দিনবদলের স্বপ্ন ছিনতাই
Democracy

কাজ়াখস্তানের রাজনৈতিক সঙ্কটে গণতন্ত্রের স্বপ্ন ক্রমে অলীকতর

ছিনতাই হওয়া আন্দোলনের নিষ্ঠুর পরিহাসের প্রেক্ষিতে অদূর ভবিষ্যতে গণতন্ত্রের রামধনু অলীক।

Advertisement
সব্যসাচী বসু রায়চৌধুরী
শেষ আপডেট: ২১ জানুয়ারি ২০২২ ০৪:২৯
দ্বন্দ্বভূমি: কাজ়াখস্তানে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশবাহিনীর সংঘর্ষের ভিডিয়ো-ছবি, ৫ জানুয়ারি।

দ্বন্দ্বভূমি: কাজ়াখস্তানে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশবাহিনীর সংঘর্ষের ভিডিয়ো-ছবি, ৫ জানুয়ারি। রয়টার্স।

এমন একটা ঝড় উঠুক, চাইছিলেন কাজ়াখস্তানের অনেকেই। তবে শেষ অবধি সাত-দশ দিনের ঝড়ে কাজ়াখস্তানের জন্য নতুন ভোরের দিশা পাওয়া গেল কি?

দেশের প্রাকৃতিক গ্যাসের ভান্ডার সানগিসতাউ প্রদেশে ঝড়ের সূচনা। কাস্পিয়ান সাগরের তীরবর্তী কাজ়াখস্তানের পশ্চিম প্রান্তের প্রদেশের জানাওজ়েন শহরের বেশ কিছু মানুষ প্রথমে প্রতিবাদে রাস্তায় নামেন। পেট্রোপণ্যের প্রাণকেন্দ্র শহরটির প্রায় নব্বই শতাংশ যানবাহন যেখানে এলপিজি (লিকুইফায়েড পেট্রোলিয়াম গ্যাস) দিয়ে চালিত, সেখানে নববর্ষে সেই জ্বালানির দাম রাতারাতি দ্বিগুণ হয়ে গেলে মানুষের এই ক্ষোভ তো প্রত্যাশিত। কিন্তু মধ্য এশিয়ার বৃহত্তম এবং জ্বালানির ভান্ডারে সমৃদ্ধ এই দেশটিতে কি তা আদৌ প্রত্যাশিত?

Advertisement

সাবেক সোভিয়েট ইউনিয়নের ভাঙনের পরে মধ্য এশিয়াতে যে পাঁচটি স্বাধীন, সার্বভৌম দেশের জন্ম হয়েছিল, তার মধ্যে রাজনৈতিক বিচারে এই কাজ়াখস্তান সবচেয়ে স্থিতিশীল, নিস্তরঙ্গ। তবে বিগত তিন দশকে দেশের একচ্ছত্র অধিপতি প্রেসিডেন্ট নুর সুলতান নাজ়ারবায়েভের তীক্ষ্ণ নজরদারি এড়িয়ে কার্যত কোনও কিছুই যেখানে ঘটতে পারেনি, সেখানে ২০১১-র ডিসেম্বরে এই জানাওজ়েন শহরেই কেবল বিদ্রোহ করেছিলেন মানুষ। দিন দুয়েকের মধ্যে সরকার কড়া হাতে সেই বিদ্রোহ দখল করে। জনা বিশেক মানুষ সে বারে মারা গিয়েছিলেন, আটক হয়েছিলেন বহু মানুষ।

চরম স্বৈরাচারী নাজ়ারবায়েভের কাজ়াখস্তানে তাঁরই শাসনকালে সরকারি উদ্যোগে বহু শহরে নিজস্ব মূর্তি বসানো হয়েছিল। ব্যক্তি-অর্চনার এই রাজনৈতিক ঐতিহ্যে বিরোধিতা, আন্দোলন, বিদ্রোহের বিন্দুমাত্র ঠাঁই ছিল না। অথচ সেই দেশেই কিনা এ বার অচিরে অন্য বেশ কিছু শহরে, এমনকি রাজধানী নুরসুলতান এবং প্রধান বাণিজ্যনগরী আলমাটিতেও আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ল! বহুজাতিক সংস্থা শেভ্রন পরিচালিত কাজ়াখস্তানের বৃহত্তম তৈলক্ষেত্রের ঠিকা কর্মীরাও প্রতিবাদী হওয়ায় অনেকের ভেবেছিলেন যে, এ বারের আন্দোলন সুদূরপ্রসারী। তেল-গ্যাস-ইউরেনিয়াম’সহ জ্বালানি সম্পদই দেশটির যাবতীয় সমৃদ্ধির চাবিকাঠি। সুতরাং তার সঙ্গে যুক্ত মানুষদের একাংশের এই আন্দোলনে শামিল হওয়া নিঃসন্দেহে তাৎপর্যবহ।

