ঝাড়খণ্ডের মেয়ে সঙ্গীতা সোরেন। বয়স মাত্র কুড়ি। ইটভাটায় কাজ করেন। তাঁর আর একটি পরিচয়ও আছে। ভারতের অনূর্ধ্ব উনিশ মহিলা ফুটবল দলের হয়ে দুরন্ত খেলেছেন। ২০২০-তে জাতীয় দলে যাওয়ার কথা ছিল। কোভিড সব গোলমাল করে দিয়েছে। তীব্র অভাব সঙ্গীতাকে মাঠের বদলে পাঠিয়েছে ইটভাটায়। তবু জাতীয় দলের জার্সির স্বপ্ন দেখেন। ফাঁক পেলেই চলে যান ধানবাদ ফুটবল স্টেডিয়ামে।
সঙ্গীতা সোরেনদের স্বপ্ন সত্যি হওয়া কঠিন। প্রথমত, তিনি গরিব। দরিদ্রদের এ দেশে খেলাধুলা করা মানায় না। দ্বিতীয়ত, তিনি নারী। নারীকে হতে হবে সুন্দরী, ঘরোয়া, কর্মরতা। মাঠ-ময়দানে তাঁর প্রবেশ নিষিদ্ধ। তার পর খেলেন ‘পুরুষের খেলা’ ফুটবল! এ দেশে ক্রীড়াক্ষেত্রে এ বারেও যে মেয়েরা অলিম্পিক্স কাঁপালেন, সেই হকি ছাড়া বাকি সমস্ত সাফল্যই এসেছে ব্যক্তিগত ইভেন্টে। দলগত সাফল্য পেতে হলে যে সাহায্য এবং সহমর্মিতার ভরসা থাকা দরকার, ভারতের মেয়েরা তার কিছুই পান না। কখনও সাফল্য পেলে রাজকীয় চা-চক্রে তাঁদের সারিবদ্ধ ছবি কয়েক মুহূর্তের জন্য ভেসে ওঠে। আবার বিস্মৃতির অন্ধকারে হারিয়ে যান। কয়েক মাস আগে প্রধানমন্ত্রী কাশ্মীরের ফুটবলার আফসান আশিককে বলেছিলেন, “আপনি তো দারুণ খেলেন। বেশির ভাগ ফুটবলপ্রেমী বলেন, ‘বলটা বেকহ্যামের মতো বাঁকাও।’ এ বার বলবেন, ‘বল নিয়ে আফসানের মতো টেক্কা দাও।’” এই বায়বীয় কথোপকথন স্টেডিয়ামের বাস্তবতায় এসেছে কি না, ক’জন জানেন? ক’জন জানেন বালা দেবীর নাম? মণিপুরের এই খেলোয়াড় প্রথম ভারতীয় এবং এশিয়ান মহিলা ফুটবলার হিসাবে ইউরোপের ফুটবল ক্লাবে সই করেছেন। আমরা খবর রাখি না। যেমন জানকী কোটেচা, সুজাতা কর, আলপনা শীল প্রমুখ অসাধারণ নারী ফুটবলারের খবর রাখিনি।
সম্প্রতি ভারতের মহিলা ফুটবল নিয়ে কিঞ্চিৎ শোরগোল পড়েছে। কারণ তাঁরা মাঠে জিততে শুরু করেছেন। আমিরশাহি সফরে (আন্তর্জাতিক বন্ধুত্বপূর্ণ ম্যাচ) ভারতের মেয়েরা চারটি ম্যাচ জিতেছেন। হেরেছেন (এক গোলে) মাত্র একটি ম্যাচ। বাহরিনকে ৫-০ গোলে উড়িয়ে দিয়েছেন। র্যাঙ্কিংয়ে অনেক এগিয়ে থাকা চাইনিজ় তাইপেই-কে ভারত হারিয়েছে। এখন পুরুষ ফুটবল দলের বিশ্ব র্যাঙ্কিং ১০৭। মহিলারা ৫৭-য়। মাঝে আরও উঠেছিলেন। ফুটবলার সুনীল ছেত্রী বলেছেন, “মহিলাদের দল পুরুষ দলের চেয়ে অনেক ভাল।”
২০১৯-এর মহিলা বিশ্বকাপে তাঁরা বিশেষ কিছু করতে পারেননি ঠিকই। কিন্তু ওই বছরেরই প্রথমে আঠারোটি খেলার দশটিতেই জিতেছিলেন। কম কথা নয়। কারণ ভারতে ফুটবল নিয়ে গান বা সিনেমা যত হয়েছে, পরিকাঠামো তার ধারেকাছেও যায়নি। তায় মহিলাদের ফুটবল তো চির-উপেক্ষিত। ভারতের মহিলাদের ফুটবল ফেডারেশন হয়েছে ১৯৭৫-এ। ইন্ডিয়ান ফুটবল ফেডারেশনে মিশতে সময় লেগেছে ১৫ বছর। এর মাঝখানে দু’বার রানার-আপ হয়েছিলেন এএফসি উইমেন’স এশিয়ান কাপে। কিন্তু পাত্তা পাননি। মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল ২০০১ নাগাদ মেয়েদের ফুটবল ক্লাব তৈরি করে। ক্লাব ফুটবলে বাংলাকে টেক্কা দিতে থাকে ওড়িশা এবং মণিপুর। ক্লাব, লিগ, অনূর্ধ্ব সতেরো ও উনিশ, জাতীয় ইত্যাদি নানা স্তরে খেলা শুরু হয়। তবু পরিকল্পনার অভাব ছিল। মেয়েদের ফুটবলকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছিল না। দারিদ্র, পুরুষতন্ত্র, সমাজ, প্রশিক্ষণ, পরিকাঠামো নিয়ে প্রবল সমস্যা। ম্যাচ খেলার সুযোগ পাচ্ছিলেন নামমাত্র। পুরুষ ‘গোলন্দাজ’রা যেখানে বিপ্লব, মহিলার ক্ষেত্রে তা হল বিপন্নতা। অপুষ্টি, পিরিয়ডের সমস্যা, ৯০ মিনিট দৌড়ানোর মতো ফুসফুসের জোর, আধুনিক টেকনিক, প্রচুর প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচ— এ সব কি এমনি মেলে?
