Hunger Strike

অনশনের মার নেই! পুরনো অস্ত্রের ধার কমেনি এখনও, গান্ধী-মমতা-অণ্ণার পরে জুনিয়র ডাক্তারেরা সে পথে

অস্ত্রের নাম ‘অনশন’। যাকে অনন্য রূপ দিয়েছিলেন মহাত্মা গান্ধী। ‘অহিংসা’র সেই গান্ধী-অস্ত্রে তার পরে অনেকেই সাফল্য পেয়েছেন। ক্ষমতার হস্তান্তরও ঘটেছে।

Advertisement
আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৯ অক্টোবর ২০২৪ ০৮:০০

গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।

অস্ত্রটি সুপ্রাচীন। কিন্তু তা এখনও ভোঁতা হয়নি। ধারও কমেনি। আরজি কর-কাণ্ডের বিচার চেয়ে আন্দোলনে নেমে সেই পুরনো এবং পরীক্ষিত অস্ত্রেই শান দিতে শুরু করেছেন আন্দোলনকারী জুনিয়র ডাক্তারেরা।

Advertisement

অস্ত্রের নাম ‘অনশন’। যাকে অনন্য রূপ দিয়েছিলেন মহাত্মা গান্ধী। ‘অহিংসা’র সেই গান্ধী-অস্ত্রে তার পরে অনেকেই সাফল্য পেয়েছেন। ক্ষমতার হস্তান্তরও ঘটেছে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে পাওয়া, না-পাওয়ার সূচকে না-মাপলেও অনশন-আন্দোলন ছাপ রেখেছে সমকালীন রাজনীতিতে। উৎসবের মধ্যে কলকাতার প্রাণকেন্দ্র ধর্মতলায় জুনিয়র ডাক্তারেরা যখন আমরণ অনশনে বসেছেন, তখন আবার ‘প্রাসঙ্গিকতা’ ফিরে এসেছে আন্দোলনের এই অহিংস অস্ত্র নিয়ে। নাগরিক সমাজ এবং রাজনৈতিক সমাজের একাংশ আলোচনা করছেন, অতীতে দেখা গিয়েছে, অনশন নামক অস্ত্রের মার নেই। জুনিয়র ডাক্তারেরা কি সাফল্য পাবেন?

শনিবার রাত থেকে ধর্মতলার মোড়ে শুরু হয়েছে তাঁদের অনশন। মঙ্গলবার সেই আন্দোলন চতুর্থ দিনে পড়েছে। এর মধ্যে সোমবার রাজ্যের মুখ্যসচিব আর্জি জানিয়েছেন অনশন তুলে নেওয়ার জন্য। জানিয়েছেন, ১০ তারিখের মধ্যে ৯০ শতাংশ কাজ হয়ে যাবে। সেই ‘কাজ’, যা চেয়ে দশ দফা দাবিতে আমরণ অনশনে বসেছেন সাত জন জুনিয়র ডাক্তার। সেই দাবির মধ্যে রয়েছে রাজ্যের স্বাস্থ্যসচিব নারায়ণস্বরূপ নিগমের অপসারণও। সেই দাবি রাজ্য সরকার মেনে নেবে, এমন কোনও ইঙ্গিত এখনও পর্যন্ত দেখা যায়নি। ফলে অনশন অবিলম্বে বন্ধ হবে, এমন সম্ভাবনাও দেখতে পাচ্ছেন না কেউ।

কিন্তু আমরণ অনশন যে আন্দোলনের ধারালো অস্ত্র, তা নিয়ে খুব সন্দেহ নেই কারও। গান্ধী থেকে শুরু করে মমতা এবং সমাজকর্মী অণ্ণার অনশন তাঁদের ইপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছে দিয়েছে।

ফরাসি বিপ্লব শুরুর গোড়ায় বেশ কিছু সামাজিক গোষ্ঠীর নেতা অনশন করেছিলেন। কিন্তু তা ছিল ‘প্রতীকী’। ঐতিহাসিক থেকে ইতিহাসে আগ্রহী রাজনীতিবিদেরা মানছেন, অনশন যে আন্দোলনের একটি রূপ হতে পারে, তা প্রথম দেখিয়েছিলেন গান্ধীই। দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আমদাবাদ, পুণে থেকে রাজকোট, দিল্লি থেকে কলকাতা— গান্ধীর প্রায় সব অনশনই ‘সাফল্য’ পেয়েছিল। কখনও সেই অনশনের লক্ষ্য ছিল ধর্মীয় হিংসা রুখে দেওয়া, কখনও হরিজনদের অস্পৃশ্য করে রাখার প্রতিবাদ। অনেকের মতে, গান্ধী অনশনকে একটি ‘দর্শন’ হিসেবে তুলে ধরতে পেরেছিলেন। তার পর সেই দর্শনই বিভিন্ন সময়ে অনুসৃত হয়েছে। তাঁদের মতে, নেলসন ম্যান্ডেলার অনশনেও ছিল গান্ধীর দর্শনই। যার মূল কথা ‘অহিংসা’। সিঙ্গুরে ‘অনিচ্ছুক’ কৃষকদের জমি ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি মমতা বা রাজনীতি থেকে দুর্নীতি অপসারণের দাবিতে অণ্ণার অনশনেও ‘অহিংসা সত্যাগ্রহ’ই ছিল মূলকথা।

