পুস্তক পরিচয় ২

মানববিকাশ ও সংরক্ষণকে মেলানোর চেষ্টা কই

অমিতাভ ঘোষের দ্য হাংরি টাইড উপন্যাসে পড়ি— সুন্দরবনের দ্বারপ্রান্ত ক্যানিং-এ এসে কানাই ভাবে, জঙ্গল কোথায়, এ তো শুধু মানুষের ভিড়! অগুনতি মানুষ বাস করেন ভুখা কোটালের দেশে, গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র বদ্বীপের দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত জোয়ার-শাসিত জল-কাদার দুনিয়ায়। আগে বলত ‘ভাটি’। পরে ‘সুন্দরবন’ নামটাই বেশি পরিচিত হয়েছে।

Advertisement
শান্তনু চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ২৩ এপ্রিল ২০১৬ ০০:০০

অমিতাভ ঘোষের দ্য হাংরি টাইড উপন্যাসে পড়ি— সুন্দরবনের দ্বারপ্রান্ত ক্যানিং-এ এসে কানাই ভাবে, জঙ্গল কোথায়, এ তো শুধু মানুষের ভিড়! অগুনতি মানুষ বাস করেন ভুখা কোটালের দেশে, গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র বদ্বীপের দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত জোয়ার-শাসিত জল-কাদার দুনিয়ায়। আগে বলত ‘ভাটি’। পরে ‘সুন্দরবন’ নামটাই বেশি পরিচিত হয়েছে।

পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবনের কথাই বলি। বাসন্তী, গোসাবা, হিঙ্গলগঞ্জ বা পাথরপ্রতিমার বাসিন্দার কাছে, ‘সুন্দরবন’ তাঁর স্বভূমি। তবে দেশি-বিদেশি পর্যটক ও বন্যপ্রেমীদের কাছে ‘সুন্দরবন’-এর অর্থ হরেক প্রজাতির ম্যানগ্রোভ, জঙ্গল, রয়্যাল বেঙ্গল, কুমির, কামট, ডলফিন, পাখি। ‘সুন্দরবন’-এর এই দুই অর্থের মধ্যে রয়েছে জোরালো টেনশন। একদিকে জঙ্গল, নদী, নদীবাঁধ, চরা ও কর্দমতটের মধ্যে বসবাসকারী আঞ্চলিক মানুষের জীবন-জীবিকার নানান সমস্যা, জটিলতা, বাধ্যতা। অন্য দিকে সরকারি ও উচ্চবর্গীয় সংরক্ষণভাবনা। এই দুই বাস্তববোধের মধ্যে বিরোধের অনুভব অমিতাভ ঘোষের উপন্যাসে লক্ষণীয়। এই বিরোধের আরও গভীরে ঢুকেছেন অনু জালাই। তাঁর ‘ফরেস্ট অব টাইগার্স’-এ পরীক্ষা করেছেন সুন্দরবন সম্পর্কে নানান আখ্যানের ভূমিকা ও সংঘাত। দেখিয়েছেন আখ্যানের পেছনে ভৌগোলিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক অবস্থান, মতাদর্শ ও ঐতিহ্যের ভূমিকা। আখ্যান-পর্যালোচনার মশলায় জালাই নির্মাণ করেছেন সুন্দরবনের এক ভিন্ন স্বাদের আখ্যান।

Advertisement

আখ্যানের প্রতিযোগিতা, গল্পদের লড়াই সর্বত্র— চায়ের আড্ডা, গৃহের কোন্দল থেকে পণ্ডিতের তরজায়। এ লড়াইয়ের হাতিয়ার আবেগ, বাগ্মিতা, লিখনশৈলী, যুক্তি, পরিসংখ্যান, জল্প, বিতণ্ডা, তথ্য, প্রমাণ, নামের ভার, আরও কত কী! সত্যের জয় হয় নাকি জয়ীই সত্যের সম্মান পায়? সত্য তা হলে কী? সত্য যাই হোক, সংসার আখ্যানময় তাতে সন্দেহ নেই।

আলোচ্য গ্রন্থের লেখক অমিতেশ মুখোপাধ্যায় সুন্দরবনে মানবোন্নয়নের খতিয়ান করতে গিয়ে সুন্দরবনকে দেখার নানান পরকলা ও বিভিন্ন আখ্যানের ধরন, গড়ন, তাৎপর্য বিচার করেছেন। এ ক্ষেত্রে জালাইয়ের প্রভাবের অকপট স্বীকৃতিও রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবন এলাকার দারিদ্র ও বিপন্নতার যে বৃত্তান্ত অমিতেশ নির্মাণ করেছেন, খুব সংক্ষেপে তা এই রকম।

লিভিং উইথ ডিজাস্টার্স: কমিউনিটিজ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ইন দি ইন্ডিয়ান সুন্দরবন্‌স, অমিতেশ মুখোপাধ্যায়। কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস, ৮৯৫.০০

