জট রেখে জোট হলে আখেরে লাভ হবে কি
Opposition Alliance

রাজা মাঠে নেমে যদি...

ভারতের রাজনীতিতে আঞ্চলিক দলগুলির গুরুত্ব তথা প্রাধান্য মেনে নিতে কংগ্রেস সত্যিই মানসিক ভাবে কতটা প্রস্তুত?

Advertisement
দেবাশিস ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ১৪ ডিসেম্বর ২০২৩ ০৮:৪৫
মিত্রামিত্রশক্তি: কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট ও রাজ্যসভার বিরোধী নেতা মল্লিকার্জুন খড়্গে ও অন্য বিরোধী নেতাদের বৈঠক, ১১ ডিসেম্বর, দিল্লি। পিটিআই।

মিত্রামিত্রশক্তি: কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট ও রাজ্যসভার বিরোধী নেতা মল্লিকার্জুন খড়্গে ও অন্য বিরোধী নেতাদের বৈঠক, ১১ ডিসেম্বর, দিল্লি। পিটিআই।

সম্প্রতি বিধানসভা নির্বাচনগুলিতে কংগ্রেস পর্যুদস্ত হওয়ার পরে বিরোধী জোট নিয়ে নতুন করে ভাবার পরিস্থিতি তৈরি হল। জাতীয় স্তরে ঐক্যের ছবি যে ভাবেই নির্মাণ করা হোক, বিভিন্ন রাজ্যে তার প্রতিচ্ছবি কেমন হবে, সেটিই বর্তমানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। পশ্চিমবঙ্গের মতো কতিপয় রাজ্যের ক্ষেত্রে তো বটেই। তার ইঙ্গিত ইতিমধ্যে মিলতে শুরু করেছে।

Advertisement

ভারতের রাজনীতিতে আঞ্চলিক দলগুলির গুরুত্ব তথা প্রাধান্য মেনে নিতে কংগ্রেস সত্যিই মানসিক ভাবে কতটা প্রস্তুত? বার বার এই সংশয় সামনে এসেছে। বিরোধী শিবির থেকে নানা সময় অভিযোগ উঠেছে কংগ্রেসের ‘দাদাগিরি’ নিয়েও। আবার এটাও ঠিক, ক্ষয়িষ্ণু হয়েও দলটি দেশের সর্বত্র অস্তিত্ব বজায় রেখেছে।

কিন্তু ভোটের রাজনীতিতে নিছক টিকে থাকার কোনও দাম নেই। উপরন্তু এখন লোকসভা ভোটের ঠিক আগের কয়েকটি বিধানসভা ভোটে তারা নিজেদের আরও ‘দুর্বল’ প্রতিপন্ন করল। বেশ কিছু কাল ঝিম ধরে থাকা ‘ইন্ডিয়া’ জোট আবার কোমর বাঁধতে উদ্যোগী হলেও পরিবর্তিত আবহে জোট-সূত্র নিয়ে টানাপড়েন কী মাত্রা নেবে, বলা কঠিন।

আমরা দেখেছি, সাম্প্রতিক ভোটগুলির ফল বেরোনোর দিনেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ ‘ইন্ডিয়া’র শরিক বেশ কয়েক জন নেতা কংগ্রেসের দিকে আঙুল তুলেছেন। মমতা এ কথাও বলেছেন, “কংগ্রেসকে বার বার অন্য দলগুলির সঙ্গে আসন ভাগের আলোচনা এগিয়ে নিতে বলেছিলাম। তারা কানে তোলেনি। যদি সেটা করা হত, তা হলে এই রকম পরাজয়ের পরিস্থিতি হয়তো দেখতে হত না।”

কী হলে কী হত, সেটা নাহয় তর্কসাপেক্ষ। কিন্তু কংগ্রেস যে কারও সঙ্গেই আসন ভাগাভাগির আলোচনায় এত দিন বিশেষ কোনও উৎসাহ দেখায়নি, তাতে তো কোনও সন্দেহ নেই। শুধু কি তা-ই? মধ্যপ্রদেশে কংগ্রেসের সঙ্গে আসন ভাগাভাগিতে আগ্রহী সমাজবাদী পার্টির অখিলেশ যাদবকে কংগ্রেসের প্রবীণ শীর্ষনেতা কমল নাথ যে ভাবে ‘কে এই অখিলেশ-টখিলেশ’ বলে নস্যাৎ করে দিয়েছিলেন, তা-ও কি জোট-রাজনীতিতে আদৌ গ্রহণযোগ্য?

