পুস্তক পরিচয় ১

তখনও যেমন অবাক করা, এখনও তাই

হাতে সমগ্র বাসুদেব। সেই বাসুদেব যাঁর মুখোমুখি বসেছিলাম প্রায় সাঁইত্রিশ বছর আগের এক গ্রীষ্মের দুপুরে। আমার সঙ্গে কবি তুষার চৌধুরী। আমি দেখছিলাম কফি হাউসের মস্ত সব দেওয়ালে রতনপুরের বাসিন্দারা এঁকেছে পাহাড়চুড়োয় সাদা বরফ। বাসুদেবের রতনপুরের সকলে হাজির কফি হাউসে।

Advertisement
অমর মিত্র
শেষ আপডেট: ২৬ জুলাই ২০১৪ ০০:০১

হাতে সমগ্র বাসুদেব। সেই বাসুদেব যাঁর মুখোমুখি বসেছিলাম প্রায় সাঁইত্রিশ বছর আগের এক গ্রীষ্মের দুপুরে। আমার সঙ্গে কবি তুষার চৌধুরী। আমি দেখছিলাম কফি হাউসের মস্ত সব দেওয়ালে রতনপুরের বাসিন্দারা এঁকেছে পাহাড়চুড়োয় সাদা বরফ। সূর্যের আলো পড়ে পাহাড়ের ওপারে আকাশ লাল। পাহাড়ের গা বেয়ে ছুটে চলেছে ঝরনা। বাঁ দিকের দেওয়ালে দিগন্ত জোড়া সবুজ মাঠ। কিশোরী চুমকির খোঁপার ভিতরে নীলুদা। বাসুদেবের রতনপুরের সকলে হাজির কফি হাউসে। ওই যে চুমকি, রুমকি, শেফালিদি, অচিন্ত্য, মন্টু... দেওয়ালে নীল সমুদ্র, মৎস্যকুমারীরা সাঁতার কাটছে সেই জলে। মনে হয়েছিল চার দিকের দমবন্ধ বাস্তবতার ভিতরে স্বপ্নবাস্তবতার সেই খেলা আবার শুরু হয়ে গিয়েছে। হ্যাঁ, বাসুদেবের গল্প ‘রন্ধনশালা’র সেই বরফে তৈরি ইগলুর মতো ঘরটিকেও যেন দেখতে পাচ্ছিলাম। তার আশপাশে নেই কোনও লোকবসতি। সামনে ছিল এক গহন বন, তা পেরোলে ধু ধু বালির মাঠ। তা পেরোলে হয়তো লোকালয়। ঘরের পিছনে এক নদী, তার কোথায় শুরু কোথায় শেষ তা জানা নেই। বাসুদেবের কথা শুনেছিলাম। রতনপুরের কথা না রন্ধনশালার কথা, না অন্য কথা, যা লেখা হয়নি তখনও সেই আদ্যন্ত রাজনৈতিক উপন্যাস ‘খেলাধুলা’র কথাই যেন শুনিয়েছিলেন তিনি। আসলে এই সমগ্র পড়তে

