পুস্তক পরিচয় ১

সুলতানরাই ইহুদিদের আশ্রয় দিয়েছিলেন

মিশরের ফারাও রামেসেস-এর দাসত্ব থেকে ইহুদিদের মুক্ত করে তাঁদের ঈশ্বর-প্রতিশ্রুত ভূমি ইজরায়েলে পৌঁছে দেন মোজেস, এমনই পুরাণ-কাহিনি। সেই ভূমি থেকে ইহুদিরা বিতাড়িত হতে থাকেন প্রথমে বাইজান্টাইন রোমানদের দ্বারা, পরে যিশুকে ক্রুশবিদ্ধ করার পাপে খ্রিস্টানদের দ্বারা। পশ্চিম এশিয়া, উত্তর আফ্রিকা ও ইউরোপের নানা দেশে তাঁরা ছড়িয়ে পড়েন, সামান্য কিছু লুকিয়ে-চুরিয়ে থেকে যান। খ্রিস্টধর্মাবলম্বী ইউরোপের প্রতিটি দেশেই কম-বেশি নিগৃহীত হতে থাকেন ইহুদিরা, ব্রাত্য করে রাখা হয় তাঁদের। প্রতি বছর তাই তাঁরা প্রার্থনা করতেন— পরের বছর যেন জেরুজালেমে ফিরতে পারেন, হাসিল করতে পারেন হারানো স্বদেশ।

Advertisement
গৌতম রায়
শেষ আপডেট: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০০:০১

মিশরের ফারাও রামেসেস-এর দাসত্ব থেকে ইহুদিদের মুক্ত করে তাঁদের ঈশ্বর-প্রতিশ্রুত ভূমি ইজরায়েলে পৌঁছে দেন মোজেস, এমনই পুরাণ-কাহিনি। সেই ভূমি থেকে ইহুদিরা বিতাড়িত হতে থাকেন প্রথমে বাইজান্টাইন রোমানদের দ্বারা, পরে যিশুকে ক্রুশবিদ্ধ করার পাপে

Advertisement

খ্রিস্টানদের দ্বারা। পশ্চিম এশিয়া, উত্তর আফ্রিকা ও ইউরোপের নানা দেশে তাঁরা ছড়িয়ে পড়েন, সামান্য কিছু লুকিয়ে-চুরিয়ে থেকে যান। খ্রিস্টধর্মাবলম্বী ইউরোপের প্রতিটি দেশেই কম-বেশি নিগৃহীত হতে থাকেন ইহুদিরা, ব্রাত্য করে রাখা হয় তাঁদের। প্রতি বছর তাই তাঁরা প্রার্থনা করতেন— পরের বছর যেন জেরুজালেমে ফিরতে পারেন, হাসিল করতে পারেন হারানো স্বদেশ। ইহুদি-বিদ্বেষ চরমে ওঠে নাতসি বর্বরতার সময়, আর একটি স্বতন্ত্র ইহুদি রাষ্ট্রের জন্মের প্রক্রিয়াও সেখান থেকেই শুরু। প্যালেস্তাইনে তত দিনে ইসলাম ধর্মাবলম্বী আরবরা কয়েক শতাব্দী ধরে বাস করছেন। ইহুদি অভিবাসন শুরু হতেই ভিটেমাটি হারাতে লাগলেন সেই প্যালেস্তাইনিরা। উদ্বাস্তু হয়ে জর্ডন, সিরিয়া, লেবানন, মিশর, ইরাকে ছড়িয়ে পড়লেন তাঁরা। ক্রমে প্যালেস্তাইন হল ইজরায়েল, প্যালেস্তাইনিদের তাড়িয়ে দেওয়া হল জর্ডন নদীর পশ্চিম পার ওয়েস্ট ব্যাংকে, লাগোয়া পূর্ব জেরুজালেমে আর ভূমধ্যসাগর তীরের অপরিসর ভূখণ্ড গাজায়। ১৯৬৭-র ৬ দিনের যুদ্ধে এই সব জায়গা ছাড়াও মিশরের সিনাই উপত্যকা, সিরিয়ার গোলান হাইটস এবং দক্ষিণ লেবাননের কিছু অংশ দখল করল ইজরায়েল। তার যুদ্ধযন্ত্র তত দিনে অপরাজেয়। শুরু হল অধিকৃত আরব ভূখণ্ডে জায়নবাদীদের নিষ্ঠুর দমননীতি, প্যালেস্তাইনিদের ভাতে-পানিতে মারার নিশ্ছিদ্র ব্যবস্থা, তাঁদের ন্যূনতম মানবিক অস্তিত্বরক্ষার সুযোগবঞ্চিত করে খাঁচার পশুর মতো বন্দিত্বে ঠেলে দেওয়া আর সেই অসহায় অবমানবের জীবন থেকে বেরিয়ে আসতে প্যালেস্তাইনিদের বিদ্রোহ, সশস্ত্র প্রতিরোধ, ইন্তিফাদা।

