Bhagini Nivedita

ভারতই তাঁর সাধনার ধন

নিবেদিতার জন্ম হয়েছিল ব্রিটিশ-শাসিত আয়ারল্যান্ডে ১৮৬৭-র আজকের দিনে। ঠাকুরদা জন নোবল ছিলেন ধর্মযাজক, আবার ব্রিটিশের বিরুদ্ধে আয়ারল্যান্ডের বিপ্লবী আন্দোলনের নেতাও।

Advertisement
সবুজকলি সেন
শেষ আপডেট: ২৮ অক্টোবর ২০২৪ ০৯:৫৭

পূর্বজীবনে যিনি মার্গারেট নোবল, সেই নিবেদিতার জন্ম হয়েছিল ব্রিটিশ-শাসিত আয়ারল্যান্ডে ১৮৬৭-র আজকের দিনে। ঠাকুরদা জন নোবল ছিলেন ধর্মযাজক, আবার ব্রিটিশের বিরুদ্ধে আয়ারল্যান্ডের বিপ্লবী আন্দোলনের নেতাও। পিতা স্যামুয়েল ও মা মেরি জীবিকার সন্ধানে ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টারে এলেন। স্যামুয়েলও ধর্মযাজক, কিন্তু তাঁকে ঘিরেও গড়ে উঠেছিল একটি বিপ্লবী গোষ্ঠী। ধর্ম ও বিপ্লব দুই-ই ছিল মার্গারেটের উত্তরাধিকার, তাই ভারতে আসার পরেও তাঁর সংগ্রামী চেতনা ব্রিটিশ-বিরাগ থেকে মুক্ত হয়নি। সতেরো বছর বয়সে রেক্সহ্যাম সেকেন্ডারি স্কুলে তাঁর শিক্ষকতা শুরু, একই সময়ে সমাজসেবার ইচ্ছায় যোগ দেন সেন্ট মার্ক’স চার্চে।

Advertisement

পত্রপত্রিকায় লেখালিখির সূত্রে প্রতিবাদী লেখিকা হিসাবে পরিচিতি হয় তাঁর। ফ্রবেল, পেস্টালোৎসি তখন নতুন শিক্ষাপদ্ধতি উদ্ভাবনে রত। মার্গারেটও উইম্বলডনে গড়ে তোলেন নিজস্ব স্কুল। লন্ডনে শুরু করেন ক্লাব, যেখানে ভাষণ দিতেন বার্নাড শ, হাক্সলির মতো বিদ্বজ্জন। ভারতে আসার আগেই তিনি পান বিদগ্ধ সমাজের স্বীকৃতি।

লন্ডনেই ১৮৯৫-এর সেপ্টেম্বরে প্রথম শোনেন স্বামী বিবেকানন্দের বক্তৃতা। মার্গারেটের মন এই যোগাযোগেরই প্রতীক্ষায় ছিল। স্বামীজি কয়েক মাস পরে আবার ইংল্যান্ডে এলেন, কথাপ্রসঙ্গে তাঁকে বললেন, “স্বদেশের নারীদের কল্যাণকল্পে আমার কতকগুলি পরিকল্পনা আছে। আমার মনে হয় সেগুলিকে কার্যকর করতে তুমি বিশেষ ভাবে আমাকে সাহায্য করতে পারো।” এ ছিল প্রত্যক্ষ আহ্বান। স্বামীজি তাঁকে অবহিত করেছিলেন ভারতীয় আবহাওয়া, হিন্দু সংস্কার ও মার্গারেটের স্বজাতীয়দের সম্ভাব্য অবজ্ঞা-উপেক্ষা সম্পর্কে। কিছুই বাধা হল না। ১৮৯৮-এর ২৮ জানুয়ারি মার্গারেট পৌঁছলেন কলকাতা। ফেব্রুয়ারিতে সাক্ষাৎ দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে; ১৭ মার্চ শ্রীমা সারদাদেবীর সঙ্গে। ২৫ মার্চ মহা গুরুত্বপূর্ণ দিন, গুরু বিবেকানন্দ তাঁকে দিলেন ব্রহ্মচর্য। প্রথমে করালেন শিবপূজা, পরে দীক্ষান্তে অঞ্জলি দেওয়ালেন বুদ্ধদেবকে। নাম রাখলেন ‘নিবেদিতা’। এক বিদেশিনি ভারতে এসে, তার ধর্ম ও সমাজকে গ্রহণ করলেন।

