আমাদের ছোটবেলাটা ছিল গল্পবইতে ভরা। তখন মনে করা হত, গল্পবই এবং বিশ্বকোষ বা জ্ঞানের আলোর মতো বই পড়লে মনের প্রসার বাড়ে। যে কোনও ছুতোয় উপহার জুটত গল্পবই, জন্মদিন থেকে শুরু করে পুজো অবধি বই। ইস্কুলের প্রাইজ় মানেও শুধু বই। এই সব বইয়ের ভিতরে ডুবে থাকতাম আমরা। আর নিজের অজানতেই মাথার জমিটা তৈরি হয়ে যেত।
এই ভাবেই আমার মনে জমি হয়ে থেকে গেল নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র, উপেন্দ্রকিশোর- সুকুমার-সত্যজিতের লেখা। টেনিদা, ঘনাদা, ফেলুদারা প্রায় আত্মীয়স্বজন হয়ে গেল। রায় পরিবারের যে তিন জনের নাম সর্বাগ্রে বললাম তাঁরা তিন জনই পুরুষ। কিন্তু বাকি অনেকেই তো মহিলা! আমার মনে পড়ে ইস্কুলের প্রাইজ়ে পাওয়া প্রথম প্রিয় বই, পুণ্যলতা চক্রবর্তীর ছেলেবেলার দিনগুলি গোগ্রাসে পড়া! তা ছাড়া সুখলতা রাও। আর লীলা মজুমদার, অবশ্যই। দিনদুপুরে, টংলিং থেকে শুরু করে বড় হতে হতে পড়া স্মৃতিগ্রন্থ আর কোনোখানে, পাকদন্ডী, খেরোর খাতা। আর ছিলেন নলিনী দাশ। পরে বলব তাঁর কথা আরও, এখন কেবল বলি, তিনি, লীলা মজুমদার আর সত্যজিৎ রায় মিলে চালাতেন সুকুমার রায়ের তৈরি করা পত্রিকা সন্দেশ।
মনে পড়ে, আমি বসে বসে এঁদের ‘ফ্যামিলি ট্রি’ বা বংশলতিকা লিখতাম। ভাবটা— যেন দেখেছি এঁদের সবাইকেই। আসলে আমার ছোটবেলা আর এঁদের ছোটবেলা মিলেমিশে যেত কোথাও। এতটাই প্রিয় ছিল আমার মনের সেই মাটি, আমার মনের ভিত্তিভূমি এই সব লেখা, কথা...।
এখন যে ভাষায় আমরা কথা বলি, তার ভিতরে ঢুকে আছে আমাদের মনের এই পরিবারের লোকদের তৈরি করা নানা কথা, ভাবনা। লালমোহনবাবুর মতো করেই আমরা বলি ‘হাইলি সাসপিশাস’! কিংবা ফেলুদার মতো করে, “নিশ্চিন্ত আর থাকা গেল না রে তোপসে।”
তবে কিনা, ছোটবেলার এই মনের জমি নিয়ে ইদানীং আমার কেমন ‘সাসপিশাস’ লাগছে। মনে হচ্ছে, না, নিশ্চিন্ত আর থাকা যাচ্ছে না সন্দেহটা ‘শেয়ার’ না করে। কথাটা হল এই যে, এত এত ‘টেক্সট’ আমাদের পূর্ববর্তী প্রজন্মের হাত থেকে এল আমাদের হাতে... এর ভিতরে কী কী যেন নেই! ইংরেজিতে একটা কথা আছে না? ‘কনস্পিকিউয়াস বাই অ্যাবসেন্স’, সেই রকম। একটা জায়গা, যেখানে কোনও কিছু, বা কেউ একটা নেই। আমাদের সেই মনোজগতের ইটকাঠমাটিতে ঠিক কী নেই? কী ছিল না? — নারী-চরিত্র! মেয়েরা নেই সেখানে।
ছোটবেলাতেও কিন্তু খটকা লাগত। নলিনী দাশের ‘গণ্ডালু’-রা ছাড়া মেয়ে নেই কেন আমাদের পড়া সেই সব গল্পে? একটা শব্দ মাঝেমধ্যেই চোখে এসে ঠিকরে লাগত, ছোটদের অভিনয়ের জন্য লেখা নাটকের বই থেকে নেওয়া শব্দ: স্ত্রীচরিত্র-বর্জিত।
ঠিকই, সব কিছুকেই, বিশেষত সাহিত্যকে, ইতিহাসের নিরিখে দেখতে হবে, বিচার করতে হবে। তখনকার সমাজ ছিল আলাদা। ইস্কুলে-কলেজে ছেলেরাই তো বেশি পড়ত তখন। পাড়ায় গানবাজনা নাটক, সব ছেলেই করত। নাটক মঞ্চস্থ করার সময়েও তাই খোঁজ পড়ত এমন নাটকের, যেখানে মেয়েদের চরিত্র নেই।
