পুস্তক পরিচয় ১

প্রশ্ন কি নিছক আইনশৃঙ্খলার

প্রায় পাঁচশো পাতার গ্রন্থে মনোরঞ্জন মোহান্তি দীর্ঘ প্রায় পাঁচ দশকের মাওবাদী আন্দোলনের আঁতুড়ঘর থেকে শুরু করে আজকের বিপুল শাখা-প্রশাখা বিস্তার করা এই আন্দোলনের, বলা যেতে পারে চরিত্রায়ন করেছেন।

Advertisement
তাপস সিংহ
শেষ আপডেট: ০৭ নভেম্বর ২০১৫ ০০:০১
রেড অ্যান্ড গ্রিন/ফাইভ ডিকেডস অফ দি ইন্ডিয়ান মাওয়িস্ট মুভমেন্ট, মনোরঞ্জন মোহান্তি। সেতু প্রকাশনী, ৯৫০.০০

রেড অ্যান্ড গ্রিন/ফাইভ ডিকেডস অফ দি ইন্ডিয়ান মাওয়িস্ট মুভমেন্ট, মনোরঞ্জন মোহান্তি। সেতু প্রকাশনী, ৯৫০.০০

দান্তেওয়াড়া শহরে ঢোকার মুখের সেই দৃশ্যটা এখনও চোখে ভাসে! রাস্তার ধারের একটি বাড়ির সামনে ডাঁই করে রাখা বালির বস্তার আড়াল থেকে বন্দুকের নলের মতো একটা লাঠি তাগ করে রেখেছে এক বালক। আর সামনে দিয়ে চোখে-মুখে আতঙ্ক আনার চেষ্টা করে মাথার উপরে দু’হাত তুলে হেঁটে যাচ্ছে আরও দুই বালক। পাশ দিয়ে বইছে নাগরিক জীবন। এ দিকে ভ্রূক্ষেপের সময় নেই কারও।

যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা। রণাঙ্গনের খেলা এ রকমই। ছত্তীসগঢ়, কাবুল, জাফনা, সিরিয়া— কোনটা যে নাগরিক মুখ আর কোনটা যুদ্ধের মুখোশ, বোঝা যায় না!

Advertisement

এই যে চারপাশের চির-চেনা সুখী সুখী জীবন আর তার আড়ালে ততটা-নাগরিক-নয় যে জীবনটা, তার মধ্যেকার নিরন্তর বিরোধ, তার শ্রেণিগত ফারাক, তার ছোট ছোট চাওয়া আর তা না পাওয়ার বিরোধ ঘোচাবে কে? কোন ধারার রাজনৈতিক নেতৃত্ব? কোন দলের? মূলধারার না কি চেনা গণ্ডি ছেড়ে কঠিন পথ বেছে নেওয়া রাজনৈতিক দল?

প্রশ্নগুলো মনে আসছে মনোরঞ্জন মোহান্তির রেড অ্যান্ড গ্রিন/ ফাইভ ডিকেডস অফ দি ইন্ডিয়ান মাওয়িস্ট মুভমেন্ট পড়তে পড়তে। প্রায় পাঁচশো পাতার এই গ্রন্থে মনোরঞ্জন মোহান্তি দীর্ঘ প্রায় পাঁচ দশকের মাওবাদী আন্দোলনের আঁতুড়ঘর থেকে শুরু করে আজকের বিপুল শাখা-প্রশাখা বিস্তার করা এই আন্দোলনের, বলা যেতে পারে চরিত্রায়ন করেছেন। যেন সুবিস্তৃত এক ধারাবিবরণী শুনতে শুনতে, তার বিশ্লেষণের গভীরে যেতে যেতে ‘দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার পক্ষে সব থেকে বিপজ্জনক’ এক আন্দোলনের ধারা বোঝা যায়।

উত্তরবঙ্গের একদা অখ্যাত সেই গ্রাম নকশালবাড়ি আর তার পরে অন্ধ্রপ্রদেশের শ্রীকাকুলাম থেকে যে আন্দোলন মাথাচাড়া দিল, রাষ্ট্রের ভয়ঙ্কর নিপীড়নের পরেও, রাষ্ট্র ও মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোর ভয়াল দাঁত-নখ বের করার পরেও সেই আন্দোলন অবদমিত না হয়ে কী করে দেশের বিভিন্ন রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ল, তা এখনও নিরন্তর গবেষণার বিষয়। তা হলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, চিন বিষয়ক বিশেষজ্ঞ, মানবাধিকার আন্দোলনের সঙ্গে নানা ভাবে যুক্ত মনোরঞ্জন মোহান্তির এই নতুন বইয়ের বিশেষত্ব কোথায়?

