যে কোনও জাতির সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক প্রতিভাত হয় তার কারুশিল্পের মধ্যে। এর ভিতর বিধৃত থাকে পরম্পরাগত প্রজ্ঞা, যা সুদূর অতীত থেকে প্রবাহিত হয়ে আসে। বিবর্তনের পথে সেই প্রজ্ঞা সমৃদ্ধ হয় বাইরের প্রভাবকে আত্মস্থ করে। সেই প্রভাব দেশের ভিন্ন জনগোষ্ঠীর প্রজ্ঞা থেকে আসতে পারে, বিদেশ থেকেও আসতে পারে। কাজেই খুব সন্তর্পণে, খুব ধীর গতিতে বিশ্বায়নের একটা সূক্ষ্ম প্রক্রিয়াও চলতে থাকে কারুশিল্পের মধ্যে। উচ্চকোটির মানুষের ললিতকলা বা ফাইন-আর্টের ক্ষেত্রে এই বিবর্তন প্রক্রিয়া খুব দ্রুত সংঘটিত হয়। আবিশ্ব-উত্তরাধিকার খুব সহজে আত্তীকৃত হতে পারে চারুশিল্পের মধ্যে। তাই একটি জাতির যে মগ্ন চেতনা, তার যতটা নিবিষ্ট প্রতিফলন থাকে কারুকলায়, চারুকলায় তা থাকে না। তাই কারুকলাকে বলা যেতে পারে একটি জাতির লৌকিক-সত্তার দর্পণ।
আমাদের দেশ ভারতবর্ষ। আয়তনে ও বৈচিত্রে এর বিস্তার বিপুল। একশো একুশ কোটি মানুষের এই দেশে রয়েছে ১৮টি প্রধান ও ১৬০০ অপ্রধান ভাষা ও বাকরীতি, ছয়টি নৃতাত্ত্বিক ভাবে বিভাজিত প্রধান জনগোষ্ঠী, ৫২টি প্রধান উপজাতি, ৬৪০০ ধর্মীয় সামাজিক শ্রেণি ও উপশ্রেণি, ২৯টি প্রধান উৎসব। এই বিপুল জনগোষ্ঠীর ৫০ শতাংশই থাকে গ্রামে, সমুদ্রতটে, পাহাড়ি উপত্যকায়, মরুভূমি অঞ্চলে ও বনাঞ্চলে। তার মধ্যে রয়েছে বিপুল সংখ্যক কারুশিল্পী। ৩৬০টিরও বেশি ‘ক্র্যাফট-ক্লাস্টার’ বা কারুকলাচর্চা কেন্দ্র। কত বৈচিত্রময় কারুশিল্প যে উৎসারিত হয় এ সমস্ত গ্রামীণ শিল্পীর হাত দিয়ে, তার সঠিক সংখ্যা নির্ণয় করা সম্ভব নয়। এ সমস্ত শিল্পের মধ্যে প্রবাহিত থাকে আমাদের জাতিগত আত্মপরিচয়। বিভিন্ন গ্রামীণ মেলায় এর কিছু পরিচয় পাই আমরা। কিন্তু শহরের আলোকিত কোলাহলে সামান্যই পাওয়া যায় এর পরিচয়।
সিমা গ্যালারি প্রতি বছর শারদোৎসবের প্রাক্কালে আয়োজন করে থাকে ‘আর্ট ইন লাইফ’ শীর্ষক প্রদর্শনী। এ বারেও অনুষ্ঠিত হচ্ছে তা। সেখানে কারুকলার এই বৈচিত্রের কিছু পরিচয় পাই আমরা। এখানে রয়েছে বিভিন্ন প্রদেশের, বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর কারুকৃতির নমুনা। শাড়ি ও আধুনিক পোশাকের নানাবিধ সম্ভারের পাশাপাশি রয়েছে কাঠ, ব্রোঞ্জ ও অন্যান্য মাধ্যমের লৌকিক ও উপজাতীয় ভাস্কর্য, বিভিন্ন ধরনের মুখোশ, অলঙ্কার ইত্যাদি। নাগরিক কারুকৃতির দৃষ্টান্ত থাকে পোশাকের উপর করা চিত্রীয় অলঙ্করণে। এখানেই জীবনের ভিতর সঞ্চারিত হয়ে যায় শিল্পের সৌন্দর্য।
প্রতি বছরই এই প্রদর্শনীতে কোনও একটি বিশেষ প্রদেশ ও অঞ্চলের উপর জোর দেওয়া হয়। এ বারে জোর দেওয়া হয়েছে তামিলনাড়ু প্রদেশের চেট্টিনাদ জেলার উপর। চেট্টিনাদ শিবগঙ্গা জেলার অন্তর্গত। করাইকুড়ি ও দেবকোট্টাই নামে শহর ও গ্রাম নিয়ে গড়ে ওঠা চেট্টিনাদ অঞ্চলে কারুশিল্প ও বয়নশিল্পের সুদীর্ঘ ঐতিহ্য রয়েছে। সেখান থেকে সংগ্রহ করে আনা হয়েছে বস্ত্রশিল্পের বিভিন্ন সম্ভার। এখানকার তাঁতিরা তাঁদের পরম্পরাগত দ্রাবিড় অলঙ্করণ পদ্ধতিকে আধুনিকতায় অভিষিক্ত করে অত্যন্ত সমৃদ্ধ রূপসৃষ্টি করে থাকেন। তার নানা দৃষ্টান্ত এ বারের প্রদর্শনীকে সমৃদ্ধ করেছে। দক্ষিণের উপর জোর পড়লেও অন্যান্য অঞ্চলের বয়নশিল্পের সম্ভারও কিছু কম নেই। উত্তরপ্রদেশের বেনারসির পাশেই রয়েছে বাংলার বালুচরি। এর অলঙ্করণ পদ্ধতি নিবিষ্ট ভাবে লক্ষ করলে একটি জাতির পরম্পরাগত প্রজ্ঞার পরিচয় পাওয়া যায়। মুর্শিদাবাদের কাঁথার পদ্ধতিতে হাতে সেলাই করা শাড়ি ও সুজনিও এ বারের প্রদর্শনীর বিশেষ আকর্ষণ।
এই প্রদর্শনীকে সবচেয়ে বেশি আলোকিত করেছে ডোকরা পদ্ধতির ব্রোঞ্জ ভাস্কর্যগুলি। বাস্তারের পাশাপাশি বাংলার ডোকরা-পদ্ধতিতে ঢালাই করা ব্রোঞ্জগুলিও আদিবাসী রূপচেতনার প্রকাশে উজ্জ্বল। অবয়বকে দীর্ঘায়ত করে অসামান্য সারল্য নিয়ে আসা হয় রূপের বিন্যাসে। এমনই একটি ভাস্কর্যে দেখা যাচ্ছে, সামনে কুলো নিয়ে দীর্ঘায়ত এক নারী বসে আছে। কুলোর উপর শস্য রয়েছে। বাংলার এই চিরায়ত ঐতিহ্যকে আধুনিকতা আজও বিশেষ পরিবর্তিত করতে পারেনি। এ রকমই আর একটি ভাস্কর্যে দেখা যাচ্ছে অনুভূমিক ভাবে দীর্ঘায়ত একটি ষাঁড়ের উপস্থাপনা। তার উপর বসে রয়েছেন স্বয়ং শিব। দুর্গাপ্রতিমারও বিভিন্ন রূপভঙ্গির ব্রোঞ্জ রয়েছে। পরম্পরাগত প্রজ্ঞার এ রকম বৈচিত্রময় প্রকাশই এই প্রদর্শনীর প্রধান আকর্ষণ।