কিংবা যদি থাকে, অগত্যা ছেলেদেরই মেয়ে সাজতে হত। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের একটি গল্পেও পাচ্ছি, নাটক হবে পাড়ায়, খোঁজ পড়ছে সুন্দর দেখতে ছেলেদের যাতে মেয়ে সাজানো যায়। কোনও ফরসা ছেলে হয়তো নায়কের থেকে এক আঙুল লম্বা, ব্যস, সে বাতিল। কারও গলার স্বর খসখসে, সে বাতিল। সবচেয়ে সহজ সমাধান, স্ত্রীচরিত্র-বর্জিত নাটক। সুকুমার রায়ের অতগুলো নাটক আমাদের প্রিয় ছিল— ঝালাপালা, চলচিত্তচঞ্চরী, লক্ষ্মণের শক্তিশেল। কোত্থাও মেয়েদের নামগন্ধ নেই।
মেয়েদের অভিনয় করার প্র্যাকটিক্যাল অসুবিধার কারণটা ঘুচে গেল সম্ভবত পঞ্চাশ-ষাট দশক থেকে। দেশভাগের পর উদ্বাস্তু মেয়েদের বাধ্য হতে হয়েছে রুজিরুটির জন্য ঘরের অবরোধ থেকে বেরিয়ে আসতে। বেশি বেশি করে মেয়েদের দেখা গিয়েছে নাট্যমঞ্চে, সিনেমায়। সরাসরি ও পার বাংলা থেকে আসা নায়িকা, অসামান্য অভিনেত্রী সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় নিজের স্মৃতিকথা সত্যি সাবিত্রী-তে সেই অভিজ্ঞতার গল্প বলেছেন। মেয়েদের দেখা গিয়েছে পাড়ার মঞ্চ থেকে রেডিয়োর নাটকে, আজকে তো শ্রুতিনাটক, বাচিক শিল্প আর গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনের সুবাদে নাট্যমঞ্চে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন মেয়েরা।
কিন্তু কিশোর বা শিশুসাহিত্য কি আজও হেলে আছে ছেলেদের দিকে? বিভূতিভূষণ এনেছিলেন অপুর দিদি দুর্গাকে, বা লীলাকে। কিন্তু সত্যজিৎ রায় তো বিশের দশকের সুকুমার রায়ের প্রজন্মের নন, তবু তিনি কেন এত স্বচ্ছন্দ হবেন শুধুই পুরুষ চরিত্র নির্মাণে, ছোটদের গল্প থেকে পুরো বাদই দেবেন মেয়েদের? এমনকি জয় বাবা ফেলুনাথ-এ ছোট ছেলে রুকু-র মা কেমন নীরব ও বক্তব্যহীন। ছেলের বিপদ বা বেপরোয়া খেলা সম্বন্ধে তাঁর কোনও বক্তব্য নেই! এক আশ্চর্য উদাসীনতা এই সব পার্শ্বচরিত্রকে একেবারে অদৃশ্য করে দিয়েছে।
‘পথি নারী বিবর্জিতা’ বলে একটা সংস্কৃত বচন আছে না? ভ্রমণকালে মেয়েদের নাকি সঙ্গে নিতে নেই, এই কথা আমাদের স্মৃতিশাস্ত্রের। তাই কি যত অ্যাডভেঞ্চার কাহিনি, সব নারীচরিত্র-বর্জিত? অ্যাডভেঞ্চার শব্দটাই আসলে আমাদের আশৈশবের মনের পটে ছেপে বসে যায় এই পুরুষপ্রাধান্যের প্রেক্ষাপটে।
সত্যিই কিন্তু, ধন্য দিই নলিনী দাশের মতো লেখককে। ওই পরিবারের সদস্য হিসাবে, সন্দেশ পত্রিকার সম্পাদনার সূত্রে তিনিই প্রথম গণ্ডালু নামের চার খুদে মেয়ে গোয়েন্দার সূত্রপাত করেছিলেন! একটা ছোট্ট বিপ্লব বলা যায়। লীলা মজুমদারের লেখা যে এত প্রিয়, কিন্তু ‘মাকু’ গল্প ছাড়া তাঁরও বেশ কম লেখাতেই আমরা মেয়েদের পাই। ‘মাকু’-তে অবশ্য ছোট্ট দিদি সোনা আর ছোট্ট বোন টিয়া বাড়ি থেকে পালিয়ে ‘কালিয়ার বনে’ চলে যায়, অনেক রোমাঞ্চকর কাণ্ড করে ফেলে। লীলা মজুমদার যেন এক গল্পে মিটিয়ে দেন তাঁর অনেক গল্পে মেয়েদের অনুপস্থিতির ‘দাম’।