২০০৩-এ এশিয়ান কাপে চিনের কাছে ১২-০ গোলে হার ভারতীয় মহিলা ফুটবল দলকে দুমড়েমুচড়ে দিয়েছিল। কয়েক জন অভিবাসী আর মুম্বই ডিস্ট্রিক্ট ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন তাঁদের উৎসাহ ও সহায়তা জোগান ২০০৯-১০’এ। ফিফা নতুন পরিকল্পনা নেয়। মেয়েরা ফুটবল পায়ে ঘুরে দাঁড়ান। ২০১৯-এ মহিলা ফুটবল দলের কোচ মায়মল রকি বলেছিলেন, “ওদের বোঝাতে চাইছিলাম, ওরা ভাল খেলে। আরও ভাল খেলতে পারে।” এ কথা ফুটবল ফেডারেশন, প্রচারমাধ্যম, সমাজকেও বুঝতে হবে।
ফুটবল প্রথম থেকে ‘পুরুষের খেলা’ ছিল কি? এমন খেলা তো আঠারো শতকের শেষ ভাগে স্কট মেয়েদের খেলতে দেখা গিয়েছে। তার আগেও খেলা হত। ১৯২০-তে ইংল্যান্ডের স্টেডিয়ামে পঞ্চাশ হাজার দর্শক মহিলাদের ফুটবল দেখেছেন। ১৯২১-এ এক অদ্ভুত নিষেধাজ্ঞায় সে দেশে এই প্রবাহ ৮৭ বছরের জন্য থেমে যায়! ২০০৮-এ ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন মহিলাদের প্রতি এই অন্যায়ের জন্য লিখিত ক্ষমা চান। তার আগেই অবশ্য ১৯৯১-এ ফিফা মহিলা বিশ্বকাপ এবং ১৯৯৬-এ অলিম্পিক্স-এ মহিলাদের ফুটবল চালু হয়েছিল।
সামনের বছর এশিয়ান কাপ রয়েছে। আমরা কি শুভেচ্ছা, সহায়তা এবং সমর্থন নিয়ে মহিলা ফুটবলারদের পাশে দাঁড়াতে পারি না? মহিলা হকি দল তো দেখিয়ে দিয়েছে, সামান্য সহযোগিতা পেলে কতখানি বিক্রম দেখাতে পারে। কেন্দ্র, রাজ্যের সরকার ফুটবল দলকে সেই ভরসা জোগাতে পারবে না? যাঁরা ছোটবেলায় ফুটবল খেলার ক্লাব পাননি পাড়ায়, প্রশিক্ষণ পাননি স্কুল-কলেজে, তাঁরা আজ কতখানি এগিয়ে এসেছেন!
মহিলাদের ফুটবল বিশ্বকাপে টিকিটের দাম পুরুষের ম্যাচের টিকিটের দশ ভাগের এক ভাগ। সংবাদমাধ্যমে প্রচার, দর্শক সংখ্যা আশাপ্রদ ছিল না প্রথমে। কিন্তু গত বার ফ্রান্স এক অন্য ছবি এঁকেছে। ম্যাচ নিয়ে ব্রাজিল, ইংল্যান্ড দলের দর্শকদের উন্মাদনা ছিল তুঙ্গে। ইংল্যান্ড-ক্যামেরুন ম্যাচে তো মারামারি বাধার উপক্রম। পরিকাঠামো, পরিচর্যা, পরিশ্রম আর প্রশিক্ষণ পেলে ব্রাজিলের মার্তা, আমেরিকার মেগানের মতো আমাদের মালতীরাও মাঠে হাঁটু গেড়ে বসে সময় এবং সমাজকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে পারবেন না?