পুস্তক পরিচয় ৩

পশ্চিম হিমালয়ে বৌদ্ধ সংস্কৃতির উত্তরাধিকার

সূচনায় দলাই লামার এই বার্তা আলোচ্য বইটির সুর বেঁধে দিয়েছে। পশ্চিম হিমালয়ের পাদদেশ ও অন্তর্ভাগ এক বিস্ময়কর সাংস্কৃতিক অঞ্চল, যেখানে আক্ষরিক অর্থে পুব-পশ্চিম মিলেমিশে একাকার। ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠী এখানে হাত মিলিয়েছে এক দিকে তিব্বতি-বর্মি, অন্য দিকে তুর্কো-মঙ্গোলীয় উপভাষার সঙ্গে।

Advertisement
ইন্দ্রজিৎ চৌধুরী
শেষ আপডেট: ২৪ অক্টোবর ২০১৫ ০০:০১
ইন্ডিয়ান টিবেট টিবেটান ইন্ডিয়া/ দ্য কালচারাল লিগ্যাসি অব দি ওয়েস্টার্ন হিমালয়াজ, পিটার ফান হ্যাম। নিয়োগী বুকস, ২৪৯৫.০০

ইন্ডিয়ান টিবেট টিবেটান ইন্ডিয়া/ দ্য কালচারাল লিগ্যাসি অব দি ওয়েস্টার্ন হিমালয়াজ, পিটার ফান হ্যাম। নিয়োগী বুকস, ২৪৯৫.০০

‘‘আমরা, তিব্বতিরা, ভারতের কাছে নানা ভাবে ঋণী। আমাদের দুই দেশের আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক বহু দিনের। তিব্বতের ইতিহাসের প্রথম হাজার বছর আমরা ছিলাম মধ্য এশিয়ার অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তি। ভারত থেকে বৌদ্ধধর্ম আসার পরে অভিমুখ বদলে গেল। ব্যাপক ভাবে সংস্কৃত বৌদ্ধ শাস্ত্র তিব্বতি ভাষায় অনুবাদ শুরু হল, সৃষ্টি হল বিপুল সাহিত্যিক ঐতিহ্যের, যা আমাদের কাল পর্যম্ত এসে পৌঁছেছে। শিক্ষা ও ধর্ম চর্চার জন্য মঠ-মন্দির স্থাপিত হল, যা হয়ে উঠল শিল্প-সংস্কৃতির কেন্দ্র।’’

Advertisement

সূচনায় দলাই লামার এই বার্তা আলোচ্য বইটির সুর বেঁধে দিয়েছে। পশ্চিম হিমালয়ের পাদদেশ ও অন্তর্ভাগ এক বিস্ময়কর সাংস্কৃতিক অঞ্চল, যেখানে আক্ষরিক অর্থে পুব-পশ্চিম মিলেমিশে একাকার। ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠী এখানে হাত মিলিয়েছে এক দিকে তিব্বতি-বর্মি, অন্য দিকে তুর্কো-মঙ্গোলীয় উপভাষার সঙ্গে। জাতিগত দিক থেকেও একই রকম ঘটনা ঘটেছে। সব থেকে বড় কথা, আধুনিক পশ্চিমি প্রভাব থেকে এই সে দিন পর্যন্ত বহু দূরে থাকায় এই অঞ্চল তার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য অক্ষুণ্ণ রাখতে পেরেছে। আর সেই ঐতিহ্যের সঙ্গে যোগ তো দুই দেশের, ভারত ও তিব্বত। সে জন্যই তিব্বতে যা চির কালের মতো নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে, সেই প্রকৃত তিব্বতি সংস্কৃতি টিকে রয়েছে এখানেই।

