পুস্তক পরিচয় ২

তুখোড়, তেতোরসিক, মেধাবী এক কবি

একটি জন্ম থেকে একটি প্রয়াণ এক সুতোয় বাঁধা পড়ল। আমার লেখকজন্ম আর ভূমেনদার প্রয়াণকাল সমান্তরাল দুটি সুতোর টানায় এক হল। আমার লেখাজীবনের গোড়ার দিকে প্রভাত চৌধুরী সম্পাদিত ‘কবিতা পাক্ষিক’ পত্রিকায় ভূমেন্দ্র গুহর একটি কবিতার নিবিড় পাঠ লিখেছিলাম।

Advertisement
যশোধরা রায়চৌধুরী
শেষ আপডেট: ২৬ ডিসেম্বর ২০১৫ ০০:০১
প্রতিকৃতি: প্রদীপ দত্ত

প্রতিকৃতি: প্রদীপ দত্ত

একটি জন্ম থেকে একটি প্রয়াণ এক সুতোয় বাঁধা পড়ল। আমার লেখকজন্ম আর ভূমেনদার প্রয়াণকাল সমান্তরাল দুটি সুতোর টানায় এক হল। আমার লেখাজীবনের গোড়ার দিকে প্রভাত চৌধুরী সম্পাদিত ‘কবিতা পাক্ষিক’ পত্রিকায় ভূমেন্দ্র গুহর একটি কবিতার নিবিড় পাঠ লিখেছিলাম। এতে ভূমেনদার কোনও বিশেষ প্রাপ্তি হয়ত হয়নি, আমার হয়েছিল। কেননা, লেখাটিতে যে ব্যাখ্যা ফেঁদে বসেছিলাম, তা বিপুল সমাদর পায়। ভূমেনদাও খুশি হয়েছিলেন। সেই থেকে তিনি আমার লেখাজীবনের আত্মীয়। আর আমার হাতেই আজ, পাকেচক্রে, সদ্যপ্রয়াত ভূমেন্দ্র গুহের দু খণ্ডের ভূমেন্দ্র গুহ’র কবিতা। আজ তো চোখ সজল হবেই। কোনও গভীর তত্ত্ব উপস্থাপনা নয়। আজ শুধু শ্রদ্ধা নিবেদন।

ভূমেন্দ্র গুহ-র কবিতা (১-২ খণ্ড), সম্পাদনা রাহুল পুরকায়স্থ। এবং মুশায়েরা, ৫৫০.০০ ও ৬৫০.০০

Advertisement

যে বইয়ের নামপত্রে, সেই তুখোড়, একটু তেতোরসিক, অত্যন্ত মেধাবী কবির কলম, লিখেছিল, ‘যাঁরা আমার কবিতা পড়েছেন/ যাঁরা আমার কবিতা পড়েন নি/ যাঁরা আমার কবিতা পড়েন/ যাঁরা আমার কবিতা পড়েন না/ যাঁরা আমার কবিতা পড়বেন/ যাঁরা আমার কবিতা পড়বেন না।’ এই বুদ্ধির ছোঁয়াচ তাঁর হাসির মতোই সর্বত্রব্যাপী। কবিতা খুব সিরিয়াস হলেও সেখানে তলায় তলায় এ রসবোধ প্রবহমান। কবি জানেনই, অনেকে তাঁর কবিতা পড়েন না। কেন না, তিনি ‘সকলের কবি’ নন। ‘কবি’ ভূমেন্দ্র গুহকে দেখার চোখ এতদিন আমাদের তৈরি হয়নি কেননা ‘ডাক্তারবাবু’ অথবা ‘জীবনানন্দ গবেষক’-এর মতো জরুরি পরিচিতি তাঁর কবিসত্তাকে ঢেকে অনেকটা বিরাজ করত। ভূমেনদার মতো গোপনতাবিলাসী, নির্জন, আত্মকথক কবির ভবিতব্যই স্বল্প পাঠকের। তাঁরা নিজের ভবিতব্যের রচয়িতাও বটেন।