এ বারের আন্দোলনের স্বতঃস্ফূর্ততা তীব্র আর্থিক বৈষম্য, দারিদ্র, মূল্যবৃদ্ধি এবং লাগাতার স্বৈরাচারী শাসনের সাপেক্ষেই। ২০১৯-এর একটি সমীক্ষা অনুযায়ী, প্রায় দু’কোটি মানুষের এই বৃহৎ দেশের অর্ধেক সম্পদের মালিক মাত্র ১৬২ জন। আয়তনের বিচারে কাজ়াখস্তান সমগ্র পশ্চিম ইউরোপের সমান। সোভিয়েট-পরবর্তী ইউরেশিয়াতে আয়তনের দিক থেকে রাশিয়ার পরেই কাজ়াখস্তানের স্থান।

ভূ-রাজনৈতিক ও ভূ-অর্থনৈতিক দিক থেকে বিশেষ ভাবে গুরুত্বপূর্ণ দেশটির রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও স্থায়িত্ব গত ত্রিশ বছর ধরে আকর্ষণ করেছে অগণিত পশ্চিমি, রুশ, তুর্কি ও চিনা বিনিয়োগকারীকে। পাশ্চাত্যের দেশগুলির সরকার কাজ়াখস্তানের একনায়কতন্ত্র বা ‘অনুদার গণতন্ত্র’ নিয়ে তীব্র অস্বস্তিতে থাকলেও এখানকার জ্বালানির বিপুল ভান্ডারের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখার কোনও জো তাদের ছিল না।

এই বিনিয়োগ নাজ়ারবায়েভের সরকারকে আরও সুদৃঢ় করেছিল। ব্যাপক দুর্নীতির সুবাদে তাঁর ও প্রেসিডেন্টের নিকট পরিজনদের সম্পদের পরিমাণও বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে বলে অভিযোগ। লন্ডন-সহ পশ্চিমের বহু বড় শহরে তাঁদের ফুলেফেঁপে ওঠা সম্পদের প্রভূত নজিরও বর্তমান। অত্যন্ত কুশলী এবং দেশের অবিসংবাদী একনায়কটি পশ্চিমি সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে একাধিক বারই বলেছেন কাজ়াখস্তানের অর্থনীতিই তাঁর কাছে প্রধান। বলেছেন, দেশে গণতন্ত্র ও বাজার অর্থনীতি প্রসারে তিনি সর্বদা সচেষ্ট। ২০১৯-এর মার্চ মাসে ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়াবার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন এবং মাস তিনেক পরের নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট পদে তিনি আর প্রার্থী হননি। তাঁর স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন তাঁরই একান্ত অনুগত কাসিম-জোমার্ত তোকায়েভ।

প্রাথমিক ভাবে এই চমকপ্রদ ঘটনাকে গুরুত্বপূর্ণ এক রাজনৈতিক পর্বান্তর মনে হলেও অবিলম্বে ভুল ভাঙে। প্রেসিডেন্ট হয়ে তোকায়েভের প্রথম পদক্ষেপ ছিল দেশের রাজধানীর নতুন নামকরণ। রাজধানী আস্তানার নাম বদলে নুরসুলতান রেখে দিয়েছেন গুরুদক্ষিণা। দ্রুত প্রমাণিত হয়েছিল যে, এ শুধু মুখ-বদল। ক্ষমতার প্রকৃত রাশ এখনও নাজ়ারবায়েভের হাতেই। শাসক দল নুর ওটান-এর প্রধান তিনি। দেশের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের নেতাও তিনি। তাঁর কন্যা দারিগা সিনেটের প্রধানের পদে এলেন। দেশের পুলিশি ব্যবস্থা, নিরাপত্তা সবই তাঁর বা তাঁর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ জনদের হাতে।

দেশের অধিকাংশ মানুষের দুর্দশার মূলে যে তিনিই, তা অজানা ছিল না। আর তাই স্বতঃস্ফূর্ত, সুনির্দিষ্ট নেতৃত্ববিহীন আন্দোলনকে বাগে আনতে প্রথমে প্রেসিডেন্ট তোকায়েভ পরবর্তী ১৮০ দিন জ্বালানির দাম বৃদ্ধি স্থগিত রেখে স্থিতাবস্থা ফেরাতে চেষ্টা করলেও দেশের বহু শহরে স্লোগান উঠল: ‘বুড়ো, এ বার দূর হটো’। নিজের প্রতিভূ তোকায়েভের মাধ্যমে ক্ষমতা ধরে না রেখে সরাসরি প্রশাসন নিয়ন্ত্রণে সচেষ্ট হলেন ‘জাতির জনক’ নুরসুলতান। স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের চরিত্র বদল ঘটল। আলমাটি বা নুরসুলতান শহরে লুটতরাজ, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, দাঙ্গার পুরোভাগে চলে এলেন অপরাধ জগতের কিছু চাঁই।