এই সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের খোঁজেই ১৯৮০-র দশকে নেমে পড়েছিলেন জার্মান লেখক ও আলোকচিত্রী পিটার ফান হ্যাম। প্রথমে বইপত্র পড়া ছাড়া উপায় ছিল না, কারণ তখনও পশ্চিম হিমালয়ের ভারতীয় অঞ্চল বিদেশিদের জন্য উন্মুক্ত হয়নি। ১৯৯৩ সালে অনুমতি মিলল, তারপর ১৯৯৮ পর্যন্ত তিনি দফায় দফায় ফিরে এসেছেন এখানে, তন্নতন্ন করে দেখেছেন হাজার বছরের নিরবচ্ছিন্ন সাংস্কৃতিক জীবনধারাকে। মাঝে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল নিয়ে প্রায় এক দশকের অনুসন্ধানের পর আবার ফান হ্যাম ফিরে আসেন পশ্চিমে, খোঁজ পান ১৮৬৬ থেকে শুরু করে বিশ শতকের বহু দুর্লভ আলোকচিত্রের, যা দিয়ে ২০০৯-এ আয়োজিত হয় পশ্চিম হিমালয় নিয়ে এক প্রদর্শনী। সে উপলক্ষে জার্মান ভাষায় যে বইটি তিনি লিখেছিলেন, তারই পরিমার্জিত ইংরেজি অনুবাদ এ বার প্রকাশ করল নিয়োগী বুকস।

অষ্টম থেকে ত্রয়োদশ শতকে পশ্চিম হিমালয়ের বৌদ্ধ সংস্কৃতিতে ভারতীয় প্রভাবের সুস্পষ্ট প্রমাণ প্রথম মিলল ১৯০৯-এ এ এইচ ফ্রাঙ্কে-র অভিযানে, যার ফল প্রকাশিত হয় তাঁর অ্যান্টিকুইটিজ অব ইন্ডিয়ান টিবেট (১৯১৪) বইয়ে। চতুর্দশ শতকের মধ্যে ভারত থেকে বৌদ্ধধর্ম প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়, কিন্তু ভারত-তিব্বত সীমান্ত অঞ্চলে এবং পরে তিব্বতে যে বৌদ্ধ সংস্কৃতির উদ্ভব হয় তার জন্য অণুঘটকের কাজ করেছিল অন্ত্য পর্বের ভারতীয় বৌদ্ধ সংস্কৃতি। এর ফলে সৃষ্টি হয় নতুন শিল্পধারা, সে সময়ের স্থাপত্য-ভাস্কর্য-চিত্রকলায় তার চিহ্ন একমাত্র টিকে আছে এই অঞ্চলের গুটিকয় মঠ-মন্দিরে।

হিমাচল প্রদেশ ও জম্মু-কাশ্মীরের উত্তরাঞ্চলীয় জেলা কিন্নর, স্পিতি, লাহুল, রুপশু আর নুব্রা এখন তিব্বতের সঙ্গে ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত। উনিশ শতকের গোড়ায় হাঙ্গেরীয় ভাষাতাত্ত্বিক চোমা ডি কোরোস এই অঞ্চলে বসেই তৈরি করেন প্রথম ইংরেজি-তিব্বতি অভিধান, তিব্বত চর্চার ভিত্তি স্থাপিত হয় এই ভাবেই। ১৮৬৬-তে স্যামুয়েল বোর্ন এই অঞ্চলের অনেক ছবি তোলেন। ফ্রাঙ্কে-র অভিযানে ছবি তুলেছিলেন লাহৌরের বাবু পিন্ডি লাল। আলোচ্য বইয়ে এই দুজনেরই অনেক দুর্লভ ছবি মুদ্রিত হয়েছে।

পিটার ফান হ্যাম বইটিকে সাজিয়েছেন মূলত সিমলা-কিন্নর, স্পিতি, লাহুল, জাঁস্কর, রুপশু, লাদাখ, নুব্রা, দা-হানু— অঞ্চলভিত্তিক অধ্যায়ে। আছে পশ্চিম হিমালয়ের বৌদ্ধ শিল্প নিয়ে আলাদা আলোচনা। লাদাখের অলচি, স্পিতি-র তাবো, কিন্নরের পু আর নাকো-র মতো আরও অনেক বৌদ্ধমঠের নতুন-পুরনো ছবির সঙ্গে আছে অঞ্চলের প্রকৃতি ও মানুষের কথাও, সংস্কৃতির বৈচিত্রে তো তারাও অঙ্গািঙ্গ। পশ্চিম হিমালয়ের এক সামগ্রিক সংস্কৃতিচিত্র তুলে ধরার জন্য পিটার অবশ্যই ধন্যবাদার্হ।

আরও পড়ুন
Advertisement