Technology development

অন্ধকারেই আলোর সন্ধান

যে কোনও ভার্চুয়াল কাজ করতে গেলেই কম্পিউটারের প্রয়োজন, তাই প্রযুক্তির দৌড়কে এড়িয়ে কোনও কিছুই হওয়ার নয়। এর উপর ভারতের আর একটি মোক্ষম অস্ত্র ইংরেজি ভাষায় যোগাযোগের ক্ষমতা।

Advertisement
সুগত মারজিৎ
শেষ আপডেট: ৩১ অক্টোবর ২০২৩ ০৪:২৭

কম্পিউটার ব্যবহারে ভারতের দক্ষতা এবং সাফল্য পৃথিবীতে সর্বজনবিদিত। আজকাল বিভিন্ন দেশের সিনেমা বা ওয়েব সিরিজ়ে তথ্যপ্রযুক্তির দক্ষতাসম্পন্ন কোনও চরিত্র থাকলে ধরেই নেওয়া যায় যে, তিনি ভারতীয় হবেন। পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে তেমন সফল না হলেও ভার্চুয়াল জগতে ভারতের দাপট প্রশ্নাতীত। আর, বিশ্ব অর্থনীতিতে ভার্চুয়াল জগতের দাপটও প্রতি দিন বেড়ে চলেছে। ভার্চুয়াল দুনিয়ায় ভারতের সাফল্যে বিশ্বের অন্যত্র প্রবহমান বৈপ্লবিক প্রযুক্তি সৃষ্টির স্রোত এবং প্রকৃতির খানিকটা অবদান অনস্বীকার্য।

Advertisement

১৯৮০-র দশকের মাঝামাঝি আমেরিকায় যাঁরা কম্পিউটার বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করতেন, তাঁদের কাছে ভারতের উঠতি ‘সিলিকন ভ্যালি’ বেঙ্গালুরুর কথা শুনি। ক্যালিফোর্নিয়ার সিলিকন ভ্যালি তখন খ্যাতির মধ্যগগনে। আমেরিকা আর ভারতের মধ্যে সময়জনিত দূরত্ব দশ-এগারো ঘণ্টার মতো। আমেরিকা যখন ঘুমোতে যায়, আমরা তখন জেগে উঠি। ওরা যখন মানসিক, শারীরিক ভাবে ক্লান্ত হয়ে ঘুমোতে যায়, আমরা তখন তাজা। স্বভাবতই এর উল্টোটাও সত্যি। প্রকৃতির অবদানে দিনের চব্বিশ ঘণ্টার মোটামুটি অর্ধেক সময়ে আমরা সতেজ, বাকি অর্ধেক আমেরিকার বাসিন্দারা। এ ফারাক অনন্তকালের। কিন্তু এই ফারাকটি অর্থনৈতিক ভাবে অপরিসীম গুরুত্ব পেল গত পঞ্চাশ বছরে ভার্চুয়াল লেনদেনের মাধ্যমে।

ভারতের ক্ষেত্রে সোনায় সোহাগা হল অনলাইন কাজকর্ম করার সুযোগ, প্রযুক্তির দৌলতে। সারা বিশ্বে কম্পিউটার এবং স্যাটেলাইট প্রযুক্তির বৈপ্লবিক সাফল্যের কথা সবারই জানা। তার একটিও মৌলিক ভাবে ভারতে তৈরি হয়েছে বলে শুনিনি। কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তি ছড়িয়ে পড়েছে সারা বিশ্বে। কাঁচরাপাড়ায় বসে মুড়ি তেলেভাজা খেতে খেতে নিউ জার্সির এডিসনের এক কোম্পানির কারও সঙ্গে একই সময়ে বসে কাজ করার অভিজ্ঞতা আজ একেবারেই অপরিচিত নয়। আশির দশকে শুনতাম যে, আমেরিকাস্থিত কোনও সংস্থায় কেউ একটি সফটওয়্যারজনিত সমস্যায় খানিকটা সমাধান করে, সেটি বেঙ্গালুরুস্থিত সেই সংস্থার শাখা বা অন্য কোনও সংস্থার কোনও কর্মীকে পাঠিয়ে দিয়ে ঘুমোতে চলে যেতেন। তখন বেঙ্গালুরুর কর্মী ঘুম থেকে উঠে তরতাজা হয়ে অফিসে কাজ করতে এসেছেন, সারা দিনের মধ্যে সেটির সমাধান করে, হয়তো সান ফ্রান্সিসকোতে পাঠিয়ে দিতেন। ফলে দিনের চব্বিশ ঘণ্টায়, সব সময় কাজ হয়ে চলত। বারো ঘণ্টার দিন আমেরিকায়, অপর বারো ঘণ্টার দিন ভারতে। কাজের আদানপ্রদানে কোনও খরচ নেই; নিমেষে পাঠানো হয়ে যাচ্ছে। সেখানে প্রযুক্তির অবদান লক্ষণীয়। আর ওই কম্পিউটার প্রযুক্তির হাত ধরে, প্রাকৃতিক ভাবে বিভক্ত পৃথিবীর দু’টি দেশ সারা দিন ধরে কাজ করতে পারছে। বোঝাই যাচ্ছে যে, আমেরিকা এবং মেক্সিকোর সঙ্গে কিংবা কানাডা বা ইউরোপের সঙ্গে এই লেনদেন সম্ভব নয়। অবশ্যই এর মানে এই নয় যে, সারা রাত জেগে কাজ করা যায় না। কিন্তু আমেরিকা এবং ভারতের এই প্রাকৃতিক সম্পর্ক একেবারেই সময়জনিত ফারাকের প্রতিফলন, যা অন্য কোনও দেশের সঙ্গে চট করে পাওয়া শক্ত। কারণ সূর্যের আলো পাওয়া-না-পাওয়ার গল্পটি অন্যত্র লেখা হয়েছে, সেটির পরিবর্তন এখনও অসাধ্য। এর ফলে দিনের চব্বিশ ঘণ্টায় প্রতিটি ঘণ্টায় এক জন তরতাজা মানুষ কাজ করে চলেছেন। যদি ভারত আর আমেরিকা পাশাপাশি দেশ হত তা হলে দু’দলই এক সময়ে ঘুমাত এবং একই সময়ে উঠে কাজ করত, তাতে একটি কাজ নিঃসন্দেহে বারো ঘণ্টা পিছিয়ে যেত।