আলোচ্য বইটি সেই পাঁচ দশকের ইহুদি দখলদারির ইতিবৃত্ত। লেখক নিজে একজন আলোকপ্রাপ্ত ইহুদি, যিনি প্যালেস্তাইনিদের সঙ্গে আচরিত তাঁর স্বজাতির বর্বরতাকে যুক্তিসিদ্ধ না করে সরাসরি ধিক্কার জানিয়েছেন। এই পাঁচ দশক ধরে ইহুদি রাষ্ট্রের লক্ষ্য থেকেছে একটাই— বিশ্ব জুড়ে ছড়িয়ে থাকা স্বধর্মীদের তাঁদের পিতৃভূমিতে জড়ো করে আনা এবং সেই ক্রমবর্ধমান ইহুদি জনসংখ্যাকে প্যালেস্তাইনিদের থেকে কেড়ে নেওয়া স্বদেশে বসত করিয়ে ক্রমাগত তাঁদের অবশিষ্ট জনপদের ভূগোল সংকুচিত করতে থাকা। এই প্রক্রিয়ায় গাজা, পূর্ব জেরুজালেম ও ওয়েস্ট ব্যাংকের প্যালেস্তাইনি জনপদে সশস্ত্র সেনাপ্রহরায় এবং অমানুষিক পীড়ননীতির সাহায্যে জায়গা খালি করে শত-শত ইহুদি পরিবারকে বসিয়ে দেওয়া এবং তাঁদের নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে কংক্রিটের উঁচু পাঁচিল গড়ে প্যালেস্তাইনিদের কার্যত সংকীর্ণ এক ভূখণ্ডে বন্দিত্বে নিক্ষেপ করার কাজটি আজও রুদ্ধশ্বাস গতিতে করে চলেছে ইজরায়েল। অতি সম্প্রতি গাজায় নিরন্তর বোমা ও গোলা বর্ষণে আড়াই হাজার প্যালেস্তাইনিকে হত্যা করার পর সংঘর্ষ-বিরতি ঘোষণা করেই ওয়েস্ট ব্যাংকের আরও হাজার একর জমি ইহুদি বসতির জন্য নতুন করে কেড়ে নেওয়ার সরকারি সিদ্ধান্তও ঘোষিত হয়েছে, যে-সিদ্ধান্তের প্রকাশ্য সমালোচনা করেছেন এমনকী ইজরায়েলের অর্থমন্ত্রী ও বিচারমন্ত্রীও।