ঔপনিবেশিক রাজস্ববৃদ্ধির লোভ ও জমিদারদের জমিদারি বাড়ানোর মতলবে বাদাবন আবাদ হয়ে লোকালয় বসেছে কয়েকশো বছর ধরে। এই প্রক্রিয়ার কোনও এক পর্যায়ে এসেছে গেজেটিয়াররূপী ঔপনিবেশিক জ্ঞানচর্চার নজর। উনিশ শতকের শেষার্ধে, সুন্দরবনের একটি বড় অংশে লোকালয় প্রতিষ্ঠার বাস্তবতাকে মেনে নিয়েও, সম্ভবত ভিক্টোরীয় সংরক্ষণচেতনার প্রভাবে, এসেছে তাকে বন্য ও দুর্গম জায়গা হিসেবে দেখার আকাঙ্ক্ষা। বিশ শতকে এই আখ্যান ক্রমশ রূপান্তরিত হয়েছে সুন্দরবনকে অকৃত্রিম আদিমতা ও বন্যতার মিউজিয়াম হিসেবে দেখায় ও তাকে সংরক্ষণের দাবিতে। সরকারি সংরক্ষণভাবনা, উচ্চবর্গীয় এবং জাতীয়-আন্তর্জাতিক পরিবেশভাবনা প্রভৃতি মিলেজুলে একটি সুন্দরবনচেতনার কাঠামো তৈরি হয়েছে যাতে সুন্দরবনের বাসিন্দাদের প্রয়োজন, সমস্যা, জটিলতা এবং মানববিকাশের প্রশ্নের উপস্থিতি খুব দুর্বল। বন ও বন্যপ্রাণ সংরক্ষণের মোড়কে নিম্নবর্গীয় ‘নীচু’ জাতের মানুষের প্রতি ভদ্রলোক তথা ‘উঁচু’ জাতের কর্তৃত্বাধীন সরকারের মনোভাব যে কতদূর হিংস্র হয়ে উঠতে পারে তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ মরিচঝাঁপিতে সরকারি আক্রমণ ও গণখুন।

জঙ্গল সুন্দরবন ও লোকালয় সুন্দরবনের বাস্তবতা ও চাহিদাকে সার্বিক ভাবে বুঝে মানববিকাশ ও সংরক্ষণকে মেলানোর চেষ্টা অনুপস্থিত। তাই নদীর জলে বাগদার মিন ধরা মহিলারা সুন্দরবনের বাস্তুতন্ত্রের শত্রু ধার্য হন, কিন্তু সুন্দরবন-সংক্রান্ত পরিকল্পনায় এই ভয়ংকর কঠিন জীবিকার বিকল্প কর্মসংস্থানের ভাবনা গুরুত্ব পায় না। আর ভয়াবহ দুর্যোগ কিংবা দৈনন্দিনের সংকট, কোনও কিছুর সুষ্ঠু মোকাবিলাতেই সরকারি নীতি সফল হয় না।

ইতিহাস, ঐতিহ্য, পরিকল্পনা, নীতি প্রভৃতির বৃহৎ পটভূমিতে নিতান্ত ক্ষুদ্র ও আঞ্চলিক উপাদানগুলিকে ভুলে যাননি লেখক। বরং যত্নের সঙ্গে ডিটেলগুলি তুলে আনার চেষ্টা করেছেন। পদ্ধতি হিসেবে পাখির চোখ করেছেন নদীবাঁধকে। কারণ সুন্দরবনের বাস্তবতা ও সমস্যার অনেক কিছুর সমাবেশ এই নদীবাঁধে। ভুখা কোটালের লোনা প্লাবন প্রতিরোধকারী নদীবাঁধ সুন্দরবনের জনবসতির প্রাণদায়ী লক্ষণরেখা। নদীবাঁধ বিপন্ন হলে জনবসতি, চাষ, সবই বিপন্ন, যার হাড় হিম করা নিদর্শন আয়লার মুখে সুন্দরবনবাসীর অসহায়তা। নদীবাঁধের এই ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সরকারি নীতির লাগাতার ব্যর্থতার কারণ একাধারে সাধারণ মানুষের কল্যাণের প্রতি নিষ্ঠার অভাব, অন্য দিকে বাঁধকে কেন্দ্র করে আঞ্চলিক ও প্রশাসনিক রাজনীতি, দুর্নীতি ও হরেক লেনদেনের বিচিত্র লীলা। জটিলতার নানান দিক। যেমন বাঁধ ভাঙলে সর্বনাশ, কিন্তু বাঁধ মেরামতে কর্মসংস্থান ও বিভিন্ন পর্যায়ের আয়ের সুযোগ। তা ছাড়া আছে অন্য স্বার্থের খেলা। গত দশ-বারো বছরে দুদ্দাড় করে বেড়েছে বেআইনি বাগদার চাষ— বাঁধ কেটে ঢোকানো হচ্ছে নদীর নোনা জল। এর ফলে বাঁধ দুর্বল হচ্ছে।

রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সমাজবিদ্যার নানা বিশ্লেষণ ব্যবহার করেছেন লেখক। আধুনিক রাষ্ট্রে নাগরিক কী ভাবে সরকারি নীতি ও প্রকল্পের বিষয় ও সুবিধাভোগীতে রূপান্তরিত হচ্ছে এবং জনগোষ্ঠীর পরিচয় ও ঐতিহ্যচেতনা কী ভাবে সরকারি চাকরি ও অন্যান্য সুবিধা আদায়ের হাতিয়ার হয়ে উঠছে, সুন্দরবনের পরিপ্রেক্ষিতে এই প্রস্তাবনার প্রয়োগ ও পরীক্ষা করেছেন। উপসংহারে তাঁর আশা, বইটি সুন্দরবনের মানুষের সমস্যা ও বিপন্নতাকে বুঝতে এবং তা নিরসনের লক্ষ্যে উপযুক্ত নীতি-নির্ধারণে সাহায্য করবে। আমরাও এমনই আশা করব।

বিষয় ও উপস্থাপনা সম্পর্কে কয়েকটি প্রশ্ন উঠতে পারে। লেখক জানিয়েছেন, যে দ্বীপটি (ও গ্রাম পঞ্চায়েতটি) তাঁর পর্যবেক্ষণ ও অধ্যয়নের প্রধান ক্ষেত্র, গোপনীয়তার কারণে তিনি তার প্রকৃত নাম ব্যবহার করেননি। শুধু উল্লেখ করেছেন, সেটি গোসাবা ব্লকের অন্তর্গত। সম্ভবত একই কারণে, মানচিত্রে ও অন্যত্র, অন্যান্য স্থান-নির্দেশিকার ক্ষেত্রেও প্রকৃত নাম ব্যবহার করেননি। সেটা খুঁটিয়ে দেখলে বোঝা যাচ্ছে, কিন্তু নির্দিষ্ট ভাবে উল্লেখ করা দরকার ছিল। ভৌগোলিক অবস্থান প্রসঙ্গে একটি জরুরি কথা। বইটিতে যে সব আঞ্চলিক তথ্য দেওয়া হয়েছে, তা প্রধানত গোসাবা ও বাসন্তী ব্লকের। এই দুটি ব্লক খুব গুরুত্বপূর্ণ হলেও, সুন্দরবনে আরও ১৭টি ব্লক আছে। সুন্দরবনের দুটি এলাকার তথ্যের ভিত্তিতে গোটা সুন্দরবনের বিপন্নতা, সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি সম্পর্কে সাধারণ সিদ্ধান্তে আসার কিছু সমস্যা থাকে। এই সম্ভাবনার স্বীকৃতি ও এ প্রসঙ্গে কিছু আলোচনা জরুরি ছিল।

বইটিতে সুন্দরবনের মানুষের বিপন্নতা এবং সরকারি সংরক্ষণভাবনার সঙ্গে সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকার সংঘাতের কথা বারে বারে এসেছে। এসেছে লাগাতার সরকারমুখিনতার কথা এবং ত্রাণের অর্থ, চাকরি, ও অন্য নানা রকম সুবিধা আদায়ের সর্বব্যাপী তাগিদের কথা। এগুলি প্রশ্নাতীত বাস্তব। কিন্তু বাস্তবের অন্য মুখও রয়েছে। সাগর, নামখানা, বাসন্তী, গোসাবা, সন্দেশখালি-২ প্রভৃতি ব্লকের অনেক জায়গায় কিছু আঞ্চলিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের উদ্যোগে সাধারণ মানুষ নদীর চরে ম্যানগ্রোভ লাগিয়ে নোনা প্লাবনের সম্ভাবনা কমানোর চেষ্টা করেছেন। গোসাবা, সন্দেশখালি-২, ও হিঙ্গলগঞ্জ ব্লকে নদীতে নেমে বাগদার মিন ধরা মেয়েদের স্বনির্ভর গোষ্ঠীতে সংগঠিত করে পরিবেশমুখী সমন্বিত চাষের মাধ্যমে স্বাবলম্বন ও টেকসই জীবিকা তৈরির প্রচেষ্টা হয়েছে এবং তা বহু ক্ষেত্রে সফলও হয়েছে। সংরক্ষণ ও স্বাবলম্বনে আঞ্চলিক উদ্যোগের এই অভিজ্ঞতাগুলিকে লক্ষ করা এবং এগুলিকে কী ভাবে বৃহত্তর প্রচেষ্টার সম্বল করা যায়, এ বিষয়ে ভাবনা দরকার।

বইটিতে ছাপার ভুল যৎসামান্য। নির্ঘণ্টটি খুব সংক্ষিপ্ত, প্রায় দায়সারা। তবে বইটি সুন্দরবন চর্চায় গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন।

আরও পড়ুন
Advertisement