—প্রতীকী চিত্র।
এখনও অবধি সমুদ্রে তিন বার ঘর হারিয়েছি। এখন ঝড়-বৃষ্টি বাড়লে রাতে আর ঘুমোতে পারি না। ভাবি আবার ভেসে যাব না তো?” পাশে বয়স্ক স্বামী, পুত্রবধূ, নাতি, নাতনিকে নিয়ে কয়েক বছর আগে বলেছিলেন সাগরদ্বীপের নমিতা মণ্ডল। গত বছর বঙ্গোপসাগরে চতুর্থ বারের জন্য ঘর হারিয়েছেন নমিতা। ভারতীয় সুন্দরবনে এমন ঘটনা ব্যতিক্রম নয়, নিয়ম।
প্রায় তিনশো কিলোমিটার পূর্বে, বাংলাদেশ সুন্দরবনের মংলা বন্দরের গায়ে-লাগানো, সরকারি ভাবেই যৌনপল্লি হিসাবে স্বীকৃতি পাওয়া বানিশানতা দ্বীপের রাজিয়া বিবির মুখে সামান্য পাল্টে যাওয়া উচ্চারণে যেন একই কথা— “জানেন সারা ক্ষণ ভয়ে ভয়ে থাকি। খদ্দেরের সঙ্গে রাতের বেলাতে থাকার সময়ও এক চোখ থাকে পাশের পশুর নদীর
দিকে। জল বাড়ছে না তো, ভেসে যাব না তো?” বাংলাদেশ সুন্দরবনেও নদীতে ঘর হারানো কোনও খবর নয়। যেমন খবর নয় দুই সুন্দরবনেই, তা সে এখানকার জয়গোপালপুর হোক বা বাংলাদেশ সুন্দরবনের জয়মণিগোলা, পানীয় জলের ও লবণাক্ততার তীব্র সমস্যা।
সত্যি বলতে, প্রায় কুড়ি হাজার বর্গ কিলোমিটার ধরে বিস্তৃত ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রায় আড়াআড়ি ভাবে ভাগ হয়ে যাওয়া দুই সুন্দরবন যেন প্রকৃতির অভিন্ন যমজ সন্তান, যাকে রাজনীতি নামক শল্যবিদ ভাগ করেছিল। দুই সুন্দরবনের মধ্যে গুণগত ও পরিকাঠামোয় কিছু অমিল আছে, কিন্তু তুলনায় মিল অনেকটাই বেশি, বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কার অঙ্কে। জলবায়ু যমজ বললেও ভুল বলা হয় না। দুই সুন্দরবন ও তার গায়ে লাগানো অঞ্চল মিলে আশি লক্ষের উপর মানুষ তীব্র জলবায়ু সঙ্কটে, যা জনসংখ্যার নিরিখে বহু বড় বড় দেশকে পিছনে ফেলে দেবে। ইতিমধ্যেই নানা ভাবে বার বার বিপর্যস্ত হয়েছেন নমিতা, রাজিয়াদের মতো লক্ষ লক্ষ মানুষ। দুই সুন্দরবনেই আয়লা থেকে আমপান— অতি তীব্র ঝড় বার বার আছড়ে পড়েছে। সমুদ্রের জলস্তর বৃদ্ধি আন্তর্জাতিক গড়ের প্রায় দ্বিগুণ। জীবিকার সঙ্কট তীব্রতর হয়েছে, সঙ্কটে বনাঞ্চল ও জীববৈচিত্র। সুন্দরবনেই আজ সুন্দরী গাছের আকাল! ফলে পৃথিবী জুড়ে জলবায়ু ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা ভেবে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলের যদি কোনও তালিকা বানানো হয়, তবে তাতে একেবারে উপরের দিকেই থাকার হকদার যে একযোগে সীমান্ত পেরিয়ে সুন্দরবন, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। অথচ মনে রাখতে হবে, সুন্দরবনের মানুষ বার বার জলবায়ু বিপর্যয়ের ধাক্কায় পড়লেও সেই পরিস্থিতি সৃষ্টিতে তাঁদের দায়িত্ব সিন্ধুতে বিন্দুও নয়। এ কথাও মনে রাখতে হবে, গত শর্ম এল শেখ বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি অন্যান্য ক্ষয়ক্ষতিকেও গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। সুন্দরবনের ক্ষেত্রে তেমন সঙ্কটও কম নয়।
এই পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি কলকাতার বাংলাদেশ উপদূতাবাস ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা এনভায়রনমেন্ট গভর্নড ইন্টিগ্রেটেড অর্গানাইজ়েশন-এর যৌথ উদ্যোগে দুই সুন্দরবনের জলবায়ু ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে এক বিশেষ আলোচনা হল এই বিষয়টি মাথায় রেখে যে, গত সম্মেলনে লস অ্যান্ড ড্যামেজ বা জলবায়ু ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে যে আর্থিক তহবিল তৈরির সিদ্ধান্ত হয়েছিল, তার বিস্তারিত প্রয়োগ পরিকাঠামো তৈরির সম্ভাবনা রয়েছে আসন্ন দুবাই জলবায়ু সম্মেলনে। আলোচনায় বাংলাদেশ প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ জলবায়ু দূত অভিন্ন সুন্দরবনের সমস্যাকে গোটা পৃথিবীর সমস্যা বলে মানার যে দাবি তুললেন, তার সঙ্গে একমত দু’দেশের বিশেষজ্ঞরাই। আর্থিক ও অন্যান্য প্রশ্নে দু’দেশের যে অভিন্ন স্বরে দাবি তোলা উচিত, তাতেও একমত দু’পক্ষই। মনে রাখতে হবে, তিস্তা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের মধ্যে ঐতিহাসিক ভাবে চাপানউতোর থাকলেও সুন্দরবন নিয়ে এক সঙ্গে কথা বলা ও কাজ করা সব সময়ই অগ্রাধিকার পেয়ে এসেছে। যদিও কেন্দ্রীয় সরকারের খানিকটা শীতলতার কারণে তা এখনও যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারেনি।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কয়েক বছর আগে ভারত সফরে আসার ঠিক আগে সুন্দরবনকে দু’দেশের একযোগে কাজ করার ক্ষেত্রে মডেল বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলাদেশের সঙ্গে যৌথ সুন্দরবন বৈঠকে প্রথম সারির নেতামন্ত্রীদের পাঠিয়ে স্পষ্ট বুঝিয়েছিলেন যে, এ বিষয়ে তাঁর পূর্ণ সম্মতি আছে। মনে রাখতে হবে, ২০১৯ থেকে ২০২১, মাত্র দু’বছরের মধ্যে তিনটি ঝড়ে— বুলবুল, আমপান ও ইয়াস— প্রায় দেড় লক্ষ কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট হয়েছে বলে হিসাব। বাংলাদেশেও এমন ক্ষতি কম নয়। সুতরাং, সময় এসেছে দু’দেশের সুন্দরবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারদের নিয়ে এক যৌথ ও অভিন্ন দাবিপত্র তৈরি করে বিশ্বের সামনে রাখা। জলবায়ু যমজের শুধু স্বর নয়, সুরও জোড়ার প্রয়োজন। দু’দেশের আশি লক্ষ মানুষের জীবন-জীবিকা বাঁচানোর জন্য অরাজনৈতিক অংশীদারদের পাশাপাশি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী কি একটি সুন্দরবন শীর্ষ বৈঠকের কথা ভাবতে পারেন না ভারত সরকারকে সঙ্গে নিয়ে?
কৃতজ্ঞতা: এনভায়রনমেন্ট গভর্নড
ইন্টিগ্রেটেড অর্গানাইজ়েশন