দমননীতির বিরুদ্ধে দেওয়ালে পিঠ-ঠেকে-যাওয়া প্যালেস্তাইনিরা হাত গুটিয়ে বসে থাকেননি। আল ফাতাহ্, আল হামাস, ইসলামি জেহাদ এবং লেবাননের হেজবুল্লা মিলিশিয়ার মতো জঙ্গি সংগঠনের নেতৃত্বে রুখে দাঁড়িয়েছেন। ইয়াসার আরাফতের নেতৃত্বে আল ফাতাহ্ কয়েকটি গোষ্ঠীকে নিয়ে প্যালেস্তাইন মুক্তি সংগঠন পিএলও তৈরি করে, যা ইজরায়েলের সঙ্গে দরকষাকষি করে প্যালেস্তাইনিদের নিজস্ব রাষ্ট্র গড়তে চায়। সমগ্র আরব দুনিয়ায় প্যালেস্তাইনিরাই একমাত্র মুসলিম জনগোষ্ঠী, যারা প্রথমাবধি গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধি বাছাই করে নিজেদের শাসনপ্রণালী চালু করে। কিন্তু ইজরায়েলি আগ্রাসন ও প্যালেস্তাইনি গণতন্ত্রে তার অন্তর্ঘাত চলতেই থাকে, আর তা প্রতিরোধ করার অসম লড়াইয়ে মার্কিন অস্ত্রসজ্জিত ইজরায়েলের ট্যাংকের সামনে দাঁড়িয়ে প্যালেস্তাইনের নবীন কিশোরেরা গাজার ভুবনডাঙায় স্রেফ খালি হাতে পাথর ছুড়তে থাকে। গোলিয়াথ বনাম ডেভিডের সেমিটিক পুরাণ-কথা এ ভাবেই রূপান্তরিত হয় ডেভিডের তারকাখচিত পতাকাবাহী জায়নবাদীদের নিপীড়নের প্রতিদ্বন্দ্বে।

সম্মুখসমরে ইজরায়েলি যুদ্ধযন্ত্রের সঙ্গে এঁটে ওঠার সম্ভাবনা না-থাকায় প্যালেস্তাইনি প্রতিরোধ সন্ত্রাস ও গুপ্তহত্যার পথ নিতে বাধ্য হয়। প্রত্যুত্তরে আরও নৃশংস ও ব্যাপক হয় ইহুদি আগ্রাসন। প্যালেস্তাইনি প্রতিরোধের মাজা ভেঙে দিতে গুপ্তচরদের বিস্তৃত জাল বিছিয়ে দেয় ইজরায়েল। তার সিক্রেট পুলিশ প্যালেস্তাইনি যুবতীদের অপহরণ করে, বিবস্ত্র করে ছবি তোলে। তার পর সেই ছবি তাদের রক্ষণশীল পরিবারের কাছে ফাঁস করার ভয় দেখিয়ে ব্ল্যাকমেল করে তাদের চরবৃত্তিতে নামায়। এই মহিলা গুপ্তচরেরা আবার অন্য প্যালেস্তাইনি তরুণীদের ভুলিয়ে-ভালিয়ে নিজেদের ডেরায় এনে ইহুদি পুরুষদের সঙ্গে সঙ্গমে লিপ্ত করিয়ে তার ভিডিও-চিত্র তুলে রাখে এবং তাদেরও একই ভাবে ব্ল্যাকমেল করা হয়। এই গুপ্তচরদের কাছ থেকে পাওয়া গোপন খবরের সূত্রে ইজরায়েল জেনে নেয় প্যালেস্তাইনি নেতাদের গতিবিধি, তারপর ওত পেতে থাকে খতম করার জন্য। এই অসহায়, শ্বাসরোধকর, গ্লানিময় অস্তিত্বের মধ্যেও প্রতিরোধ থামে না, বরং আরাফতের নরমপন্থায় বীতশ্রদ্ধ প্যালেস্তাইনি তরুণরা সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়তে মিশরের মুসলিম ব্রাদারহুডের দীক্ষায় গড়ে ওঠা আল-হামাস গোষ্ঠীতে নাম লেখায়।

