পুস্তক পরিচয় ১

প্রবহমানতা ও পরিবর্তনের ধারা

জয়ন্ত সেনগুপ্তর সাম্প্রতিক বই ভারতীয় ইতিহাস আলোচনার পুরনো সীমাবদ্ধতাগুলিকে সার্থক ভাবে অতিক্রম করে। আলোচ্য গ্রন্থের উপজীব্য বিষয় হল বিংশ শতাব্দীর ওড়িশা, যাকে একদা জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের একটি পশ্চাৎপদ অঞ্চল বলেই গণ্য করা হত।

Advertisement
শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ৩১ অক্টোবর ২০১৫ ০০:০১
অ্যাট দ্য মার্জিনস/ ডিসকোর্সেস অব ডেভলপমেন্ট, ডেমোক্রেসি অ্যান্ড রিজিওনালিজম ইন ওড়িশা, জয়ন্ত সেনগুপ্ত। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১১৯৫.০০

অ্যাট দ্য মার্জিনস/ ডিসকোর্সেস অব ডেভলপমেন্ট, ডেমোক্রেসি অ্যান্ড রিজিওনালিজম ইন ওড়িশা, জয়ন্ত সেনগুপ্ত। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১১৯৫.০০

এই কিছু দিন আগে পর্যন্ত ঐতিহাসিকরা মনে করতেন যে আধুনিক ভারতের ইতিহাসের আলোচনাটা ১৯৪৭-এর অগস্ট মাসেই শেষ করে দেওয়া ভাল। কারণ সরকারি লেখ্যাগারে উত্তর-ঔপনিবেশিক যুগের ওপর কাগজপত্র বিশেষ পাওয়া যায় না। আর এই ঔপনিবেশিক যুগের আলোচনায় অনেকখানি জায়গা জুড়ে থাকত জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের ইতিহাস, ভারতীয় জাতি গঠনের আদর্শবাদী কাহিনি, অনেকের মতেই যার স্বাভাবিক পরিসমাপ্তি ঘটেছিল ১৯৪৭-এ ভারতীয় জাতীয় রাষ্ট্র স্থাপনের মধ্য দিয়ে। কাজেই ১৯৪৭-এ আলোচনার ছেদ টানাটা ছিল বেশ সুবিধাজনক।

অন্য দিকে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের উপর অতিরিক্ত ঝোঁকের ফলে আর একটি সীমাবদ্ধতাও দেখা যেত। যে অঞ্চলগুলি এই জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক সচেতনতায় অগ্রণী ছিল সেই অঞ্চলগুলির ইতিহাস-ই লেখা হচ্ছে বেশি, যেমন বাংলা, বম্বে, মাদ্রাজ। তুলনায় যে অঞ্চলগুলিতে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন দেরিতে শুরু হয়েছে— যেমন ওড়িশা অথবা উত্তর-পূর্ব ভারত, অথবা ভারতীয় রাজন্যশাসিত রাজ্যগুলি— সেখানকার ইতিহাস চর্চা তুলনামূলক ভাবে হয়েছে অনেক কম।

Advertisement

তবে এখন আমরা এই সীমাবদ্ধতাগুলিকে খানিকটা কাটিয়ে উঠছি। সরকারি লেখ্যাগারের ওপর নির্ভরশীলতা কমেছে। অন্যান্য নানা ধরনের সূত্র থেকে অতীতকে পুনর্গঠনের চেষ্টা শুরু হয়েছে, জাতীয়তাবাদকে প্রশ্ন করতে শুরু করেছি। তাই উত্তর-ঔপনিবেশিক যুগের ইতিহাস আলোচনা এখন আর নিষিদ্ধ নয়। আর তাই অপেক্ষাকৃত পিছিয়ে-পড়া মানুষ ও অঞ্চলগুলির ইতিহাস আলোচনা শুরু হয়েছে।