কী অসম্ভব ভালবাসা নিয়ে বইটি সম্পাদনা করেছেন কবি রাহুল পুরকায়স্থ। নিবিড় নির্জন কবিতায় যিনি ভূমেনদার স্বজাতি। এই দু’খণ্ডে শুধু কবিতাই নেই; ভূমেন্দ্র গুহের আত্মকথন, তাঁর করা অনুবাদ, রণজিৎ দাশকে দেওয়া সাক্ষাৎকার, গৌতম বসুকে দেওয়া সাক্ষাৎকার এবং বীতশোক ভট্টাচার্য কৃত ভূমেন্দ্র গুহের উপর একটি নিবন্ধও আছে। গ্রন্থ-পরিচিতিটি অত্যন্ত সুসম্পাদিত, অনেক টীকা ও পরবর্তী আলোচনা যেখানে উদ্ধৃত হয়েছে। ভূমেন্দ্রকে বুঝতে সাহায্য করবে অনেকটাই।

১৯৫০-এর দশক থেকে লেখা শুরু করেও তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ১৯৯৪-এ। ১৯৫৭ থেকে ১৯৯০ দীর্ঘ নীরবতা, কবিতা ছেড়ে দেবেন ভেবেও ফের কবিতায় ফিরে আসা। নিজের তাগিদ ছাড়াও এক রকম প্রবণতা বা তাড়নার দ্বারা লিখতেন তিনি। সাক্ষাৎকারে বলেছেন: ‘কারুর হাতে অঢেল অনুর্বর সময় পড়ে আছে, তার এখন মরে গেলেই হয়, কিন্তু মরছে না; আত্মহত্যা করতে হলেও যে অমোঘ ক্রিয়েটিভিটিটা দরকার, তাও নেই তার; তখন সে সময়ের দুরাচার থেকে নিজেকে টিকিয়ে রাখতে পদ্য লেখার ছল চাতুরি করে যদি, তাকে পদ্যকার বলা চলে না; এই সব মিছে কথার ছল চাতুরি তো তার শেষ খড়কুটো। ভালো পদ্য লেখা চাট্টিখানি কথা নাকি? জীবনানন্দকে দেখুন-না। পদ্য লিখতে গেলে পদ্যকারের অনেকটাই আত্মপীড়ন লেগে যায়; ভেবে চিনতে প্ল্যান করে নয়, জিনিসটা এসে পড়ে নাছোড় ভাবে; তাড়ানো যায় না; পিঁপড়ের পেট টিপে-টিপে গুড় বার করার মতো পদ্যকার তাঁর অস্তিত্বের পেট টিপে–টিপে পদ্য বার করেন।’

হাস্যচ্ছলে, বিনয় করে, নিজেকে ‘অ-কবি’ প্রতিপন্ন করতে চেয়ে, ভূমেনদা তাঁর কাব্য-দর্শনটুকু বলেছেন এখানে। নিবিড় পড়াশুনোর প্রমাণ রেখেছেন ছত্রে ছত্রে অথচ নিজেকে নিয়ে ঠাট্টা করার অভ্যাস তাঁর যায়নি কোথাও। ঠিক যে ভাবে ব্যক্তি জীবনেও দুঁদে ডাক্তার, গভীর গবেষণার দিনগুলিতেও তিনি নিরহংকার। বলেছেন সাক্ষাৎকারে, ‘আমি যা-সব লেখালেখি করি, তা নিয়ে আমার কোনও মোহ নেই। ... হ’লে হচ্ছে, না হ’লে হচ্ছেনা। আমার যা মুরোদ, তার বেশি তো আর কিছু করতে পারব না।’

