বীরভূমের ডেউচা-পাঁচামি এই মুহূর্তে আবার খবরের শিরোনামে। ডেউচা-পাঁচামি-দেওয়ানগঞ্জ-হরিণসিংহা হল বীরভূমের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে মহম্মদবাজার ব্লকের এলাকা, যেখানে এক সঙ্গে ১২.২৮ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় মাটির তলায় প্রায় ২১০ কোটি টন কয়লা রয়েছে বলে জানিয়েছিলেন জিয়োলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার বিজ্ঞানীরা আজ থেকে ১০-১২ বছর আগেই। পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম কয়লার ভান্ডার বলা হয় একে— এক সঙ্গে একই জায়গায় এতটা কয়লা সহজে দেখা যায় না। ফলে এখানে কয়লাখনি বানানো ও মাটি থেকে কয়লা তোলার ব্যাপারে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের এবং নানা ধরনের বৃহৎ বেসরকারি শিল্পের বড় উৎসাহ। তবে পুরো ব্যাপারটায় একটা সমস্যা আছে, যার জন্য শুরুতে অনেকগুলো রাজ্যই এই খননকার্যে উৎসাহ দেখালেও পরে সবাই সরে যায় এবং বর্তমানে শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উপরেই এই দায়িত্ব ন্যস্ত হয়। এখানে খননকার্য সহজ নয়, কারণ এই এলাকায় কয়লা রয়েছে জমির উপরিতলের থেকে গড়ে প্রায় ১৫০ মিটার নীচে; এবং মোটামুটি উপরের ২০ মিটার বাদ দিলে এই অংশের প্রায় পুরোটা জুড়েই রয়েছে ভীষণ শক্ত ব্যাসল্ট পাথরের স্তর, যার ভূতাত্ত্বিক নাম রাজমহল ট্র্যাপ। এই রাজমহল ট্র্যাপের বয়স প্রায় হিমালয়ের সমান, অর্থাৎ প্রায় ৫ কোটি বছর।
ভাবতে গেলে, অনেকটা এ রকম ব্যাপার যে, মাটির তলায় দামি কিছু আছে জানতে পেরে রাষ্ট্রনেতা ও ব্যবসায়ীরা এক দিন হিমালয় পর্বতটাকেই কেটে ফেলতে এলেন, আর হিমালয় ভ্যানিশ হয়ে গিয়ে সেই খোলামুখ খনিতে শুধু পড়ে রইল বিরাট বড় বড় জলাশয়! বিষয়টা বেশ ভয়ের বইকি।
আজকের দিনে সারা দুনিয়াতেই মানুষ এটা ভাবছেন যে, সরাসরি পৃথিবীর বুক থেকে কিছু নিয়ে ব্যবহার করতে গেলে শুধু তোলা বা বার করার খরচটুকু হিসাব করলেই চলবে না; যা তোলা বা বার করা হল, তার প্রকৃত মূল্য, এবং এই কাজটা করার ফলে যে পরিবর্তিত পৃথিবী পড়ে থাকল তার উপরে এই ঘটনার কী প্রভাব পড়ে রইল, এগুলোও মূল্যের মধ্যে ধরতে হবে। কারণ, পৃথিবীর প্রাকৃতিক সম্পদের একচেটিয়া মালিকানা শুধু মানবপ্রজাতির নয়, এর মালিকানা (যদি আদৌ মালিকানা অর্থে ধরা যায়) পুরো পৃথিবী ও জীবজগতের। মানুষ পুঁজিবাদ ও প্রযুক্তির হাত ধরে প্রাকৃতিক সম্পদের লাগামছাড়া ব্যবহার করতে শুরু করেছে মানেই মালিকানা তার হয়ে যায়নি, বরং