আকার প্রকার গ্যালারিতে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হল দেবাঞ্জন রায়ের একক প্রদর্শনী। পরমা মাইতি পরিকল্পিত এই প্রদর্শনীর শিরোনাম ‘ওয়েস্ট সাইড স্টোরি’। ব্যবহৃত হতে হতে নিঃশেষ হয়ে যাওয়া পরিত্যক্ত বস্তুরও কিছু সামাজিক তাৎপর্য থাকে। সেই দৃষ্টিকোণ থেকেই দেবাঞ্জন চেষ্টা করেছেন পরিত্যক্ত বস্তুকে চোখের সামনে তুলে এনে এক দিকে সেই বস্তুর বিনষ্টি-সম্পৃক্ত অস্তিত্বের অন্তর্লীণ করুণাকে তুলে ধরতে, অন্য দিকে সেই বিনষ্টির সঙ্গে সাম্প্রতিক জীবনের দ্বন্দ্বাত্মক সম্পর্ককে উপস্থাপিত করতে। ভাস্কর্য, চিত্র, ইনস্টলেশন ও ভিডিয়ো ইত্যাদি অনেকগুলি মাধ্যমে তিনি একসঙ্গে কাজ করেছেন মূলত বিনষ্টির এই ভাবনাকে ভিন্ন ভিন্ন দিক থেকে রূপায়িত করতে।
দেবাঞ্জন মূলত একজন ভাস্কর। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভাস্কর্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শিক্ষা শেষ করেছেন যথাক্রমে ১৯৯৮ ও ২০০০ সালে। ২০০২-তে তাঁর প্রথম একক প্রদর্শনী হয় বিড়লা অ্যাকাডেমিতে। তার পর থেকে দেশে ও বিদেশে বহু একক ও সম্মেলক প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে তিনি প্রকাশের একটি নিজস্ব ধারা ও দর্শন তৈরি করেছেন। সমাজভাবনা ও প্রতিবাদী চেতনা তাঁর কাজের প্রধান বৈশিষ্ট্য। কৌতুক ও বিদ্রুপের সঙ্গে আত্মকরুণাকে মিলিয়ে তিনি আজকের বিশ্বায়িত, ভোগবাদী জীবনকে নানা ভাবে কশাঘাত করতে চান। যেমন তাঁর ‘নটরাজ’ ভাস্কর্যে নটরাজের মুখটি হয়ে ওঠে শিল্পীরই আত্মপ্রতিকৃতি। কিছু দিন আগে ইনস্টলেশনধর্মী এক ভাস্কর্যে তিনি তুলে ধরেছিলেন ধনী মানুষের খাওয়ার দৃশ্য। সুসজ্জিত তিন জন মানুষ চেয়ারে বসে উগ্র ভাবে কাঁটাচামচ দিয়ে খাচ্ছে। প্লেটে সাজানো খাদ্যবস্তুর মধ্যে মানুষের ছিন্ন হাত, আঙুলের টুকরো, কলজে বা হৃৎপিণ্ডের অংশ ইত্যাদি। অর্থাৎ মানুষই মানুষের খাদ্যবস্তু।
আলোচ্য প্রদর্শনীতে এতটা নৃশংসতা নেই। আছে প্রচ্ছন্ন করুণা ও শ্লেষ। বর্জ্য পদার্থের সামাজিক তাৎপর্য যেমন তিনি তুলে ধরেছেন, তেমনই একটি ভিডিয়োতে দেখিয়েছেন অবহেলিত, বর্জিত এক মানবী কেমন করে সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে নিজের অস্তিত্বকে তাৎপর্যপূর্ণ করে তুলতে পারে। সমস্ত ভ্রষ্টতার ভিতর এই আত্মশিখাই যে জীবনকে সঞ্জীবিত রাখে, বলা যেতে পারে, সেটাই আলোচ্য প্রদর্শনীর প্রচ্ছন্ন বাণী।
পরিত্যক্ত বস্তুর ভাস্কর্যগুলো তিনি করেছেন কাঠ দিয়ে। কাঠের কাজে তাঁর অসামান্য দক্ষতার পরিচয় রয়েছে। তিনি তৈরি করেছেন কাঁটা ভেঙে যাওয়া চিরুনি, ভেঙে যাওয়া চায়ের ছাকনি, বাথরুম পরিষ্কার করার ব্রাশ, মাছ মারার দণ্ড, স্যালাইন বোতল, পরিত্যক্ত রেফ্রিজারেটর, ময়লা ফেলার ব্যাগ ইত্যাদি। প্রত্যেক ক্ষেত্রেই একটুকরো কাঠ কেটে নির্দিষ্ট বস্তুর বর্জ্য-অস্তিত্বকে বের করে এনেছেন অত্যন্ত দক্ষ ভাবে। ‘গারবেজ ব্যাগ’টির কথাই ধরা যায়। মুখ বাঁধা ব্যাগটির ভিতরের বস্তুগুলির অস্তিত্বকে নিপুণ ভাবে নিয়ে আসতে পেরেছেন দর্শকের অনুভবে।
একই ধরনের বস্তু তিনি জলরঙেও করেছেন। চিরুনি বা দাড়ি-কামানোর রেজর-এর পাশাপাশি এঁকেছেন একটি মোচার প্রতিকৃতি। জলরং ব্যবহারের দক্ষতা প্রতিটি বস্তুকেই জীবন্ত করে তুলতে পেরেছে। অ্যাক্রিলিক ও জলরঙে আঁকা একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে সোনালি রঙের একটি টয়লেট-ব্রাশের উপর বসে আছে একটি প্রজাপতি ও কাঠঠোকরা পাখি। দৃশ্যটি খুব বাস্তবানুগ নয়। কিন্তু বর্জ্যবস্তু ও প্রাকৃতিক প্রাণের এই সমন্বয় বিশেষ এক উজ্জীবনের বার্তা নিয়ে আসে।
কৃত্রিম পোশাক দিয়ে তৈরি ‘Hauto Couture’ শীর্ষক ইনস্টলেশনটি স্বতস্ফূর্ত নান্দনিকতায় অভিষিক্ত হতে পারেনি। তাই একটু কঠিন ও আরোপিত লাগে। কিন্তু ‘কাটিং ফিশ’ শীর্ষক ৬ মিনিটের ভিডিয়োটিতে শিল্পী তাঁর সামাজিক ও নান্দনিক অবস্থানকে প্রজ্ঞাদীপ্ত ভাবে উপস্থাপিত করতে পেরেছেন। শহরতলির এক বিপন্ন নারী তাঁর নিজের সংসার প্রতিপালন ও কন্যাকে লেখাপড়া শেখানোর জন্য বাজারে মাছ-কাটার পেশা বেছে নেয়। পুরো ভিডিয়ো জুড়ে আমরা দেখি মাছের বাজার, বিক্রেতা, ক্রেতা আর মাছ কাটার নানা প্রকরণ। এর ভিতর দিয়ে জীবন-জীবিকা, জীবন-মৃত্যুর টানাপোড়েনের যে আলেখ্য উৎসারিত হতে থাকে, তা খুবই তাৎপযর্পূর্ণ এবং আজকের প্রান্তিক বাঙালিজীবনকে তা নানা মাত্রায় ব্যঞ্জিত করেছে।