পুস্তক পরিচয় ২: বাংলাদেশের বই

শুধু আত্মস্মৃতি নয়, সময়ের সমাজদর্পণ

গবেষক ও লেখক আনিসুজ্জামান বাহান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে অদ্যাবধি বাঙালি সমাজজীবনের অসংগতি ও সংকটমোচনের জন্য যে সংগ্রাম করে চলেছেন, তা তাঁকে করে তুলেছে বাংলাদেশের বিবেকবান এক অগ্রণী ব্যক্তিত্ব।

Advertisement
আবুল হাসনাত
শেষ আপডেট: ০৭ নভেম্বর ২০১৫ ০০:০১
বিপুলা পৃথিবী, আনিসুজ্জামান। প্রথমা প্রকাশন, ৮০০.০০

বিপুলা পৃথিবী, আনিসুজ্জামান। প্রথমা প্রকাশন, ৮০০.০০

গবেষক ও লেখক আনিসুজ্জামান বাহান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে অদ্যাবধি বাঙালি সমাজজীবনের অসংগতি ও সংকটমোচনের জন্য যে সংগ্রাম করে চলেছেন, তা তাঁকে করে তুলেছে বাংলাদেশের বিবেকবান এক অগ্রণী ব্যক্তিত্ব। প্রথমা প্রকাশন থেকে তাঁর স্মৃতিকথাভিত্তিক একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে বিপুলা পৃথিবী শিরোনামে। এটি তাঁর স্মৃতিকথার তৃতীয় খণ্ড। শৈশব থেকে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ পর্যন্ত সময়ের কথা তিনি লিখেছেন কাল নিরবধি গ্রন্থে। মুক্তিযুদ্ধকালীন অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন আমার একাত্তর গ্রন্থে। আর ৫১৮ পৃষ্ঠার বিপুলা পৃথিবী স্মৃতিকথায় লিখেছেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ের (১৯৭২-২০০০) কথা। গ্রন্থ-প্রারম্ভে লেখকের ‘নিবেদন’ অংশে স্পষ্ট হয়ে ওঠে কী ছিল তাঁর অভিপ্রায়: ‘‘...নিজের সম্পর্কে জানানোটা জরুরি নয়, কিন্তু যা দেখেছি, যা শুনেছি, তার অনেকখানি গুরুত্বপূর্ণ।’’

বাংলাদেশের সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাসে এই সময়টি নানা দিক থেকে পর্যবেক্ষণ করা খুব জরুরি ছিল। সময়টি ছিল বহু সমস্যায় দীর্ণ ও কণ্টকিত। যে কোনও সৃজনশীল সামাজিক ভাবে দায়বদ্ধ মানুষকে এ সময়ে নিজের সঙ্গে, কখনও সমাজ ও রাষ্ট্রের সঙ্গে লড়াই করে নিজেদের অবস্থান কোথায় তা বুঝে নিতে হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বিজয় অর্জিত হলেও, দেশ ও বিদেশের নানা চক্রান্তের ফলে ১৯৭৫-এর ১৫ অগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবার হত্যা করা হয়। এই হত্যা ও পরবর্তী কালে ক্যু ও পাল্টা ক্যু এবং সেনাবাহিনীর উজ্জ্বল অফিসারদের হত্যা খুবই হৃদয়বিদারক হয়ে ওঠে। এই সময় বলবৎ ছিল সামরিক শাসন। দেশ, সমাজ এবং মুক্তিযুদ্ধের অর্জনকে, রাষ্ট্রের অঙ্গীকার ও মূলনীতিকে উচ্ছেদ করার প্রয়াস হয়েছিল। গণতন্ত্রে বিশ্বাসী এবং প্রগতিশীল মননজীবী নাগরিকদের কষ্ট ও হৃদয়ের যন্ত্রণা বড় বেশি পীড়িত করেছিল দৈনন্দিন জীবনকে।

Advertisement

তাঁর স্মৃতিকথা কখনওই তাঁর আত্মস্মৃতি নয়, বরং তাঁর সময়ের সমাজদর্পণ। রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে এটি ইতিহাসের এক অমূল্য দলিল হয়ে উঠেছে। আনিসুজ্জামান মুক্তিযুদ্ধকালে ও স্বাধীনতার পরে স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন। বিশেষ করে বাংলাদেশের সংবিধানের বাংলা পাঠ রচনায় তিনি সরাসরি যুক্ত ছিলেন। যুক্ত হন প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের সঙ্গে। অনেক ঘটনা খুব কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেছেন। এই স্মৃতিকথায় তিনি স্থান দিয়েছেন অপ্রিয় কিছু বিষয়কেও। পাঠক সেগুলি থেকে উপলব্ধি করতে পারবেন সমাজ প্রগতিকে বাধা দিতে সেই সময়ে পরিপার্শ্ব থেকেও কত রকমের বিরূপতা সৃষ্টি করা হয়েছিল। সেই সঙ্গে চট্টগ্রাম ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর কর্মজীবনের অভিজ্ঞতার কথাও এই গ্রন্থে রয়েছে।