Advertisement

সংকলন ও সম্পাদনা: অপূর্ব সাহা।

আলাপ প্রকাশন, ৫০০.০০

পড়তে মনে হচ্ছে এমনই হতে পারে হয়তো। রতনপুর গল্পের সেই নৈসর্গিক বিবরণে মুগ্ধ হয়ে পাতা উল্টোতে উল্টোতে হাসান আজিজুল হকের গল্প নিয়ে তাঁর কথা শুনি, তিনি বলছেন, কেন শুধু মৃত্যুর উৎসব হাসানের লেখায়, কেন শুধুই হিম বাস্তবতা। হাসান নিজেই তো বলেছিলেন, এর ভিতরেই মানুষ কী ভাবে জীবনের জয়গান গেয়ে যায় সেই কথা। অথচ তিনি তা পারেননি। (‘মৃত্যুগুহা থেকে আরো এক কিস্তি’)। বাসুদেবের হাসান আজিজুল হককে নিয়ে সেই নিবিড় লেখা পড়ে ধরা যায় কেন তিনি ‘রতনপুর’ লেখেন। লেখেন ‘বসন্ত উৎসব’। সফল মিলনের পর প্রেমিকা মণিকার গলা টিপে খুন করে গল্পের সেই চরিত্র যুবকটি ঘুরতে ঘুরতে শেষে গিয়ে পড়ে বসন্তের উৎসবে। শিশুদের সঙ্গে আনন্দ ভাগ করে নিতে থাকে। সে এক আশ্চর্য গল্প। আর সেই রন্ধনশালা নামের কৃশকায় গল্পগ্রন্থটি যে বছর বেরোয় সেই বছরই ‘বিবর’ লেখা হয়। একই রকম ছিল ‘বসন্ত উৎসব’ আর ‘বিবর’-এ সেই খুনের বিবরণ। এই নিয়ে শোরগোল হয়। এই গ্রন্থে সব আছে। জানা কথা না-জানা কথা। পড়া গল্প না-পড়া গল্প। শুধু রন্ধনশালা নয়, বাসুদেব তাঁর খেলাধুলা উপন্যাসের জন্যও স্মরণীয় নিশ্চয়। আমাদের ভাষায় এমন রাজনৈতিক ইতিহাস লেখা হয়েছে বলে জানা নেই। কেউ বলবেন, উপন্যাসের আবার রাজনৈতিক কী? কিন্তু সকাল সন্ধে একটি মফসসল যা নিয়ে আন্দোলিত হয়ে থাকে, তা তো ওই রাজনীতিই। আর এও তো না-ভোলার কথা, পাট কেনার লোক নেই, চাষি ভিখিরি হচ্ছে, বর্গা হচ্ছে গরিবের জমিতে, খরার দুপুরে একটি বালক টিউব কলের হাতলে পেট চেপে জল বের করার ব্যর্থ চেষ্টা করে যাচ্ছে, মার্শাল টিটোর জীবনাবসান যুগোশ্লাভিয়ায় হলে, ইস্কুলের মাস্টাররা দু’পিরিয়ডের পর শোকপ্রস্তাব নিয়ে ছুটি চায়, সোভিয়েত কেন সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, কেন নয়। এক এক জন এক এক রাজনীতি ধারণ করে, সমস্তটাই শেষ পর্যন্ত বুঝি মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল। খেলাধুলা, হাতাহাতি, খুনোখুনি। পৃথিবী এখন ভায়োলেন্স পছন্দ করে ভয়ানক। বাসুদেবের লেখার স্টাইল অসামান্য। উপন্যাসের বাস্তবতাকে তিনি গুলিয়ে দিতে দিতে এগোন। এই সময় থেকে সেই সময়ের কথায় অনবরত যাওয়া আসা করেন, কিন্তু তা হয় না ফ্ল্যাশব্যাক। হাংরি জেনারেশন সম্পর্কে পাঠকের অজ্ঞতাকে এই সমগ্র অনেকটা মুছে দিতে পারে। কেন পারে? খেলাধুলা লিখছেন বাসুদেব, আবার তেভাগা আন্দোলনের পঞ্চাশ বছর পূর্তিতে লেখেন তেভাগার কথা। আদ্যন্ত রাজনৈতিক মানুষ, মানবিক লেখক বাসুদেব। বিহারের লক্ষ্মণপুর বাথের গণহত্যা তাঁকে বিচলিত করে। লেখেন, “... এ অবাক গণতন্ত্রে হত্যাকারীরাই আগে শহিদদের জন্য চোখের জল ফেলে সব কিছু ঝাপসা করে দেয়।” এই কথা এখনও শোনা যায় হাংরি, ক্ষুধার্ত, বাসুদেব, শৈলেশ্বর, সুভাষ, মলয় ইত্যাদি... মানে যৌন বিবরণ। এই ক্ষুধা যৌনতা। বাসুদেব বলছেন, তাঁর ক্ষুধা মানুষের সার্বিক মুক্তির ক্ষুধা। গত শতাব্দীর ষাটের দশক, যে দশকে বাসুদেব লিখতে আরম্ভ করেন, সে দশকই তো ছিল বিদ্রোহের। খাদ্যের অভাবের কথা এখনও তো ভুলিনি। তার আঁচ পেয়েছি কি বাসুদেবের গল্প ‘রন্ধনশালা’য়? সেও তো এক অপরিসীম ক্ষুধার গল্প। লিখছেন তিনি খাদ্য-আন্দোলনের বছর-চার আগে। আসলে তাঁর লেখায় ছিল যে কুহক, এই জাগরণ পার করে যে স্বপ্নের ভিতরে তাঁর বাস্তবতা নিয়ে তিনি প্রবেশ করতেন, তা আমাদের ভাষায় ছিল তখনও যেমন অবাক করা, এখনও তাই। বাসুদেবের গল্প তাই পড়তেই হয়। হ্যাঁ, রন্ধনশালা প্রকাশের এই পঞ্চাশ বছর বাদেও।