যদিও সর্বোচ্চ কংগ্রেস নেতৃত্ব ফল বেরোনোর আগে পর্যন্ত এ নিয়ে একটি কথাও বলেননি। বলবেনই বা কেন? তাঁরা তো তখন ধরেই নিয়েছিলেন, বাজিমাত হবে! একই কারণে ‘ইন্ডিয়া’ শরিকদের সম্মিলিত প্রচার-আবেদনের ভাবনাটিও আগেই ধামাচাপা দেওয়া হয়েছিল। পাশাপাশি রাজস্থানে বামের সঙ্গে জোটের ব্যাপারে কংগ্রেসের ভূমিকা ইতিবাচক ছিল না।

কংগ্রেস ও সমাজবাদী পার্টির মধ্যে ভোট কাটাকাটিতে মধ্যপ্রদেশে অন্তত বারোটি আসনে বিজেপির জয় নিশ্চিত হয়েছে বলে অনুমান করা হচ্ছে। রাজস্থানে সিপিএম প্রথমে কংগ্রেসের কাছে ছ’টি আসন চেয়েছিল। পরে তা কমিয়ে চারটি করা হয়। তাতেও রফা হয়নি। বামেরা সতেরোটি আসনে প্রার্থী দেয়। হিসাবে দেখা যাচ্ছে, পাঁচটিতে কংগ্রেস-বাম ঐক্য না হওয়ার ‘সুফল’ পেয়েছে বিজেপি। আর বিজেপি-বিরোধী সকলের সমর্থনে এক কেন্দ্রে এক প্রার্থী করা গেলে ওই রাজ্যে কমবেশি পঁচিশটি আসনে বিজেপির জয় অনিশ্চিত হয়ে যেত, এমনটাই বিশ্লেষণ।

এ বার ধাক্কা খাওয়ার পরে কী হল? কংগ্রেস তড়িঘড়ি জোটের বৈঠক ডাকতে উদ্যোগী হল। রাতারাতি কমল নাথের মন্তব্যের জন্য এক প্রকার ‘দুঃখপ্রকাশ’ করা হল। রাহুল গান্ধী বিদেশ সফর বাতিল করলেন। বৈঠকের জন্য মমতার কাছেও তাঁর ফোন চলে এল। অখিলেশকে বৈঠকে আনার জন্য তদবির শুরু হল। তেলঙ্গানায় কংগ্রেস সরকারের শপথে যেতে সনিয়া-রাহুলের বিশেষ বিমানে আমন্ত্রিত যাত্রী হলেন তৃণমূলের ডেরেক ও’ব্রায়েন। লোকসভা থেকে মহুয়া মৈত্রের বহিষ্কারের প্রতিবাদে স্বয়ং সনিয়া গান্ধী তৃণমূলের পাশে এসে দাঁড়ালেন, ইত্যাদি।

এখনকার পরিস্থিতি অনুযায়ী কংগ্রেসের দিক থেকে এগুলি খুব স্বাভাবিক। তারা প্রকৃত অর্থে জাতীয় দল। তাই দেশে বিজেপির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের ক্ষেত্র তৈরি করার দায় তাদেরই বেশি হওয়ার কথা। এটাও ঘটনা যে, আসন ভাগাভাগি না হওয়া সত্ত্বেও কংগ্রেস যদি ওই রাজ্যগুলিতে আশাব্যঞ্জক ফল করত, তা হলে ‘ইন্ডিয়া’র বাকি দলগুলির সঙ্গে জোট-আলোচনার অলিখিত ভিত্তিই হত কংগ্রেসের নেতৃত্ব কার্যত স্বীকার করে নেওয়া। সেই অবস্থান থেকে কংগ্রেস এখন কিছুটা পিছিয়ে পড়লে তাই আশ্চর্যের কিছু থাকবে না।

তবে মজার বিষয় হল, জোটে নেতৃত্বের প্রশ্ন উঠলেই দেশের ‘ওজনদার’ বিরোধী নেতারা সবাই কেমন যেন ‘দার্শনিক’ হয়ে ওঠেন। সকলেই যেন নিরাসক্ত। শুধু বিজেপিকে ক্ষমতা থেকে সরানোর লক্ষ্যপূরণ ছাড়া কারও যেন আর কোনও আকাঙ্ক্ষাই নেই! এ যে ভাবের ঘরে চুরি, তা বোঝানোর অপেক্ষা রাখে না। আসলে তাঁরা সকলে এবং প্রত্যেকে ‘উপযুক্ত’ সময়ের অপেক্ষা করছেন।