১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে দাবি ছিনিয়ে আনার অনশন দেখিয়েছিলেন অধুনা অন্ধ্রপ্রদেশের পোট্টি শ্রীরামুলু। পৃথক অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্য গঠনের দাবিতে ৫৬ দিন অনশন করেছিলেন তিনি। ৫৬ দিনের মাথায় অনশনক্লিষ্ট এবং অসুস্থ শ্রীরামুলুর মৃত্যু হয়। যা জনমানসে জমে থাকা বারুদে স্ফুলিঙ্গের কাজ করেছিল। ইন্টারনেট, টেলিভিশন না-থাকা সেই সময়ে গণ আন্দোলনের অভিঘাত এমনই ছিল যে, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু তিন দিনের মধ্যে ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছিলেন, অন্ধ্রকে পৃথক রাজ্য হিসাবে স্বীকৃতি দেবে কেন্দ্রীয় সরকার।

বাংলার রাজনীতিতে অনশন আন্দোলন করে সবচেয়ে বড় সাফল্য পেয়েছিলেন মমতা। সিঙ্গুরে ‘অনিচ্ছুক’ কৃষকদের জমি ফেরানোর দাবিতে ২০০৬ সালের ৪ থেকে ২৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত ধর্মতলায় অনশন করেছিলেন তৃণমূলনেত্রী (ঘটনাচক্রে, তার অদূরেই আমরণ অনশনে বসেছেন জুনিয়র ডাক্তারেরা)। সেই অনশনমঞ্চে এসেছিলেন বিজেপি নেতা রাজনাথ সিংহ, কংগ্রেসের প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সিরা। তৎকালীন রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গান্ধীর অনুরোধে অনশন প্রত্যাহার করেছিলেন মমতা। সেই অনশন নিয়ে তৎকালীন শাসকদল সিপিএম মমতাকে ধারাবাহিক কটাক্ষ করত। কিন্তু মমতার অনশন জনমানসে অভিঘাত তৈরি করেছিল। সিঙ্গুর পর্ব থেকে বাম-বিরোধী যে আন্দোলন মমতা শুরু করেছিলেন, ক্রমে তা বড় আকার নেয়। ২০১১ সালে গিয়ে বাংলায় টানা ৩৪ বছরের বামশাসনের অবসান ঘটান তৃণমূলনেত্রী। মাঠেঘাটের আন্দোলনে অভ্যস্ত থাকলেও অনশন আন্দোলন মমতার ‘অন্য’ ভাবমূর্তি নির্মাণ করেছিল। বিরোধী শিবিরে থাকাকালীন তাঁর অন্য সমস্ত আন্দোলনের চেয়ে মমতা নিজেও তাঁর ধর্মতলার অনশনকেই এগিয়ে রাখেন।

মমতার সেই আন্দোলনের পরেই দেশের রাজনীতিতে সাড়া ফেলেছিল সমাজকর্মী অণ্ণার অনশন সত্যাগ্রহ। দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের সময়ে কমনওয়েলথ গেম্‌স থেকে টুজি স্পেকট্রাম, কয়লা ব্লক-সহ একের পর এক দুর্নীতির অভিযোগ প্রকাশ্যে আসতে শুরু করে। সেই সময়ে লোকপালের দাবিতে দিল্লির যন্তরমন্তরে টানা অনশন করেছিলেন অণ্ণা। সেই অনশন এক দিকে যেমন দ্বিতীয় মনমোহন সিংহ সরকারের সম্পর্কে ‘নেতিবাচক’ ধারণা তৈরি করে দিতে পেরেছিল, তেমনই পরোক্ষে নরেন্দ্র মোদীর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পথও প্রশস্ত করে দিয়েছিল। ফলে যে অভিপ্রায় নিয়ে অণ্ণা অনশন করেছিলেন, তা ‘সাফল্য’ পেয়েছিল। তার অনশনেরই ফসল অরবিন্দ কেজরিওয়ালের দল ‘আপ’। যারা পরে দিল্লির ক্ষমতা দখল করেছে। যদিও তত দিনে অণ্ণার সঙ্গে অরবিন্দের সম্পর্কচ্ছেদ ঘটে গিয়েছে।