তোকায়েভও অনেক আক্রমণাত্মক হয়ে উঠলেন। যে আন্দোলনকে তিনি নিজেই গোড়ায় ‘স্বতঃস্ফূর্ত’ আখ্যা দিয়েছিলেন, সেই তিনিই বললেন, এই আন্দোলন আদতে দস্যুদের দ্বারা, বিদেশে প্রশিক্ষিত সন্ত্রাসবাদীদের দ্বারা পরিচালিত। নিজের সরকারকেই তিনি বরখাস্ত করলেন। বরখাস্ত করা হল দেশের সন্ত্রাস দমন সংস্থার প্রধানকে। গ্রেফতার হলেন তিনি। বরখাস্ত হলেন নাজ়ারবায়েভও।

ঘটনার এই নাটকীয় মোড়ে আপাত লাভবান কিন্তু রাশিয়া ও চিন। উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলাতে বহুলাংশে নাজ়ারবায়েভ-প্রভাবান্বিত নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে আদৌ নির্ভরযোগ্য মনে না হওয়ায় তোকায়েভ সরকার শরণাপন্ন হয় বস্তুত রুশ নিয়ন্ত্রিত কালেকটিভ সিকিয়োরিটি ট্রিটি অর্গানাইজে়শন (সিএসটিও)-এর। তিন দশকের সংস্থাটি অতীতে কোনও সদস্য দেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে হস্তক্ষেপ না করলেও পশ্চিমি দুনিয়ার নেটোর অনুরূপ এবং ওয়ারশ চুক্তি সংস্থার উত্তরসূরী আকাশপথে ও স্থলপথে কাজ়াখস্তানে ‘শান্তিরক্ষী বাহিনী’ পাঠাতে বিলম্ব করেনি। প্রেসিডেন্ট তোকায়েভের বিপদের দিনে সামরিক রাজনৈতিক ও নৈতিক সমর্থন জুগিয়েছে পুতিনের রাশিয়া। উল্লেখ্য, কাজ়াখস্তানের প্রায় কুড়ি-বাইশ শতাংশ মানুষ রুশ বংশোদ্ভূত এবং তাঁদের অধিকাংশ দেশের উত্তরাংশে রুশ সীমান্ত সংলগ্ন অঞ্চলের অধিবাসী। এক অর্থে এই রুশীরা মধ্য এশিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই দেশটিতে মস্কোর প্রভাব বৃদ্ধির সম্ভাব্য পাসওয়ার্ড। তোকায়েভের সঙ্কট পুতিনকে এই পাসওয়ার্ড হস্তগত করতে কতটা সাহায্য করে, সময় তা বলবে।

অন্য দিকে, সোভিয়েট-পরবর্তী এই রাজনৈতিক পরিসরটিতে ক্রমশ প্রভাব বৃদ্ধিকারী চিন ইতিমধ্যেই তোকায়েভ সরকারের পাশে থাকার অঙ্গীকার করেছে। বেজিং শীতকালীন অলিম্পিকের আসরে তাঁকে পুনরায় আমন্ত্রণ জানিয়েছে এবং তাঁর পূর্ণ নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে বেজিং রাশিয়া-কাজ়াখস্তান-চিনের ত্রিপাক্ষিক রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্কের দীর্ঘ ঐতিহ্যের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। উত্থাপিত হয়েছে অভিন্ন স্বার্থের শাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজ়েশন এবং চায়না রেলওয়ে এক্সপ্রেসের কথাও। রাশিয়া এই ধরনের হঠকারী আন্দোলন প্রতিহত করতে সহায়ক হয়ে থাকলে চিন আগামী দিনে কাজ়াখস্তানের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের শরিক হয়ে এই ধরনের আন্দোলনের বীজকে অঙ্কুরেই বিনাশ করার অংশীদার হয়ে উঠতে উৎসাহী।

এই পরিবর্তিত প্রেক্ষাপট নয়াদিল্লির পক্ষেও উদ্বেগের। গত বছরের গোড়ায় মায়ানমারের সামরিক অভ্যুত্থান এবং অগস্টে আফগানিস্তানের রাজনৈতিক পালাবদল ভারতের প্রতিবেশ অস্থির করেছেই। এ বার কাজ়াখস্তান ২.০। অতএব, সাধু সাবধান!

নতুন এই অবতারে সে দেশের সাধারণ মানুষের অধিকার খর্ব হওয়ার আশঙ্কাই বেশি। সংবাদমাধ্যম, সমাজমাধ্যম ও অসরকারি সংগঠনগুলির উপরে অধিকার নিয়ন্ত্রণও অনিবার্য। ছিনতাই হওয়া আন্দোলনের নিষ্ঠুর পরিহাসের প্রেক্ষিতে অদূর ভবিষ্যতে গণতন্ত্রের রামধনু অলীক।

রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন
Advertisement