এই কাজ করতে গিয়ে সে নিজেকে বাকি প্রতিবেশী জীবজগৎ ও পুরো প্রকৃতি থেকেই আলাদা করে ফেলেছে, নিজেকে প্রকৃতির অংশ হিসাবে মনে রাখতে ভুলে গিয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে সে অবশ্য খানিক বেগতিকে পড়ে একটু মাথা চুলকাতে শুরু করেছে বটে, কিন্তু নিজেকে প্রভু হিসাবে ভাবা শেষ করে নতুন করে প্রকৃতির অংশ হিসাবে ভাবতে শেখার মতো শিক্ষিত হতে তার এখনও বহু দেরি। অবশ্যই ক্ষমতাসীনরা এবং তাঁদের শিল্পপতি বন্ধুরা এই ভাবে অঙ্কটা দেখতেই রাজি নন। তাঁরা বিলক্ষণ জানেন যে, এই অঙ্কের লাভের দিকটা অন্তত আজকের মতো তাঁদের পকেটস্থ হবে, আর ক্ষতির ভার বইবে বিশাল সংখ্যক ‘অন্য’ মানুষেরা। ফলে অস্ট্রেলিয়ার স্কট মরিসন থেকে আমেরিকার ট্রাম্প পর্যন্ত কেউই এই হিসাবটাই মানতে চান না। তবে চার দিকে হইচই শুরু হওয়াতে আজকাল কর্পোরেট বোর্ড-মিটিংয়ে একটা পোশাকি অ্যাজেন্ডা থাকে যার নাম হল ‘গো গ্রিন’, যদিও তাতে আসলে কতটা কী হয়, তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। ঘটা করে শেষ হওয়া গ্লাসগো মিটিং-এর কথা ভাবলে হতাশ হওয়া স্বাভাবিক। অন্য দিকে ‘গো গ্রিন’-এর ধাক্কায় বহু শ্রমিক কাজ হারাতে পারেন, এই আশঙ্কায় ট্রেড ইউনিয়নগুলোতে আলোচনা চলছে ‘জাস্ট ট্রানজ়িশন’-এর। ফলে চার দিকেই আগামী পৃথিবীর রাজনীতি ও অর্থনীতির গতিপথ নিয়ে চলছে একটা অনিশ্চয়তা, আর ঠিক এই সময়েই শুরু হতে চলেছে ডেউচা-পাঁচামি।
এই প্রাকৃতিক সম্পদ ও তার উপর নির্ভরশীল শিল্পের বিষয়টা খানিকটা বাস্তব অর্থে বুঝে নেওয়ার রসদ আমরা ডেউচা-পাঁচামির কয়লার উপরের পাথরের স্তরটা থেকেই পেয়ে যেতে পারি। বীরভূম-পশ্চিম বর্ধমানের এই পাথরের স্তরই আমাদের বাড়ি-রাস্তা বানানোর স্টোন চিপস ও আর বহু রকম পাথর সংক্রান্ত প্রয়োজন মেটায় গত প্রায় ৬ দশক ধরে। ১৯৬০-এর দিকে দক্ষিণবঙ্গ ও বিশেষত কলকাতার প্রয়োজন মেটাতে এই এলাকা জুড়ে গড়ে উঠতে থাকে পাথর খাদান ও স্টোন-ক্রাশার ফ্যাক্টরি, যার একটা উল্লম্ফন হয় আশির দশকের শেষ দিক থেকে। দুর্বল কৃষি ও তাঁত শিল্প থেকে প্রচুর মানুষ বেরিয়ে এসে এই কাজে লেগে পড়েন বেশি রোজগারের আশায়। এই পাথর শিল্প প্রচুর মুনাফার জন্ম দেয় ও সস্তা শ্রমিকের প্রয়োজনীয়তা ক্রমশই বাড়তে থাকে। চরিত্রগত দিক থেকে এই শিল্পের সঙ্গে ডেউচা-পাঁচামির অনেক সাদৃশ্য আছে কারণ এ ক্ষেত্রেও প্রাকৃতিক সম্পদ সরাসরি তুলে নিয়ে ব্যবহার করাটাই লক্ষ্য। ছয় দশকের অভিজ্ঞতা বলে যে, এই পাথরশিল্প ব্যাপক ভাবে দ্রুত নগরায়ণের কাজে লেগেছে, সারা