বস্তুত, নকশালবাড়ি আন্দোলনের প্রথম দশকের উপর ১৯৭৭-এ মনোরঞ্জনের একটি গবেষণাধর্মী গ্রন্থ প্রকাশিত হয়: রেভলিউশনারি ভায়োলেন্স: আ স্টাডি অফ দ্য মাওয়িস্ট মুভমেন্ট ইন ইন্ডিয়া। আলোচ্য বইটির প্রথম পর্ব হিসেবে সেই আগের গ্রন্থটি রাখা হয়েছে। পরের পর্বে সংযোজিত হয়েছে বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ। এই পরের পর্বের রচনাগুলিতে বিবৃত হয়েছে কী ভাবে মাওবাদী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ছে দেশ জুড়ে। কী ভাবে চারু মজুমদারের ‘খতম লাইন’ পেরিয়ে এই আন্দোলন হয়ে উঠছে আরও বহুমুখী। সেই প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে গ্রন্থের প্রথম পর্বের খামতি নিয়ে একটু বলা প্রয়োজন। নকশালপন্থী আন্দোলনের গোড়ার এক দশকের যে কথা সেই ’৭৭-এ বলেছিলেন মোহান্তি, এই পর্বের নতুন গ্রন্থে সেটির পুনর্মুদ্রণের সময় আরও কয়েকটি গ্রন্থের উল্লেখ করা প্রয়োজন ছিল। কারণ, ওই গ্রন্থগুলি ছাড়া নকশালপন্থী আন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায়ের ইতিহাস অসম্পূর্ণ থাকে। যেমন, এডওয়ার্ড ড্যুকার-এর (Edward Duyker) ট্রাইবাল গেরিলাজ: দ্য সানথালস অফ ওয়েস্ট বেঙ্গল অ্যান্ড দ্য নকশালাইট মুভমেন্ট। যে গ্রন্থে নকশালপন্থী আন্দোলনে আদিবাসীদের ভূমিকার চমৎকার ব্যাখ্যা ছিল। যেমন, সুমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের ইন দ্য ওয়েক অফ নকশালবাড়ি। ১৯৮০-তে প্রকাশিত এই গ্রন্থকে একটি মাইলফলক হিসেবে মনে করা হয়। এ ব্যাপারে সমর সেন, দেবব্রত পন্ডা এবং আশিস লাহিড়ীর খুব ভাল কাজ রয়েছে। যে হেতু এত দিন পরে এত চমৎকার একটি গ্রন্থ উপহার দিয়েছেন মনোরঞ্জন মোহান্তি, তাই এই বিষয়গুলির উল্লেখ তাকে সর্বাঙ্গসুন্দর করতে পারত।

ইউপিএ আমলে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ যাদের ‘দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার পক্ষে সব থেকে বিপজ্জনক’ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন, এনডিএ সরকারের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তার থেকে ভিন্নমত হবেন কী করে? রাজনৈতিক পালাবদল মানেই যে মাওবাদী আন্দোলন সম্পর্কে রাষ্ট্রের ভাবনাচিন্তারও বদল হবে তার কোনও অর্থ নেই। তাই ২০১৪-র ২৭ জুন মাওবাদী প্রভাবিত রাজ্যগুলির মুখ্যসচিব এবং পুলিশের ডিরেক্টর জেনারেলদের এক বৈঠকে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ স্পষ্ট করে দেন, মাওবাদীদের নির্মূল করতে চেনা পথেই, অর্থাৎ, নিরাপত্তা বাহিনীর শক্তির উপরেই মূলত নির্ভর করবেন তাঁরা। এ জন্য তহবিলের কোনও অভাব হবে না। হিংসা বন্ধ না করলে মাওবাদীদের সঙ্গে আলোচনার প্রস্তাবও তিনি নাকচ করে দেন। মজার কথা হল, তাদের পূর্বসূরি যে ইউপিএ সরকারকে মাওবাদীদের প্রতি ‘নরম’ বলে অভিযোগ এনেছিল এনডিএ, তাদের সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পালনিয়াপ্পন চিদম্বরম-ই ‘অপারেশন গ্রিন হান্ট’-এর হোতা। এবং সেই আমলে বিজেপি-শাসিত দুই রাজ্য ছত্তীসগঢ় ও ঝাড়খণ্ডও যথারীতি নিরাপত্তা বাহিনীর ভারী বুটের উপরেই ভরসা রেখেছে!

তা হলে কি যুগের পর যুগ এই সামরিক শক্তির উপরেই ভরসা করবে রাষ্ট্রশক্তি? নিছক আইনশৃঙ্খলার প্রশ্নেই বিবেচিত হবে দীর্ঘ পাঁচ দশকের এই সমস্যা? প্রশ্ন তুলেছেন মনোরঞ্জন। এ দেশের মাওবাদী আন্দোলনের উপরে চিন বিপ্লবের প্রভাবের কথা বলেছেন। তুলেছেন আন্তর্জাতিকতার প্রসঙ্গও।

বদলে যাচ্ছে প্রেক্ষাপট। শুধু ভূমি সংস্কার বা সম্পদের সমবণ্টনের প্রসঙ্গ ছাপিয়ে অরণ্যের অধিকার, ‘জল-জঙ্গল জমিন’-এর অধিকার, পরিবেশ আন্দোলন, ‘উন্নয়ন’-এর বুলডোজারের সামনে আদিবাসী-মূলবাসী-ভূমিপুত্রদের উৎখাত হতে থাকা— আজ সব দিকেই ডানা মেলেছে নকশাল আন্দোলন। নিজেদের ভিটে থেকে উৎখাত হওয়া ভূমিপুত্রদের মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। খাদ্য সুরক্ষার গালভরা প্রকল্পের বাইরে পড়ে রয়েছে অসংখ্য মুখ!

মনোরঞ্জন মোহান্তির এই গ্রন্থ ‘সুখী’ নগরজীবনের বাইরে থাকা ওই মুখগুলির ছবি তুলে আনল আবার! খুব জরুরি ছিল এই চেতাবনি।

আরও পড়ুন
Advertisement