কারা ছিলেন এই পর্বের কুশীলব, দেশের অভ্যন্তরে কী ভাবে চক্রান্ত হয়েছিল, সে কথাও সবিস্তার উল্লেখ করেছেন আনিসুজ্জামান। তিনি নির্মোহ দৃষ্টিতে এমন কিছু কথা বলেছেন যা খুব যথাযথ। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর এক দিকে জাতি ও রাষ্ট্রের বিকাশে যে অমিত সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছিল, তা অচিরেই বিনষ্ট হয়েছিল। চক্রান্ত করে এই বিকাশকে কেন রুদ্ধ করা হয়েছিল, এই গ্রন্থের স্মৃতিচারণের সঙ্গে নির্মোহ ভাবে তা বিশ্লেষণ করেছেন। আনিসুজ্জামানের বইটি এ কথা উপলব্ধি করতে শেখাল যে, আত্মকথায় ব্যক্তির উন্মোচন হয়। এই উন্মোচন সময় ও পরিপার্শ্বকে ধারণ করে এমন কিছু চিহ্ন রেখে যায়, যা অমোচনীয় হয়ে গেঁথে থাকে। উপলব্ধি ও বোধের ক্ষেত্রে নবীন মাত্রা যোগ করে।

আনিসুজ্জামান বাংলাদেশের রাজনীতি, সমাজ ও সাহিত্য-ভুবনের বৃহত্তর পরিমণ্ডলের এমন এক ব্যক্তি, যাঁর সঙ্গে নিবিড় যোগ রয়েছে এই অঙ্গনের। যে-কোনও পাঠক সময় ও কালের নানা ঘটনাবলির আস্বাদ পাবেন এই গ্রন্থে। এই সংকটের তীব্রতা গ্রহণ কিংবা বর্জন করবেন বুদ্ধিবৃত্তিক দৃষ্টিকোণ থেকে। বাংলাদেশের রাজনীতি ও সমাজবিকাশের ধারাকে উপলব্ধি ও বিশ্লেষণ করার কেউ প্রয়াসী হলে তাঁকে এই সময়খণ্ডকে জানতে হবে। এ নিয়ে নানা ধরনের বিভ্রান্তি আছে এবং সত্যিকার ঘটনাকে আড়াল করার প্রয়াসও আছে। সে দিক থেকে আনিসুজ্জামানের নির্মোহ দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ এবং গ্রন্থে বর্ণিত সময়খণ্ডে ব্যক্তি ও সমাজের সংকট উন্মোচন কখনও বা প্রসঙ্গত অতীতকে ফিরে দেখা ও ভবিষ্যতের দিকে দৃকপাত খুবই জরুরি।

বিপুলা পৃথিবী-র এক অংশে লেখক বলেছেন, ‘এ সব লেখার এই এক দায়। সামনের কথা লিখতে শুরু করলে পেছনের কথা আবার ভিড় করে আসে।’ তখন ফিরে তাকাতে হয়। লেখককে যেমন রচনার ধারাবাহিকতা রক্ষায় পিছনে ফিরে তাকানোর বিড়ম্বনা সইতে হয় তেমনই আজকের পাঠক, অনাগত পাঠককে এগিয়ে চলার জন্য সানন্দে ফিরে তাকাতে হবে বইটির দিকে।

তাঁর স্মৃতিকথার আলোচ্য সময়পরিধি বাংলাদেশের বাঙালির জন্য মসৃণ ছিল না। দ্বন্দ্ব, দোলাচল এবং সামাজিক অনুশাসনকে অগ্রাহ্য করে একটি জাতি দীর্ঘ সংগ্রামের ভিতর দিয়ে পথ নির্মাণ করে চলেছে। এই পথচলা সম্ভাবনা নির্মাণ ও সৃষ্টির কথা আছে এই তিনটি গ্রন্থে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট ও মৌল প্রত্যয় উপলব্ধির জন্য ভিন্ন তাৎপর্যে বিপুলা পৃথিবী অবশ্যই পাঠ্য, এমন কথা হয়তো বলা যায়।

আরও পড়ুন
Advertisement