অতএব কংগ্রেসের সাম্প্রতিক নির্বাচনী ধাক্কায় তাঁদের অনেকের অন্তরমহল কিঞ্চিৎ আন্দোলিত হলে দোষ দেওয়া যায় না। কিন্তু এরও আগে আছে সলতে পাকানো। অর্থাৎ, আসন ভাগাভাগি। সেই পর্ব কতটা মসৃণ হবে, তার উপর অনেকখানি নির্ভর করবে জোট ও তার ভবিষ্যৎ। জয়-পরাজয় পরের কথা। বিশেষ করে মমতা, নীতীশ কুমার, অখিলেশ, অরবিন্দ কেজরীওয়ালদের সঙ্গে কংগ্রেসের বোঝাপড়া কী বাঁক নেয়, এখনই বলা শক্ত।

আপাতত এই রাজ্যের বিষয় ধরা যাক। সবাই জানি, আঞ্চলিক দলগুলির ‘মর্যাদা’ সম্পর্কে মমতা প্রথম থেকেই সরব। তাঁর অন্যতম জোট-শর্ত হল, যেখানে যে দল শক্তিশালী সেখানে তাকে প্রাধান্য দিতে হবে এবং অন্যেরা তাকে সমর্থন করবে। তাঁর এই নীতির পিছনে রয়েছে বাংলায় তৃণমূলের এগিয়ে থাকার বাস্তবতা। বিজেপি, কংগ্রেস, সিপিএম সবাইকে একাধিক বার একযোগে হারিয়ে তিনি এখন সেই দাবিদার।

তৃণমূল মনে করে, এ বার রাজ্যের লোকসভা আসনেও ‘উপযুক্ত’ সংখ্যাগরিষ্ঠতা তাদের থাকবে এবং তারা একক ভাবে যত বেশি আসন জিতবে, পরিস্থিতি অনুযায়ী দিল্লির মাঠে তাদের ‘খেলা’র তত সুবিধা। এটাও কুশলী চাল।

তথাপি ভোটের অঙ্কে সর্বদাই একটা অনিশ্চয়তা থাকে। প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীদের ভোট পাওয়ার সরল হিসাব কখনও উলটপালট হয়ে যেতে পারে মেজো-সেজোদের ভোট কাটাকাটির ধাক্কায়। আপাত ভাবে সহজ মনে হওয়া অনেক পাকা ঘুঁটিও সেই জন্য অনেক সময় কেঁচে যায়। এ কোনও নতুন তথ্য নয়।

এখানে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইতে তৃণমূলের সঙ্গে রফা না-করার ব্যাপারে প্রদেশ কংগ্রেস এখনও অনড়। সাম্প্রতিক বিধানসভা নির্বাচনগুলির পরেও প্রদেশ কংগ্রেস নেতৃত্ব ওই অবস্থান থেকে সরেননি। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বৃহত্তর রাজনৈতিক বোঝাপড়ার স্বার্থে হাই কম্যান্ড কি প্রদেশ নেতৃত্বকে মত বদলাতে রাজি করানোর চেষ্টা করবেন? জানা নেই। অপর দিকে, তর্কের খাতিরে কংগ্রেস যদিও বা রাজি হয়, তৃণমূল তাদের কতগুলি আসন ছাড়তে চাইবে? কাঁটা কিন্তু সেখানেও।

জোর করে ‘জোট’ করতে যাওয়ার পরিণতি কী হয়, ২০০১-এর বিধানসভা ভোট তার একটি দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। জ্যোতি বসুকে সরিয়ে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে মুখ্যমন্ত্রী করার পরেই ওই ভোটে তৃণমূল নেত্রী মমতার স্লোগান ছিল, ‘হয় এ বার, নয় নেভার’। কংগ্রেসের সঙ্গে আসন রফা চূড়ান্ত করতে কমল নাথের কলকাতার বাড়িতে মধ্যরাতে বৈঠকে বসেছিলেন মমতা। দেখেছিলাম, আসন ধরে ধরে একটি তালিকা তৈরি হল।

পর দিন ওই বাড়ির লনে সাংবাদিক সম্মেলনে ষখন আসন রফার কথা ঘোষণা চলছে, তখনই অদূরে দাঁড়িয়ে রাজ্য কংগ্রেসের কয়েক জন বড় নেতা কটাক্ষ শুরু করেছিলেন। ভোট কাটাকাটি চরমে উঠেছিল। সে বার তৃণমূল পেয়েছিল ৬০টি আসন, কংগ্রেস ২৬টি।

তাই বলি, রাজা মাঠে নেমে লোকসমক্ষে ‘সদিচ্ছা’র হাত বাড়াতেও পারেন। কিন্তু আসল জট তো মনে! সবাই তা পাকাচ্ছে। খুলবে কে?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
আরও পড়ুন
Advertisement