জয়ন্ত সেনগুপ্তর সাম্প্রতিক বই ভারতীয় ইতিহাস আলোচনার পুরনো সীমাবদ্ধতাগুলিকে সার্থক ভাবে অতিক্রম করে। আলোচ্য গ্রন্থের উপজীব্য বিষয় হল বিংশ শতাব্দীর ওড়িশা, যাকে একদা জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের একটি পশ্চাৎপদ অঞ্চল বলেই গণ্য করা হত। আলোচনার শুরু ওড়িয়া ভাষাভিত্তিক আঞ্চলিক আন্দোলনের সূত্রপাত থেকে, ১৯৩৬-এ ভাষাভিত্তিক প্রদেশ স্থাপনের মধ্য দিয়ে যার আপাত পরিসমাপ্তি। অন্য প্রান্তে আলোচনাকে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ২০০৯-এর বিধানসভা নির্বাচন পর্যন্ত। এই দীর্ঘকাল ব্যাপী ইতিহাসের আলোচনার মধ্য দিয়ে আমরা ওড়িশার সমাজ ও রাজনীতির বিবর্তনের একটা সামগ্রিক ছবি পাই যা ১৯৪৭-এর বিভেদ রেখাকে অতিক্রম করে। লেখকের মতে ঔপনিবেশিক ও উত্তর-ঔপনিবেশিক যুগের মধ্যে অবশ্যই কিছুটা ধারাবাহিকতা বা ‘কন্টিনিউটি’ ছিল। কিন্তু পরিবর্তনও চোখে পড়ে যথেষ্ট। ঔপনিবেশিক রাজনীতির মূল উপজীব্য বিষয়গুলি স্বাধীনতার পরেও টিকে ছিল, কিন্তু সেগুলির অভিব্যক্তি ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। প্রবহমানতা ও পরিবর্তনের এই জটিল টানাপড়েনের ছবিটা-ই পরিষ্কার ভাবে উঠে আসে ওড়িশার জনজীবনের এই দীর্ঘকালীন বা ‘longue duree’ ইতিহাস থেকে।

ঊনবিংশ শতকের শেষে ওড়িশার সমাজ ভারতের অন্যান্য প্রদেশের সমাজের মতোই ছিল বহুত্ববাদী। একদিকে ছিলেন ব্রাহ্মণ ও অন্যান্য উঁচু জাতির শিক্ষিত ওড়িয়া মধ্যবিত্তশ্রেণী, জমিদার ও রাজন্যবর্গ, আর অন্য দিকে দলিত ও আদিবাসী, যাঁদের বেশির ভাগই কৃষক। একদিকে উর্বর উপকূলবর্তী জেলাগুলি, অন্য দিকে ঊষর পার্বত্য অঞ্চল। এক দিকে ব্রিটিশ শাসিত অঞ্চল, অন্য দিকে দেশীয় রাজন্যবর্গ শাসিত রাজ্যগুলি। আর এই বিভাজনে এক অতিরিক্ত মাত্রা যোগ করেছিলেন শিক্ষিত বাঙালি ভদ্রলোকরা, যাঁরা ব্রিটিশ শিক্ষাব্যবস্থার প্রথম সুবিধাভোগী হওয়ার সুবাদে মাঝারি সরকারি চাকরিগুলো দখল করে রেখেছিলেন। এই অবস্থার ফলেই সৃষ্টি হয় শিক্ষিত ওড়িয়া মধ্যবিত্তের নেতৃত্বে ভাষাভিত্তিক আঞ্চলিক স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলন। এই আন্দোলন সার্থক হয় ১৯৩৬ সালে, যখন ওড়িশা আত্মপ্রকাশ করে ভারতের প্রথম ভাষাভিত্তিক প্রদেশ হিসেবে।

কিন্তু এই শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ও বড় জমিদার শ্রেিণর ভাষাভিত্তিক আঞ্চলিক আত্মপরিচয়ের রাজনীতির প্রভাব ওড়িয়া কৃষকদের ওপর ছিল সীমিত। আর তাই ১৯২০ থেকে ১৯৪০-এর দশকে কংগ্রেসের নেতৃত্বে গণমুখী জাতীয় আন্দোলন গড়ে ওঠে কৃষকের স্থানীয় অভাব অভিযোগকে কেন্দ্র করে, যার অনেকগুলিই ছিল জমিদারশ্রেিণ ও রাজন্যবর্গের বিরুদ্ধে। কখনও কখনও তা কংগ্রেস রাজনীতির সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে খাজনা বন্ধের আন্দোলনেও রূপান্তরিত হয়েছে, যা কংগ্রেস নেতৃত্ব সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেছে। আঞ্চলিকতার কোনও স্থান এই আন্দোলনে না থাকলেও, ভাষাভিত্তিক ওড়িয়া জাতীয়তাবদের বিলুপ্তি ঘটেনি।

