—ফাইল চিত্র।
কলকাতার তুলনায় কি বাঁকুড়ার গ্রামের বাতাস বেশি দূষিত? গ্রামের মানুষ কি শহরের মতোই দূষণের কারণে রোগ ভোগ করেন? দু’টি প্রশ্নেরই উত্তর, হ্যাঁ। সরকারি হিসাব এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণা তেমনটাই জানাচ্ছে। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাও তা-ই। জয়নগর শহর ছাড়িয়ে তস্য গ্রাম, সেখানেই বছর দুয়েক আগে দেখা কী ভাবে গনগনে কয়লার উনুনের উপর বসানো বিরাট এক পাত্রে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে খেজুর রস ফোটানো চলছে নলেনগুড় বানাতে। মানুষ দেখা যায় না— এমন ঘন ধোঁয়ার মধ্যে বসে কাজ করছেন ৬৬ বছরের দাদু থেকে ৬ বছরের নাতনি। শরীর খারাপ হয় না? প্রশ্নের উত্তরে মধ্যবয়স্ক খেজুর রস সংগ্রাহক বনমালী বলেছিলেন, “হয় না মানে, হাঁপের কষ্ট, বুকের কষ্ট, আরও কত কী। বাচ্চাগুলোর তো শরীর খারাপ লেগেই আছে।”
মনে পড়ল রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ কলকাতা ও সংলগ্ন অঞ্চলে দূষণ কমাতে অনেককে বিনামূল্যে ধোঁয়াহীন চুলা দিচ্ছে। জিজ্ঞাসা করলাম, দূষণ পর্ষদের কাছে কোনও আবেদন করেছেন? “দূষণ পর্ষদ? কোথায় পাব তাকে?”, ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে প্রশ্ন করল বনমালী। একই ভাবে মনে পড়ে সিঙ্গুরের প্রস্তাবিত গাড়ি কারখানার উল্টো দিকে এক গ্রামে কী ভাবে একটি মারাত্মক দূষণসৃষ্টিকারী কারখানার কারণে অধিকাংশ পরিবার নানা রোগে আক্রান্ত হয়েছিল। অথচ, প্রশাসন ছিল নির্বিকল্প সমাধিতে।
তথ্য বলছে বনমালীরা ব্যতিক্রম নন। বায়ুদূষণে শহরকে পাল্লা দিচ্ছে গ্রাম। রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ-এর রিপোর্টই জানাচ্ছে যে, ২০১৯ সালে কালিম্পং বাদে রাজ্যের সব জেলায় বিপজ্জনক দূষক পিএম ১০-এর মাত্রা দেশের সর্বোচ্চ অনুমোদিত সীমার উপরে ছিল। দূষিত জেলার তালিকায় ৬০ শতাংশের উপর গ্রামীণ জনসংখ্যায় অধ্যুষিত বর্ধমান ছিল সবার উপরে। তার পরেই ৯০ শতাংশ গ্রামীণ জনসংখ্যা নিয়ে বাঁকুড়া। এগিয়ে ছিল মুর্শিদাবাদ, নদিয়া, হুগলি ও পশ্চিম মেদিনীপুরও, যেগুলির গ্রামীণ জনসংখ্যার পরিমাণ ৬০ থেকে ৯০ শতাংশের মধ্যে। আইআইটি দিল্লি-র গবেষণা বলছে, ২০১৭ থেকে ২০২২ অবধি প্রতি বছর গ্রামবাংলার গড় পিএম ২.৫, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ধূলিকণা যাকে মানবশরীরের জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকারক মনে করা হয়, শহরের তুলনায় বেশি ছিল।