কলকাতায় তিনটি বক্তৃতার সূত্রে নিবেদিতা হয়ে ওঠেন আলোচনার কেন্দ্র। আলবার্ট হলে ও কালীঘাট মন্দিরে কালী নিয়ে, আর ১১ মার্চ স্টার থিয়েটারে পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহে বললেন ‘ইংল্যান্ডে ভারতীয় অধ্যাত্মচিন্তার প্রভাব’ নিয়ে। পরিচয় হল রবীন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ, সরলা দেবী, জগদীশচন্দ্র বসু প্রমুখের সঙ্গে। ১৮৯৯-এর ভয়াবহ প্লেগে কলকাতাবাসী অবাক বিস্ময়ে দেখল, ঝাঁটা হাতে এক বিদেশিনি বাগবাজারে রাস্তার আবর্জনা পরিষ্কার করছেন। নিবেদিতা প্লেগের সেবাকাজে যোগ দিলেন, সঙ্গে স্বয়ং বিবেকানন্দ। নিবেদিতার থেকে কলকাতাবাসী শিখল নাগরিক জীবনে স্বাবলম্বনের শিক্ষা। তাঁর আরও একটি রূপ প্রতিভাত হল; ডা. রাধাগোবিন্দ কর দেখলেন, প্লেগ-আক্রান্ত মুমূর্ষু এক শিশুকে কোলে নিয়ে বস্তিতে রাত জাগছেন তিনি। এ-ই তাঁর সেবাকাজের শুরু— প্রয়াণের কয়েক মাস আগে পূর্ববঙ্গে ম্যালেরিয়ার সেবাকাজ অবধি যা চলেছে।

কাজের জায়গা হিসেবে সাহেবপাড়া বেছে নেননি তিনি। তাঁর গড়া ইস্কুলের ঠিকানা বাগবাজারে ১৬ নং বোসপাড়া লেনের গলির মধ্যে একটি বাড়ি। রবীন্দ্রনাথ কাছ থেকে দেখে লিখেছেন, “তাঁহার এই কাজটিকে তিনি বাহিরে কোনোদিন ঘোষণা করেন নাই... তিনি যে ইহার ব্যয় বহন করিয়াছেন তাহা চাঁদার টাকা হইতে নহে, উদ্বৃত্ত অর্থ হইতে নহে, একেবারই উদরান্নের অংশ হইতে।”

পল্লিতে পল্লিতে ঘুরে, অবজ্ঞা পরিহাস উপেক্ষা করে নিবেদিতা তাঁর স্কুলের ছাত্রী জোগাড় করেছেন। কালক্রমে এই বিদ্যালয়ই হয়ে উঠল বাগবাজার অঞ্চলে বালিকা কিশোরী তরুণী সধবা-বিধবাদের শিক্ষালয়। ১৯০২-এর ৪ জুলাই বিবেকানন্দ প্রয়াত হলেন, গুরুপ্রয়াণের পর স্বামীজির সাধনধন ভারতবর্ষ তাঁরও সাধনধন হল। এক দিকে তিনি হলেন ভারতীয় শিল্প আন্দোলনের যাজ্ঞিক, অন্য দিকে দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে সমর্পিতা। ভারতীয় শিল্পের পুনরুজ্জীবনে তাঁর অবদান অপরিসীম। তিনি প্রাণিত করেছিলেন ই বি হ্যাভেল, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জগদীশচন্দ্র বসু, ওকাকুরাকে; নন্দলাল বসু, অসিত হালদারকে পাঠিয়েছিলেন অজন্তায়। সদস্য ছিলেন ১৯০৭-এ প্রতিষ্ঠিত ‘ইন্ডিয়ান সোসাইটি অব ওরিয়েন্টাল আর্ট’-এর।

সে সময় দেশে এমন কোনও বিপ্লবী ছিলেন না যিনি তাঁর দ্বারা প্রভাবিত হননি। অরবিন্দ ঘোষ, হেমচন্দ্র ঘোষ, বারীন্দ্র ঘোষ, বাঘা যতীন, সকলেই তাঁর দ্বারা প্রাণিত ছিলেন। রবীন্দ্রনাথেই ফিরতে হয়, “ভগিনী নিবেদিতা একান্ত ভালবাসিয়া সম্পূর্ণ শ্রদ্ধার সঙ্গে আপনাকে ভারতবর্ষে দান করিয়াছিলেন, তিনি নিজেকে বিন্দুমাত্র হাতে রাখেন নাই।” শিক্ষা, রাজনীতি, শিল্প, সমাজ প্রতিটি ক্ষেত্রেই তার ছাপ। দার্জিলিঙে তাঁর স্মৃতিস্তম্ভেও লেখা, “এখানে শান্তিতে শায়িত ভগিনী নিবেদিতা, যিনি ভারতবর্ষকে দান করেছিলেন তাঁর সর্বস্ব।”

আরও পড়ুন
Advertisement