তাঁর কবিতাগুলো, গ্রন্থাকারে দেখলে বিস্ময় আসে। এত, এত লিখেছিলেন তিনি? এ যেন, ‘সারাজীবন ধরে আমরা একটিই কবিতা লিখে চলি’, এই বহু-উদ্ধৃত কথনের অনুসারী ভূমেনদা, পর পর বইতে, যম, পিতামহ, উত্তরপুরুষে, এক ধরনের টানা কথোপকথন করে চলেছেন প্রায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই। নাম কবিতার সঙ্গে ১,২,৩ জুড়ে সিরিজ লেখায় সে-প্রবণতা দেখি। প্রবণতা তাঁর শিকড়ে (বাবা মা দেশ উত্তরাধিকার মাটি জমি পরিবার)। অন্যেরা বলেছেন তাঁর লেখায় পুরাণচেতনার কথা। আমার মনে হয়েছে, তাঁর কবিতার ‘আত্ম’ এক পরিণত ভ্রমণকারী। চলা, চলা এবং চলার কবিতা তাঁর হাতে। আর হ্যাঁ, শরীর খুব বেশি ভাবে উপস্থিত। তাঁর অভিপ্রায় ও শব্দ পছন্দের একটি ক্ষেত্র শরীর। আরও লক্ষ করার বিষয়, ১৯৫০-এর কৃত্তিবাস আন্দোলনের ‘স্বীকারোক্তি’ কিছুটা ঢুকেছে তাঁর শিরায়, যদিও কৃত্তিবাসের চেয়ে এক বছরের বড় ‘ময়ূখ’ পত্রিকার সঙ্গে তাঁর বেড়ে ওঠা, তবু, কবিতায় সৎ হতে হবে, এই ধারণাটি কোথাও মাথায় গাঁথা ছিল তাঁরও। সেই সততার প্রমাণ শেষ বইটিতেও থেকে যায়। যা কিছু দেখছেন তার বিবরণ করতে করতেই তাঁর কবিতা হয়। তাই তিনি লিখতে পারেন, ‘সকাল বেলাটা ভালো নেই আজ, ক্ষ’য়ে যাচ্ছি।/ তুমি তৈরি করো, আর আমি ক্ষ’য়ে যাই।’ (‘ভালো নেই’, বেলা শেষের অতিকথন)

নির্মাণে আপাত সরল তিনি। তাঁর হাতে অক্ষরবৃত্ত বা মহাপয়ারের অনায়াসলব্ধতা আছে। কলমে অবলীলায় ঋতসত্যের মতো কিছু বিবৃতি রচনার সামর্থ্য। বিবৃতিমাত্রেই কবিতা নয়, কবিতা মাত্রেই বিবৃতি তো নয়ই। অথচ, কবিতায়, কারও কারও বিবৃতি একেবারেই অমোঘ, আশ্চর্য হয়ে ওঠে। যেমন বিনয় মজুমদার। তেমনই ভূমেন্দ্র। ‘টেবিলে কলম রাখলে দপ করে গোল আলো জ্বলে। কাচগুলি টুকরো টুকরো হয়।’ (‘টেবিলে কলম রাখলে’, ঋতুচক্র)।

আগেই বললাম, শরীরী কবিতায় ভূমেনদার অভিপ্রায়। ‘লিঙ্গত্বক সরে গেলে যেরকম ভয় এসে আহ্লাদে বিস্ময়ে সব সম্ভাবনা উপ্ত করেছিল।’ ‘মাঠে মাঠে রমণীরা আহত যোনির রক্তে গোধূম ধুয়েছে।’ ঋতুচক্র বইটির প্রায় সব কবিতাই এই পাঠে সমাকীর্ণ হবে। তীব্র রতির কবিতাও প্রবল ভাবে মেধাবী হয়ে ওঠে এখানে। ‘তোমার আঙুলগুলি’ অবশ্য লক্ষণীয়।

এই খণ্ডিত আলোচনায় কিছুই ধরা গেল না। বই দুটি মানুষের হাতে হাতে ফিরুক। পদ্য নিয়ে যাঁরা পাগল, তাঁরা আবার খুঁজে পান ভূমেনদাকে।

আরও পড়ুন
Advertisement