Education

স্কুলের বাইরেও শিক্ষার ব্যবস্থা

পাঠশালা আবার বন্ধ হওয়ায় সমাজমাধ্যমে অন্য বারের তুলনায় কিঞ্চিৎ জোরালো আপত্তি আর অসন্তোষের স্বর।

Advertisement
শৈবাল বসু
শেষ আপডেট: ২১ জানুয়ারি ২০২২ ০৪:২৯

জানুয়ারি মাসের তিন তারিখ। নতুন করে বন্ধ হল স্কুল। শিক্ষকরা স্কুলে বসে তৈরি করছি একাদশ শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের তালিকা, এমন সময় সামনে এসে দাঁড়াল মলিন ছাপা কাপড়ের মাস্কে ঢাকা একটি মুখ। মিনতি বর্মণ। বাবা টোটো চালান, মা লোকের বাড়িতে ঠিকা কাজ করেন। প্রশ্ন করে, “স্যর, আমাদের আর ক্লাস হবে না?” বাইরে দাঁড়িয়ে একঝাঁক কিশোরী। “আপনি বললেন ওদের পাড়ায় যাবেন পড়া দেখিয়ে দিতে। আমাদের মুন্ডাবস্তিতে আসবেন এক দিন, স্যর?”

পাঠশালা আবার বন্ধ হওয়ায় সমাজমাধ্যমে অন্য বারের তুলনায় কিঞ্চিৎ জোরালো আপত্তি আর অসন্তোষের স্বর। পাল্টা যুক্তিটাও এত দিনে পরিচিত— সে যুক্তির সবটাই যে উড়িয়ে দেওয়া যায়, তা-ও নয়। তবু, এক দিকে বারে বারে ফিরে আসা ব্যাধির হুমকি, আর অন্য দিকে পাঁচ থেকে তেরো বছর বয়সি স্কুলপড়ুয়াদের পড়াশোনা প্রায় স্তব্ধ হয়ে থাকা, এই দুইয়ের মাঝখানে উঠে আসে কয়েকটি প্রশ্ন।

Advertisement

আমরা— অধিকাংশ শিক্ষক— গত দু’বছরের প্রায় লেখাপড়াহীন স্থবির সময় জুড়ে কোনও গঠনমূলক বিকল্পের ছবি তৈরি করতে পারিনি, এমনকি নিজেদের কাছেও। কোনও কোনও নিষ্ঠাবান সংগঠন বা সমাজকর্মীর উদ্যোগে কিছু ‘কমিউনিটি ক্লাস’ চলেছে। কিন্তু তাদের পদ্ধতি অন্যদের প্রয়োগে উৎসাহিত করা হয়নি। সরকার কেন্দ্রীয় ভাবে ‘অ্যাক্টিভিটি টাস্ক’ দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে, উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে কিছু পরিশ্রমী স্কুল নিজেদের উদ্যোগে অনলাইন ক্লাস করেছে— সরকারের অনুদান হিসাবে পাওয়া হাতের স্মার্টফোনটি সে ক্ষেত্রে পড়ুয়াকে এই অনলাইন ক্লাস করার ‘স্ব-ক্ষমতা’ দিয়েছে। এমন বিচ্ছিন্ন কিছু আশাব্যঞ্জক ছবি ছাড়া এই দুইটি বছর ধরে সরকার ও শিক্ষকরা মিলে কোনও গ্রহণযোগ্য বিকল্প তৈরি করতে পারেননি, যা পড়াশোনাটুকু ধারাবাহিক ভাবে চালু রাখবে।

