রসাদী গানের কথায় সময়োপযোগী বদল এনে শপথ নিন, মেয়েদের ‘মা, মা বলে আর ডাকব না। দিয়েছি, দিতেছি কতই যন্ত্রণা’।

আরও পড়ুন
Advertisement