সুভাষ ঘোষ এবং বাসুদেব দাশগুপ্ত। মলয় রায়চৌধুরী সম্পাদিত হাংরি জেনারেশন থেকে।

এই সমগ্রে রয়েছে বাসুদেবের ২৭টি গল্প। গল্পগুলি না পড়লে আমাদের সাহিত্যের এক গুরুত্বপূর্ণ লেখক না জানা থেকে যাবেন। অজ্ঞাত থেকে যাবে আমাদের সাহিত্য আন্দোলনের এক জরুরি অধ্যায়। লিখতে এসে বাসুদেবকে পড়ে অন্য ভাবে লেখার কথা মনে হয় আমাদের সময়ের কারও কারও। আলাপে আলাপে এই সব কথা বলেছি, শুনেছি অনেক। এখানে আছে পাঁচটি সাক্ষাৎকার। নানা লেখা, নিজে দুর্গাপুজোর আগে কথা বলেছেন দরিদ্র ব্রাহ্মণ, প্রেসের দরিদ্র কম্পোজিটর, প্রতিমাশিল্পীর সঙ্গে। তাঁর জীবন অন্বিত হয়েছিল সাধারণ মানুষের ভিতরে। এই সমগ্রে সব আছে। আছে হাংরি বিতর্ক, বন্ধু লেখকদের সঙ্গে বন্ধুতা, আর বিচ্ছেদের কথা। তাঁর নিজের সাক্ষাৎকারে রয়েছে এক অহংকারী লেখকের নিজের কথা, নিজের মত। স্পষ্ট কথা। জীবনানন্দে অনুরক্ত তিনি লেখা ছেড়ে দেওয়ার পরেও বিশ্বাস করতেন, ‘পৃথিবীর কিছু নিভৃত কুহক এখনো আমার জন্য রয়ে গেছে।’ সাক্ষাৎকারগুলি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাসুদেব তাঁর ফর্ম চর্চা নিয়ে বলছেন, ‘ফর্মটা কিন্তু তৈরি হয় লেখকের চিন্তাভাবনা, আচার আচরণ আর জীবনযাপন পদ্ধতি থেকেই।’ সাক্ষাৎকারে আছে তাঁর নিজের মানবিক কিছু মুহূর্তও। সমকাল ও আগের প্রজন্মের লেখকদের সম্পর্কে মূল্যায়ন। সমালোচনা। আর রয়েছে চিঠিপত্রে চাপানউতোর, বিষয় মাও সে তুং ও চিনের সাংস্কৃতিক বিপ্লব, বাসুদেব, সুভাষ ঘোষ, অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় ও সূর্য মুখোপাধ্যায়।

বাসুদেবকে ওই এক বারই রতনপুরে দেখেছিলাম সেই দুপুরে। অথবা তাঁর দৃষ্টিপথে চোখ মেলে বসন্ত উৎসবের সেই হ্রদ, ফুলপরি... তার পর তিনি অশোকনগর যাত্রা করলেন। গোলাপি মলাটের ‘ক্ষুধার্ত’ পত্রিকা আর এখানে ওখানে তাঁকে পেয়েছি সেই সময় বা তার আগে পরে। পুরনো ম্যাগাজিনে। ‘রিপুতাড়িত’ থেকে ‘দেবতাদের কয়েকমিনিট’, ‘ডঃ ওয়াং-এর গোপন সংকেত’, ‘মৃত্যুগুহা থেকে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় কিস্তি’...। সম্পাদক অপূর্ব সাহা যথেষ্ট পরিশ্রম করেছেন এই গ্রন্থনির্মাণে। তাঁকে ধন্যবাদ। রন্ধনশালা বইটি নিয়ে কবি অমিতাভ দাশগুপ্তের যে প্রস্তাবনা গ্রন্থারম্ভে রয়েছে, তা অনেকটা ভূমিকার মতোই। তিনি বাসুদেবে মুগ্ধ ছিলেন জানি।

আরও পড়ুন
Advertisement