শহরের তুলনায় জনঘনত্ব কম হলেও গ্রামবাংলায় এই দূষণ প্রবল অভিঘাত তৈরি করছে সাধারণ মানুষের শরীরে। নীতি আয়োগ অনুযায়ী, শুধুমাত্র বায়ুদূষণের কারণে বাংলার গ্রামের মানুষ, শহরবাসীদের তুলনায় গড়পড়তা সাত মাস কম বাঁচেন এবং ২০১৯ সালের হিসাব অনুযায়ী, বায়ুদূষণ থেকে মৃত্যুর হারের হিসাবে দেশে পশ্চিমবঙ্গ দ্বিতীয়, সবার উপরে রাজস্থান। বৈজ্ঞানিক গবেষণা এও বলছে যে, বায়ুদূষণের কারণে গলা বসে যাওয়া, নাক আটকে থাকা বা নাক থেকে সারা ক্ষণ জল পড়া, এমনকি বুকে চাপের মতো রোগগুলি হওয়া বা বেড়ে যাওয়ার ক্ষেত্রেও এগিয়ে গ্রামবাংলা।
হয় রাজ্যের দূষণ কমানোর সঙ্গে যুক্ত আধিকারিকরা নেভিল কার্ডাসের মতোই মনে করেন যে— স্কোরবোর্ড, এ ক্ষেত্রে দূষণের, নেহাতই একটি গাধা, নয়তো গ্রামের মানুষের জন্য তাঁদের বিশেষ হেলদোল নেই। না হলে এত তথ্যপ্রমাণ থাকা সত্ত্বেও দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ কেন শীতকাল এলেই প্রধানত কলকাতা এবং গুটিকয়েক শহরের দূষণ কমাতে উঠেপড়ে লাগে? কেন গ্রামের দূষণ কমানোর জন্য পদক্ষেপ দূর স্থান, আলোচনাও হয় না? গ্রামে খড় পোড়ানোর দূষণ নিয়ে হয়তো কিছু আলোচনা হয়; কিন্তু সেটাও কী করে কলকাতার দূষণ কমানো যায় তার অঙ্ক কষতে, গ্রামের মানুষকে বাঁচাতে নয়। আসলে গ্রামের দূষণ সৃষ্টিকারী শিল্পগুলি, তা সে স্পঞ্জ আয়রনই হোক বা চালকল বা ইটভাটা, কোনও নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই চলে এবং দূষণ করে। অন্য দিকে, খবরে না উঠে এলে গ্রামে দূষণজনিত কোনও সরকারি নজরদারি মোটের উপর নেই। এবং দূষিত শিল্পগুলি সাধারণ ভাবে এলাকার রাজনৈতিক দাদা-দিদিদের ছত্রছায়ায় থাকে। ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েতব্যবস্থায় পরিবেশ বিষয়ক আধিকারিক থাকলেও, তা নেহাতই নিয়মমাফিক।
দায়ী কেন্দ্রীয় পরিবেশ দফতর ও সরকারি সংস্থাগুলিও। প্রায় ১৩০টির মতো শহরের বায়ুদূষণ কমাতে গত পাঁচ বছরে দশ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি বরাদ্দ থাকলেও অন্য ছোট-বড় শহর বা গ্রামাঞ্চলের দূষণ কমাতে কোনও বরাদ্দ নেই; যদিও দেশ জুড়ে শহর ও গ্রামের বায়ুদূষণ বেশ কয়েক বছর ধরেই তুল্যমূল্য। আয়নায় চোখ রাখা দরকার পরিবেশকর্মী থেকে সংবাদমাধ্যমেরও— কেন কলকাতা বাদ দিয়ে গ্রামাঞ্চল-সহ গোটা রাজ্যের বায়ুদূষণ কমানোর দাবি তেমন প্রবল ভাবে ওঠে না। পরিবেশকর্মীরা অবশ্য মনে করাচ্ছেন, গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে এ বিষয়টি তাঁরা তুললেও বিশেষ কল্কে পাননি। প্রশ্ন ওঠে, রাজনৈতিক দলগুলিও কেন এ বিষয়ে প্রশ্ন তুলছে না? গ্রামের মানুষ কি শহরের তুলনায় অর্ধেক ভোট দেন?
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গ্রামের দিকে নজর দিয়েছেন, এনেছেন আর্থিক ও অন্য নানা প্রকল্প। আর পরিবেশ প্রশাসনের ক্ষেত্রে উলটপুরাণ?