রাজ্যের প্রচুর মানুষ এখানে খুব সামান্য মজুরিতে কাজ করেছেন এবং নিশ্চয়ই সেই মজুরি তাদের অন্যান্য রোজগারের সম্ভাবনার চেয়ে বেশি থেকেছে। অর্থাৎ একটা বড় কর্মসংস্থানের বন্দোবস্ত করেছে। কিন্তু একটু গভীরে ঢুকলেই একটা ভয়ঙ্কর ছবি দেখা যায়। দেখা যায় যে, এই শিল্পের অধিকাংশটাই থেকেছে বেআইনি— যেখানে সব আইনের আওতার বাইরে একটা কালো অর্থনীতি ডালপালা মেলেছে, যেমনটা প্রায় সমস্ত খনি এলাকায় ঘটে থাকে। আইনের আওতার বাইরে থাকার ফলে যেমন খুশি পাহাড়ের পাথর কাটা, জল ও বাতাসের দূষণ ঘটানো এবং শ্রম আইনের তোয়াক্কা না করে মজুর খাটানোর মুক্তাঞ্চল হয়ে উঠেছে এলাকাটি। সর্বোপরি এই ভয়াবহ বন্দোবস্তে অসংগঠিত পাথরশ্রমিক এবং এলাকার বাসিন্দারা নিশ্বাসের সঙ্গে পাথরের গুঁড়ো ফুসফুসে ভরে নিয়ে পেয়েছেন এক মারণরোগ, সিলিকোসিস— যে রোগে মৃত্যু অনিবার্য। আজও পর্যন্ত সরকারের কাছে এই রাজ্যের সম্ভাব্য সিলিকোসিস রোগীর কোনও খতিয়ান নেই। হালে সিলিকোসিস নিয়ে হইচই হওয়াতে এখন সরকারবাহাদুর কিছু ক্ষতিপূরণ ইত্যাদি দিয়ে দায় সারতে চাইছেন। কারখানা মালিকরাও নাকি উন্নত প্রযুক্তি এনে গতরখাটনি শ্রমিকের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য ভাবে কমিয়ে দিয়েছেন, যাতে আর সিলিকোসিসের ঝামেলা না পোহাতে হয়। অবশ্যই এই বদলের মাধ্যমে এলাকার বাসিন্দাদের সিলিকোসিসের সমস্যার সমাধান হচ্ছে না, এলাকার বায়ুদূষণ ও জলদূষণও থাকছে একই রকম। অন্য দিকে, সিলিকোসিস নিয়ে হইচই করা ‘বোকা’দের দাগানো যাচ্ছে ‘উন্নয়নবিরোধী’ বলে, দোষারোপ করা যাচ্ছে যে, এই সব করে খামোকা কিছু গরিব মানুষের কাজ খেয়ে নেওয়া হল! অর্থাৎ ঠান্ডা মাথায় বিচার করলে দেখা যাচ্ছে যে, ছয় দশকে এই শিল্পের সুফলটা ভোগ করলেন শহরবাসী মানুষ আর চকচকে মেগাসিটি। অন্য দিকে, ক্ষতটা নেমে এল মহম্মদবাজারের পাহাড়-জঙ্গলের উপর, সেখানকার বাসিন্দা আদিবাসীদের উপর। পরিযায়ী শ্রমিকরা মৃত্যুবাহী শ্বাসকষ্ট নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার আগে পর্যন্ত পেলেন দৈনিক বড়জোর ৬০০ টাকা।
পরিবেশবাদীরা বলছেন, এই ভাবে প্রকৃতির ধ্বংস করা চলে না, কারণ মানবসভ্যতার জন্যই এর দাম পড়বে বড্ড বেশি। তা শুরুও হয়ে গিয়েছে। সমাধান একটাই— মানুষকে নিজেকে এই প্রকৃতির অংশ হিসাবে চিনে নিতে হবে। বিজ্ঞানও একই কথা বলে। এই ভারসাম্য খুঁজে বার করাটাই আজকের প্রগতিশীল রাজনীতির কাছে বড় চ্যালেঞ্জ হওয়া উচিত।
ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স, কলকাতা