শিল্পী: অন্নদাপ্রসাদ বাগচি।
গভর্ণমেন্ট কলেজ অব আর্ট অ্যাণ্ড ক্রাফট – চৌরঙ্গি রোডের উপরে ইন্ডিয়ান মিউজিয়মের পাশে এই শিল্পপ্রতিষ্ঠানটি ১৫০ বছর পূর্ণ হল। এটিই ভারতের দ্বিতীয় প্রাচীনতম প্রতিষ্ঠান। ১৮৬৪ সালে এর সূচনা হয়েছিল ‘গভর্ণমেন্ট স্কুল অব আর্ট’ নামে। সেই হিসেবে ২০১৪-তে এর ১৫০ বছরের শুরু। ২০১৫ তে সেই উদযাপনের সমাপ্তি। কিন্তু এর ইতিহাস আরও দশ বছরের পুরনো। ১৮৫৪ সালে ব্যক্তিগত পরিচালনায় গরানহাটায় খুলেছিল ‘স্কুল অব ইন্ডাস্ট্রিয়াল আর্ট’। ১৮৬৪ তে ব্রিটিশ সরকার এর দায়িত্ব গ্রহণ করে। তখন এর ঠিকানা ছিল ১৬৬, বৌবাজার স্ট্রিট। যেখান থেকে চৌরঙ্গি রোডে উঠে এসেছিল এই স্কুল ফেব্রুয়ারি ১৮৯২ সালে। ১৯৫১-তে এই স্কুল কলেজে উন্নীত হয়।
এর ১৬০ বছরের ইতিহাস ভারতের আধুনিক শিল্পবিকাশের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত। কত শিল্পী-মনীষী যুক্ত থেকেছেন বা উঠে এসেছেন এই প্রতিষ্ঠান থেকে। অ্যাকাডেমিক স্বাভাবিকতাবাদের সূচনা যেমন এখান থেকে, তেমনি নব্য-ভারতীয় ঘরানারও পৃষ্ঠপোষকতা এসেছে এই প্রতিষ্ঠান থেকেই। শুধু বাংলার নয়, সমস্ত ভারতেরই শিল্পকলার আধুনিকতাবিকাশের প্রাণকেন্দ্র ছিল এই প্রতিষ্ঠান। আজ অবশ্য সেই গৌরব অনেকটাই অস্তমিত। সারা দেশে অনেক নতুন শিল্প-প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, বিশ্বায়িত আধুনিকতাবাদের বিকাশে যাদের রয়েছে অগ্রণী ভূমিকা। এই আর্ট কলেজের পরিকাঠামো ক্রমশ বিপন্ন হয়েছে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতাও আজ অত্যন্ত দীন।
তবু ইতিহাস তো মুছে যায় না। সেই ১৫০ বা ১৬০ বছরের গৌরবের ইতিহাসকে স্মরণে রেখেই সম্প্রতি আর্ট কলেজ ও অ্যাকাডেমিতে অনুষ্ঠিত হয়েছে প্রদর্শনী ও আলোচনাচক্র। প্রদর্শনীর যে অংশটি ছিল আর্ট কলেজে সেটি অত্যন্ত সমৃদ্ধ। সূচনা থেকে ১৯৪০-এর দশকের পর্যন্ত প্রবাদপ্রতিম শিল্পীদের কাজ ছিল সেখানে। স্বাভাবিকতাবাদী ও নব্যভারতীয় ধারা কী ভাবে বিকশিত হয়েছে তার কিছু আভাস পাওয়া যায় আর্ট কলেজের প্রদর্শনী থেকে। অ্যাকাডেমির সব কটি গ্যালারি জুড়ে যে প্রদর্শনী সেখানে ছিল মূলতঃ ১৯৪০-এর পর থেকে সম্প্রতি পর্যন্ত আর্ট কলেজে প্রশিক্ষিত শিল্পীদের চিত্র ও ভাস্কর্যের সম্ভার। ১৯৬০-এর দশকের অনেক শিল্পীর কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল সেখানে। এছাড়া বাকি অংশে ছিল অবাঞ্ছিত ভিড়। উপযুক্ত পরিকল্পনার অভাবে ম্রিয়মান ছিল তরুণতর প্রজন্মের কাজের সম্ভার।
আর্ট কলেজের প্রদর্শনীতে ডবল্যু এইচ জবিনস-এর একটি কাজ দেখে মুগ্ধ হই আমরা। জবিনস এই প্রতিষ্ঠানের সুপারিনটেনডেন্ট হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন ১৮৮৭-র ১০ জুন। গিলার্ডি-র কাছ থেকে তিনি দায়িত্বভার গ্রহণ করেছিলেন। জবিনস-এর কাজটি দেখলে বোঝা যায় ইউরোপের নব্য-ধ্রুপদী স্বাভাবিকতাবাদ কেমন করে চর্চিত হচ্ছিল ব্রিটিশ শিল্পীদের হাতে এবং এদেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে তা কী ভাবে প্রভাবিত করেছে। বিদেশ থেকে আসা শিল্পীদের হাতে কলকাতার নিসর্গের ছবিও ছিল কিছু। আর্ট স্কুলের প্রথম পর্বের শিক্ষার্থীদের মধ্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ শিল্পী ছিলেন অন্নদাপ্রসাদ বাগচি। তাঁর একটি ছবি এসেছে কেজরিওয়াল সংগ্রহ থেকে। স্বাভাবিকতাবাদী সেই ছবিটিতে দেখা যাচ্ছে ধুতি পরা এক যুবক একটি মেয়েকে পুঁথি পড়তে সাহায্য করছে। সেই সময়ের নারীশিক্ষার আলেখ্য হিসেবে ছবিটি মনে রাখার মতো। রণদাপ্রসাদ গুপ্তের একটি ছবি, পিছন থেকে আঁকা দণ্ডায়মান এক নগ্ন পুরুষ বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
১৮৯৭-এর পর থেকে আর্ট স্কুলে স্বাভাবিকতাবাদী চিত্ররীতি ও ঐতিহ্যগত ভারতীয় চিত্ররীতির অনুশীলন পাশাপাশি চলতে থাকে। অবনীন্দ্রনাথ আর্ট স্কুলে উপাধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দেন ১৯০৫ সালে। এই দুই ধারার নানা শিল্পরূপে সমৃদ্ধ এই প্রদর্শনী। সতীশ সিংহ বা ললিত মোহন সেনের ছবি যেমন আমরা দেখি এখানে, তেমনি দেখি সত্যেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, সুধীর রঞ্জন খাস্তগির, কামরুল হাসান, রাধাচরণ বাগচি বা জয়নুল আবেদিনের কাজ। স্বাভাবিকতাবাদ ও নব্যভারতীয় ধারা পাশাপাশি চলতে চলতে ১৯৪০-এর দশকে এই দুইয়ের সমন্বয়ের মধ্যে উন্মীলিত হল আধুনিকতাবাদ।