এই সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয়ের সঙ্গে ওড়িয়া সমাজের শ্রেিণবিন্যাসের যে সম্পর্ক তা এক নতুন রূপ পায় স্বাধীনতার পর, নির্বাচনী গণতন্ত্রের চাপে। আঞ্চলিক আন্দোলন প্রথম থেকেই দাঁড়িয়ে ছিল উন্নয়নের অভাব এবং সরকারি নিস্পৃহতার অভিযোগের ওপর। এই অনগ্রসরতার যুক্তিই ক্রমে কেন্দ্রীয় বনাম প্রাদেশিক রাজনীতির মূল কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু উত্তর-ঔপনিবেশিক ওড়িশায় এই আপেক্ষিক উন্নয়নের বিতর্কে আর একটি মাত্রা যুক্ত হল, এবং তা হল প্রদেশের ভেতরেই উপকূল ও পার্বত্য অঞ্চলের অসমান উন্নয়নের অভিযোগ যা ১৯৪৯ সালে দেশীয় রাজ্যগুলি ওড়িশা প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর থেকেই মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে থাকে। ১৯৪৮-’৫০ সালে এই রাজনৈতিক ধারার মূল ধারক ও কংগ্রেসের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল গণতন্ত্র পরিষদ। অন্য দিকে পার্শ্ববর্তী তেলঙ্গনায় সশস্ত্র কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রভাবে ওড়িশাতেও শুরু হল উগ্র বামপন্থী আন্দোলন। এই দুই ধরনের আন্দোলনকেই হরেকৃষ্ণ মহতাবের কংগ্রেসি সরকার ঔপনিবেশিক শাসনের ধাঁচে কঠিন হাতে দমন করার চেষ্টা করে। কিন্তু এতগুলি সমস্যার চাপে কংগ্রেসের মধ্যেই গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে, যার সূত্রপাত হয়েছিল ১৯৩০ ও ’৪০-এর দশকেই। এই ভাবেই ওড়িশার রাজনৈতিক ইতিহাসে ঔপনিবেশিক থেকে উত্তর-ঔপনিবেশিক যুগে উত্তরণের অধ্যায়ে পুরনো দাবি ও দ্বন্দ্বগুলি নতুন পোশাকে আত্মপ্রকাশ করতে থাকে।

পরবর্তী পর্যায়ে নির্বাচনী রাজনীতিতে ওড়িয়া আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদের গণ আবেদন কোনও রাজনীতিক-ই উপেক্ষা করতে পারেননি। তবে এই দাবি প্রকাশ পেয়েছে এক নতুন রাজনৈতিক ভাষায়— অপেক্ষাকৃত অনুন্নত প্রান্তিক প্রদেশের প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের বিমাতৃসুলভ আচরণের অভিযোগের মধ্য দিয়ে। এই প্রেক্ষাপটেই ক্রমশ ওড়িয়া কংগ্রেসের পত্তন ঘটেছে দলাদলি ও দুর্নীতির চাপে। বিজু পট্টনায়ক জনতা দলে যোগ দিয়েছেন, তাঁর ছেলে নবীন পট্টনায়ক বাবার নামে নতুন দল গঠন করেছেন— বিজু জনতা দল। ভারতীয় জনতা পার্টি ও হিন্দুত্ব রাজনীতির প্রবেশ ঘটেছে। খ্রিস্টানদের উপর আক্রমণ হয়েছে। ১৯৯০ দশকের অর্থনৈতিক সংস্কারের দৌলতে উন্নতিও হয়েছে— বিদেশি পুঁজি লগ্নি হয়েছে। অন্য দিকে অপেক্ষাকৃত অনুন্নত অঞ্চলে আদিবাসীদের মধ্যে মাওবাদী আন্দোলন দেখা দিয়েছে। কিন্তু ওড়িয়া সাংস্কৃতিক আঞ্চলিকতাবাদ ও উন্নয়নের রাজনীতিও টিকে থেকেছে।

জয়ন্ত সেনগুপ্ত একটি অপেক্ষাকৃত স্বল্প আলোচিত প্রান্তিক প্রদেশের একটি দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক ইতিহাস উপস্থাপন করেছেন, নানা ধরনের সূত্র থেকে তথ্য সংগ্রহ করে। স্বাভাবিক কারণেই, ঔপনিবেশিক যুগের ওপর অধ্যায়গুলি যতটা তথ্যসমৃদ্ধ, উত্তর-ঔপনিবেশিক যুগের আলোচনা ততটা গভীর নয়। কিন্তু যে কারণে বইটি উল্লেখযোগ্য হয়ে থাকবে তা হল ১৯৪৭-এর বিভাজনরেখা অতিক্রম করে ভারতীয় ইতিহাসের প্রবহমানতা ও পরিবর্তনকে বুঝতে এই বই আমাদের সাহায্য করবে।

আরও পড়ুন
Advertisement