আসলে, ভ্রমণ, যাত্রা, রহস্য ইত্যাদির সঙ্গে বহু যুগ পুরুষের একচেটিয়া সম্পর্ক। চাঁদের পাহাড় থেকে হালের অ্যাডভেঞ্চার কাহিনিগুলো অবধি। এই সব নায়কের সহকারী বা সাইড-কিক’রাও পুরুষ। সম্প্রতি এই ট্রেন্ড সামান্য হলেও ভেঙেছে, এই বাঁচোয়া। পাহাড়ে-চড়া মেয়ে পূর্ণার বায়োপিক কাহিনি পূর্ণা (২০১৭) সেলুলয়েডে এসেছে।
এই নীরবতার রাজনীতি বা মেয়েদের অদৃশ্য রাখার ধারার সঙ্গে আমাদের যুগসঞ্চিত নারীবিদ্বেষের একটা সম্পর্ক দেখলে ভুল হবে কি? আমাদের সংস্কৃতি তো এক ধরনের নৈতিকতার সংস্কৃতি, যেখানে ‘সাবজেক্ট’ পুরুষ, ‘প্রেডিকেট’ নারী। সেখানে কামিনীকাঞ্চন উভয়ের থেকে দূরে থাকার উপদেশ মেলে। শাস্ত্রে বলে, “স্ত্রিয়াশ্চরিত্রং পুরুষস্য ভাগ্যং/ দেবা ন জানন্তি কুতো মনুষ্যাঃ”। সেই তো। নারীর তো ভাগ্য নেই-ই! যার মুখ্য বা গৌণ কোনও চরিত্রই নেই, তার আবার ভাগ্য কী।
এই দর্শনই আবার বলে না, নারী নরকের দ্বার? হয়তো সুকুমার কিশোরদের মনে নারীর সঙ্গ আর অনুষঙ্গ, দুই-ই ক্ষতিকর, এমন ভাবনা কোথাও আমাদের মধ্যে এখনও রয়ে গিয়েছে। মেয়েদের পাশে পেলে আর পড়াশোনায় মন থাকবে না। অবাধ, অন্যায় আকর্ষণ তৈরি হবে। ঘি-আগুন এক সঙ্গে রাখতে নেই, এ হল মনুস্মৃতিবাহিত ঐতিহ্য।
তাই স্ক্রাবার ও সাবান চাই, চাই ঝকঝকে পবিত্র নারীবর্জিত কিশোর সাহিত্য। ইদানীং অবশ্য অ্যাডভেঞ্চার কাহিনিতে কিশোরীরা ঢুকছে, তবে একটা ‘গার্লফ্রেন্ড’ মডেলে। মিশর রহস্য বা গুপ্তধনের সন্ধানে দ্রষ্টব্য। অর্থাৎ এদের নিজস্ব কোনও এজেন্সি বা চারিত্রকর্ম থাকছে না।
তবে কিনা, প্রেমসম্পর্ক এখনও দেখানো বারণ। চরিত্রগুলি ডেটল আর ফিনাইলে মোছা, যাকে বলে ভিক্টোরীয় মূল্যবোধে চোবানো। লেখায় উত্তর মেরু থাকতে পারে, পেঙ্গুইন তো পারেই, অরোরা বোরিয়ালিসও পারে! কিন্তু কোনও সম্ভাব্য চিত্তচাঞ্চল্যের উপাদান থাকতে পারে না। সুচিত্রা ভট্টাচার্যের কথা এখানে আলাদা করে বলা জরুরি, যিনি মিতিন মাসির মতো গোয়েন্দা চরিত্র সৃষ্টি করলেন উনিশশো নব্বইয়ের দশকে— সেই গণ্ডালুর পর। ততটা বিখ্যাত না হলেও তারও আগে, সেই চল্লিশের দশকে গোয়েন্দা কৃষ্ণা আর গোয়েন্দা শিখার আমদানি করেছিলেন প্রভাবতী দেবী সরস্বতী।
আশ্চর্য, এমন বিশিষ্ট প্রতিটি প্রচেষ্টাই কিন্তু নারীর করা প্রচেষ্টাই থেকে গেল কী ভাবে যেন। সফল মূলধারার পুরুষ লেখকের ঔদাসীন্যের তলায় চাপা পড়ে।
ভাবছিলাম, এখনও কি কিশোর-সাহিত্য পারে না আর একটু ‘ইনক্লুসিভ’ বা বেশি গ্রহিষ্ণু হয়ে উঠতে? একপেশে না হয়ে কিশোর-কিশোরীর দুই ডানায় ভর দিতে?