উদাহরণ একাধিক। কিন্তু ইতিহাসবিদ তথা অশোক বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য রুদ্রাংশু মুখোপাধ্যায় মনে করেন, গান্ধীই প্রথম অনশনের মাধ্যমে সাফল্য পেয়েছিলেন। তাঁর কথায়, ‘‘গান্ধীর আগে অনশন হয়নি, তা বলা যায় না। তবে গান্ধীর সাফল্য ছিল। সুভাষচন্দ্র বসুও জেলে বসে অনশন করেছিলেন। চল্লিশের দশকের শেষে কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ঘোষিত হওয়ার পরে বক্সার জেলে অনেক বন্দি অনশন করেছিলেন। ফলে সুদীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে।’’ প্রবীণ তৃণমূল নেতা ও প্রাক্তন বিধায়ক তথা এশিয়াটিক সোসাইটির প্রকাশনা বিভাগের প্রাক্তন প্রধান নির্বেদ রায়ও অনশনের ব্যাপারে গান্ধীকেই ‘কিংবদন্তি’ বলে অভিহিত করেছেন। তাঁর বক্তব্য, ‘‘অনশনের বিষয়ে গান্ধীজি যে অধ্যবসায় দেখিয়েছিলেন, তাতে বিস্মিত হয়েছিলেন স্বয়ং রম্যাঁ রোলাঁ। পরবর্তী কালে সারা দুনিয়ার বিদ্বজ্জনেরা বলেছিলেন, নোবেল শান্তি কমিটির সবচেয়ে বড় ভুল গান্ধীজি এবং লিও টলস্টয়কে পুরস্কার না দেওয়া।” প্রবীণ কংগ্রেস নেতা তথা আইনজীবী অরুণাভ ঘোষও গান্ধীর অনশনকেই সবচেয়ে উপরে রাখতে চেয়েছেন। তবে তিনি বলেছেন, “অনশন হল সেই পথ, যাতে অহিংস ভাবে শাসকের উপর চাপ তৈরি করা যায়। যুগে যুগে তা হয়েছে। এখনও হচ্ছে।”

তবে ব্যতিক্রমও রয়েছে। মণিপুরের ইরম শর্মিলা চানু ১৬ বছর ধরে অনশন চালিয়েছিলেন। যা পৃথিবীর ইতিহাসে দ্বিতীয় দীর্ঘতম। চানুকে বাঁচিয়ে রাখতে তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে নলের মাধ্যমে খাবার দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিল স্থানীয় প্রশাসন। বছরের বছর তিনি সে ভাবেই ছিলেন। চানুর দাবি ছিল, উত্তর-পূর্বের মানুষের উপর সেনাবাহিনীর ‘অত্যাচার’ বন্ধ করতে হবে। কেন্দ্রীয় সরকারকে ‘আফস্পা’ প্রত্যাহার করতে হবে। তবে চানুর দাবির কোনওটাই প্রায় বাস্তবায়িত হয়নি। যার কারণ হিসেবে অনেকে বলে থাকেন, চানুর অনশন ছিল ‘একক’। আপাতদৃষ্টিতে একটি ‘প্রান্তিক’ রাজ্যের বাসিন্দা হওয়ায় তিনি গান্ধী, মমতা বা অণ্ণার মতো সাধারণ মানুষকে তাঁর আন্দোলনের পাশে পাননি।

বাংলায় জুনিয়র ডাক্তাররা অবশ্য তাঁদের অনশনে পাচ্ছেন সাধারণ মানুষের একাংশের ‘নৈতিক সমর্থন’। আর ‘প্রত্যক্ষ সমর্থন’ পাচ্ছেন সিনিয়র চিকিৎসকদের। তাঁদের আন্দোলনের পাশে দাঁড়িয়ে ইতিমধ্যেই গণইস্তফা দিয়েছেন আরজি কর হাসপাতালের সিনিয়র চিকিৎসকেরা। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে, অর্থাৎ বুধবারের মধ্যে জুনিয়র ডাক্তারদের দাবি না-মানলে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের সিনিয়র চিকিৎসকেরাও গণইস্তফার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন বলে জানিয়েছেন। সরকারি হাসপাতালে এই গণ ইস্তফার সিদ্ধান্ত ‘সংক্রামক’ হলে বিলক্ষণ চাপে পড়বে রাজ্য সরকার। জুনিয়র ডাক্তারদের ১০ দফা দাবি তখন নবান্ন মেনে নেয় কি না, সেটাই দেখার। নিলে আরও এক বার প্রমাণিত হবে— অনশনের মার নেই!

আরও পড়ুন
Advertisement