কালক্রমে ওয়েস্ট ব্যাংক ও গাজার প্যালেস্তাইনিদের জনপ্রতিনিধি নির্বাচনে (যে-নির্বাচন আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের কাছে নিরপেক্ষতার শংসাপত্র পেয়েছিল) হামাস-ই গরিষ্ঠতা পায়। কিন্তু দুই জনপদের ভৌগোলিক দূরত্বের সুযোগ নিয়ে ইজরায়েল সেই গণতান্ত্রিক জনাদেশে অন্তর্ঘাত করে, হামাসকে ওয়েস্ট ব্যাংক শাসন করতে দেয় না, গাজাতেই আটকে রাখে। শুরু হয় গাজায় কিছু কাল পর-পরই ইজরায়েলি গোলা ও বোমাবর্ষণ। এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান যে ইজরায়েল ও প্যালেস্তাইন, দুই পৃথক রাষ্ট্রের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, সে-কথা ইজরায়েলের পশ্চিমী মিত্র ও মুরুব্বিরাও স্বীকার করেছে। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকাকে যেমন তার বর্ণবিদ্বেষী রাষ্ট্রনীতি বদলাতে আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ও চাপ সৃষ্টি করা হয়েছিল, প্যালেস্তাইন-বিদ্বেষী জায়নবাদীদের তেমন চাপ কেউ দেয়নি। উল্টে গাজায় সর্বশেষ বোমারু হামলার সময়েও মার্কিন বিদেশ সচিবকে বলতে শোনা গেছে, আত্মরক্ষার অধিকার ইজরায়েলের আছে। নিশ্চয় আছে। কিন্তু প্যালেস্তাইনিদের কি সে-অধিকার থাকতে নেই? তা ছাড়া, ইজরায়েল তো কোনও রক্ষণাত্মক লড়াই লড়ছে না, তার পুরো ইতিহাসটাই আগ্রাসনের, প্যালেস্তাইনি ভূমিপুত্রদের উৎখাত করার, হাজারে-হাজারে হত্যা করার, একজন ইহুদি নিহত হলে ১০০ জন প্যালেস্তাইনিকে মেরে শোধ নেওয়ার। প্যালেস্তাইন জবরদখল করে তার জন্ম ও প্রসারের মধ্যেই নিহিত রয়েছে সবচেয়ে বড় আগ্রাসন ও আক্রমণ। তা হলে তার আত্মরক্ষার অধিকারের প্রশ্ন উঠছে কেন? অথচ এই প্যালেস্তাইনি মুসলিমদের পূর্বসূরিদের কাছে, ইসলামের খলিফা ও সুলতানদের কাছেই একদা প্রজ্ঞাবান ইহুদিরা আশ্রয় পেয়েছিলেন। গোটা মধ্যযুগে খ্রিস্টান ইউরোপ যখন ইহুদি পীড়নে মত্ত, তখন মুসলিম-শাসিত স্পেনের কর্দোবায়, বাগদাদে, কায়রোয়, দামাস্কাসে এবং ইস্তানবুলে মুসলিম সুলতানরা যে সমাদরে ইহুদি দার্শনিক, বিজ্ঞানী, গণিতজ্ঞ, ধর্মবেত্তা ও সাহিত্যিকদের বরণ করেছিলেন, সভাসদ, এমনকী প্রধানমন্ত্রীও বানিয়েছিলেন (মায়মোনাইডস), গাজার নিরস্ত্র প্যালেস্তাইনি শিশুদের কচুকাটা করে আজ কালান্তরে কি তারই প্রতিদান দিচ্ছে জায়নবাদীরা? এমন জানলে কি ১১৮৭ খ্রিস্টাব্দে ক্রুসেডারদের পরাস্ত করে সুলতান সালাদিন সব ইহুদিকে জেরুজালেমে ফেরার আহ্বান জানিয়ে তাঁদের ওই আরব-বিজিত ভূখণ্ডে স্থায়ী বসবাসের ডিক্রি জারি করতেন (তাঁর ১৬০০ বছর আগে পারস্য সম্রাট সাইরাসও যেমন করেছিলেন)? হয়তো করতেন!

আরও পড়ুন
Advertisement