যে কোনও ভার্চুয়াল কাজ করতে গেলেই কম্পিউটারের প্রয়োজন, তাই প্রযুক্তির দৌড়কে এড়িয়ে কোনও কিছুই হওয়ার নয়। এর উপর ভারতের আর একটি মোক্ষম অস্ত্র ইংরেজি ভাষায় যোগাযোগের ক্ষমতা। ভারতের শিক্ষিত মানুষদের ইংরেজিতে কাজ চালাতে তেমন অসুবিধে হয় না। চিনের সেটা সমস্যা। প্রাকৃতিক কারণে সময়ের ফারাকের সঙ্গে সঙ্গে ইংরেজি ভাষায় আপেক্ষিক দক্ষতা আরও একটি দেশের অস্ত্র, সেটি হল ফিলিপিনস। কিন্তু ভারতের আয়তন, দক্ষ কারিগরি শক্তি, বিশাল বিশাল তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা গত চল্লিশ বছরে অনেকটাই পাকাপোক্ত চেহারা নিয়েছে। এর সঙ্গে পাল্লা দেওয়া চাট্টিখানি কথা নয়।

আন্তর্জাতিক বাণিজ্য তত্ত্বের জনক ডেভিড রিকার্ডো বলেছিলেন, অনেক কিছু অনেকের চেয়ে ভাল ভাবে করতে জানলেও, তার মধ্যে যেটিতে দক্ষতা সবচেয়ে বেশি, সেটিই তৈরি করে রফতানি করা উচিত। ভেবে দেখলে, প্রতি দিন বারো ঘণ্টা সময় আমেরিকার কর্মীদের তুলনায় ভারতের কর্মীদের দক্ষতা শুধু আপেক্ষিক ভাবে নয়, চরম ভাবেই বেশি— কারণ, সেই সময়টায় আমেরিকার কর্মীরা ঘুমোন, ভারতের কর্মীরা দিনের আলোয় কাজ করতে পারেন। ভারত-আমেরিকার এই ভার্চুয়াল সম্পর্কে চিড় ধরা শক্ত। এই সম্পর্ক ভারতের প্রভূত উপকার করে চলেছে। তা ছাড়া ভার্চুয়াল জগৎ ধ্বংস না হলে শত কোটি ভার্চুয়াল প্রযুক্তির কার্যকারিতা নির্ভর করবে। সেগুলির মেন্টেন্যান্স, পরিষেবার উপর যে পরিষেবার কদর পেটেন্ট ব্যবস্থা দিয়ে করা হবে না। তবে প্রযুক্তির ব্যবহার থেকে মুনাফা করতে গেলে দক্ষ কিন্তু অপেক্ষাকৃত কম মাইনের বহু কর্মী প্রয়োজন। সেখানেও ভারতের আপেক্ষিক দক্ষতার ব্যাপারটি প্রাসঙ্গিক।

ভারতে তাই শিল্পবিপ্লব তেমন ভাবে হয়নি, হয়তো হবেও না। কিন্তু, ভারতের উন্নতির সুযোগ তার উপরে নির্ভরশীল নয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
আরও পড়ুন
Advertisement