এ বারে জানুয়ারির তিন তারিখে স্কুল বন্ধের যে সরকারি আদেশনামা জারি হয়েছে, তার একটি অংশে বলা হয়েছে যে, শিক্ষক পড়ুয়ার বাড়ি গিয়ে তার পড়াশোনার বিষয়ে সাহায্য করতে পারেন। যেন কিছুটা সংযোজনের ভঙ্গিতে বলা এই বয়ানটির মধ্যে কিন্তু লুকিয়ে রয়েছে এক মহৎ বিকল্পের ইশারা। সরকারের এই অনুমোদন বা পরামর্শটি, হয়তো সচেতন ভাবে না হলেও, যেন পুরোমাত্রায় কেন্দ্রীয় ভাবে নিয়ন্ত্রিত একটি ব্যবস্থার মধ্যে বয়ে আনে বিকেন্দ্রীকরণের জরুরি বার্তা। এই বার্তা শিক্ষক ও পড়ুয়ার মধ্যে সরাসরি পঠনপাঠন আর সামাজিক সংযোগের সত্যটিকে মর্যাদা দেয়। একটু এগিয়ে গিয়ে এমন কল্পনাও মনে আসে যে, অদূর দিনে ‘দুয়ারে শিক্ষক’-এর মতো একটি গভীর ভরসার স্লোগান উঠে আসতে পারে শিক্ষার উঠোনে। সামাজিক দায়ের তাগিদে স্কুলবাড়ি নামক একটি অমোঘ স্থাপত্যের বাইরে ছড়িয়ে যেতে পারে পাঠ।

ছাত্রদের প্রয়োজন বুঝে সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা শিক্ষকদের যদি দিতে পারে সরকার, তা হলে কেমন হয় যদি স্কুলগুলোকে সেই রকম ভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ দেওয়া যায়? আমাদের রাজ্যে সরকার-অনুমোদিত স্কুলগুলিতে পরিচালন সমিতি আছে, তাতে শিক্ষক, অভিভাবক, শিক্ষানুরাগী, সরকারের প্রতিনিধি, এবং স্বাস্থ্যবিভাগের এক জন আধিকারিক থাকেন। আমাদের বেশির ভাগ স্কুলই গ্রামে। সর্বত্র না হলেও, এখনও অনেক গ্রামে স্কুলবাড়ির সামনের মাঠে বিকেলে বাচ্চারা দল বেঁধে খেলে। সেই মাঠে দূরত্ব ও বিধি মেনে অনুকূল সময়ে চলতে পারে পাঠ। সেই সিদ্ধান্ত ও স্থানীয় দেখভালের ভার নজরদারি স্কুল পরিচালন কমিটির পাশাপাশি ন্যস্ত হতে পারে জেলার শিক্ষা আধিকারিকদের, বিদ্যালয় পরিদর্শক ও পঞ্চায়েত সমিতির উপর। স্বাস্থ্য দফতর, আশাকর্মীরাও পাশে থাকবেন। এই বিকেন্দ্রীকরণ মানে কিন্তু কখনওই কেন্দ্রচ্যুত হওয়া নয়। আমাদের দেশে নির্বাচনের সময়ে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণের অধীনে ছোট ছোট পোলিং ইউনিট যেমন অধিকার ও দায়িত্ব পালন করে, ঠিক তেমন।

সরকারি আদেশনামায় অনলাইন ক্লাসের সঙ্গে বলা হয়েছে অন্য বিকল্পের কথা। সরকার পন্থা বাতলে দেয়নি। সব কিছু বাতলে দেওয়া সরকারের কাজ নয়— পন্থাই আমাদের ভাবতে হবে। কয়েক দিন আগে মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন যে, পড়ুয়াদের মধ্যে সাঙ্গীতিক রুচি তৈরি করতে কিছু ভাল গান ওদের সরকারপ্রদত্ত ট্যাব বা স্মার্টফোনেই ভরে দেওয়া যায়। খুব সুন্দর ভাবনা। আমরা তো সরকারকে অনুরোধ করতে পারি ওই ফোনে এর সঙ্গে থাকুক ভাষা, সাহিত্য, গণিত বিজ্ঞানের প্রাঞ্জল পাঠ। ভাল রেকর্ডিংয়ে। সিলেবাস কমিটি সময়ের দাবিতে নতুন করে ভাবুক। মিড-ডে মিলের চালের সঙ্গে চলনসই ডেটা প্যাক দেওয়া হোক পড়ুয়ার হাতে। সেটা হবে তার মনের খাদ্যের একটি আবশ্যিক উপাদান।

মারি নিয়ে ঘর করা কবে শেষ হবে তা তো জানি না। তাই নতুন করে সরস্বতীর আসনটির কথা ভাবতে হবে। বড় দেরি হয়ে যাচ্ছে।

আরও পড়ুন
Advertisement