চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১

এক বাউলের উপস্থাপনায় ফুটে ওঠে শিল্পীর দক্ষতা

সম্প্রতি ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে অসিত কুমার হালদারের প্রদর্শনী দেখে এলেন মৃণাল ঘোষনব্য-ভারতীয় ঘরানার প্রখ্যাত শিল্পী অসিত কুমার হালদার-এর ছবির প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হল সম্প্রতি ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল ও ইলাহাবাদ মিউজিয়মের যৌথ উদ্যোগে। প্রদর্শনীটি কিউরেট করেছেন ইলাহাবাদ মিউজিয়মের ডিরেক্টর রাজেশ পুরোহিত। প্রদর্শিত ৫৫টি ছবি ইলাহাবাদ মিউজিয়মের সংগ্রহের অন্তর্গত। সেখানে এই শিল্পীর প্রায় ২০০টি কাজ রয়েছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ৩০ অগস্ট ২০১৪ ০০:০১

নব্য-ভারতীয় ঘরানার প্রখ্যাত শিল্পী অসিত কুমার হালদার-এর ছবির প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হল সম্প্রতি ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল ও ইলাহাবাদ মিউজিয়মের যৌথ উদ্যোগে। প্রদর্শনীটি কিউরেট করেছেন ইলাহাবাদ মিউজিয়মের ডিরেক্টর রাজেশ পুরোহিত। প্রদর্শিত ৫৫টি ছবি ইলাহাবাদ মিউজিয়মের সংগ্রহের অন্তর্গত। সেখানে এই শিল্পীর প্রায় ২০০টি কাজ রয়েছে।

নব্য-ভারতীয় ঘরানার শিল্পীদের ধারাবাহিকতায় অবনীন্দ্রনাথকে যদি প্রথম পথিকৃৎ ধরা যায়, তাহলে কলকাতার গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুলে তাঁর প্রথম পর্যায়ের ছাত্রদের মধ্যে নন্দলাল বসু, অসিত কুমার হালদার প্রমুখ শিল্পীকে বলা যেতে পারে এই ঘরানার দ্বিতীয় প্রজন্মের শিল্পী। তাঁরাই ভারতীয় আঙ্গিকের চিত্ররীতিকে সারা দেশে এবং বহির্বিশ্বেও প্রসারিত করেন। দীর্ঘ দিন কলকাতায় তাঁর ছবির উল্লেখযোগ্য কোনও প্রদর্শনী হয়নি। সেদিক থেকে আলোচ্য প্রদর্শনীটি গুরুত্বপূর্ণ।

Advertisement

অসিত কুমার রবীন্দ্রনাথের নিকটাত্মীয় ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের দিদি শরৎকুমারী দেবীর কন্যা সুপ্রভা দেবীর পুত্র তিনি। কলকাতার সরকারি আর্ট স্কুলে তিনি ছাত্র ছিলেন ১৯০৬ থেকে ১৯২২। অবনীন্দ্রনাথ তখন উপাধ্যক্ষ। ছাত্রাবস্থাতেই তিনি লেডি হেরিংহ্যামের নেতৃত্বে অজন্তার ছবির অনুলিপির কাজে যুক্ত হন। সঙ্গে ছিলেন নন্দলাল বসু, সমরেন্দ্রনাথ গুপ্ত, কে বেঙ্কটাপ্পা প্রমুখ শিল্পী। অজন্তার প্রভাব তাঁর কাজে দীর্ঘ দিন পরিলক্ষিত হয়েছে। শান্তিনিকেতনের ব্রহ্মচর্যাশ্রমে তিনি ছবি আঁকা শেখান ১৯১৩ থেকে ১৯১৫। ১৯১৯ সালে কলাভবন প্রতিষ্ঠার পর শুরু থেকে ১৯২২ পর্যন্ত তিনিই ছিলেন কলাভবনের অধ্যক্ষ। তাঁর পর নন্দলাল কলাভবনের দায়িত্ব নেন। ১৯২৩-এ ইংল্যান্ড থেকে ঘুরে এসে তিনি জয়পুরের মহারাজার আর্ট স্কুলে অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। ১৯২৫-এ লখনউ আর্ট স্কুলে অধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দেন। নব্য-ভারতীয় ঘরানার আঙ্গিক ও ভাবধারা বাংলার বাইরে প্রসারে তাঁর বিশেষ অবদান রয়েছে।

এই প্রদর্শনীতে তাঁর যে ছবি আমরা দেখেছি তাকে চারটি পর্যায়ে ভাগ করা যায়। প্রথম পর্যায়ে আসে জলরঙে আঁকা অজন্তা প্রভাবিত কাজ। দ্বিতীয় পর্যায়ের অন্তর্গত করা যায় পেনসিল ও জলরঙের সামান্য ছোঁয়ায় আঁকা ছোট ছোট মুখাবয়বচিত্র। তাঁর লেখা কবিতার কিছু নিদর্শন রয়েছে তাঁর নিজের হস্তাক্ষরে। সেই সঙ্গে রয়েছে হাল্কা ছায়াতপে আঁকা নিসর্গধর্মী ছবি। এগুলিকে তৃতীয় পর্যায়ে আনা যেতে পারে। চতুর্থ পর্যায়ের রচনায় তিনি স্বাভাবিক রূপরীতি ভেঙে একটু নিরবয়ব রূপরীতি তৈরির চেষ্টা করেছেন।

প্রদর্শনীর উপস্থাপনায় কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। ছবির রচনাকাল নির্দেশিত হয়নি। সম্ভবত শিল্পী অনেক ছবিতেই কোনও তারিখ দেননি। এ রকম গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রদর্শনীতে একটি তথ্যপূর্ণ স্মারকগ্রন্থ তৈরি করা বাঞ্ছনীয়। তাতে তথ্য-পঞ্জীকরণের সুবিধা হয়। একটি ছোট ফোল্ডার অবশ্য তৈরি হয়েছে। তাতেও ছবির দৈর্ঘ্য-প্রস্থের পরিমাপ নেই।

অজন্তার আঙ্গিক ও বর্ণপ্রয়োগ রীতিকে শিল্পী খুব দক্ষতার সঙ্গে আয়ত্ত করেছিলেন। ‘বাসবদত্তা’ এই আঙ্গিকেরই পুরাণকল্পভিত্তিক একটি ছবি। ‘চন্দ্রগুপ্তের সঙ্গে মেগাস্থিনিসের সাক্ষাৎ’ বিষয়ক ছবিটিতে ইতিহাসকে পুরাণকল্পের আদলে উপস্থাপিত করা হয়েছে। নন্দলালের মতো কোনও নব্যভারতীয় ঘরানার শিল্পী পুনরুজ্জীবনবাদী ধ্রুপদী আঙ্গিককে এক সময় অতিক্রম করে গিয়েছিলেন। অসিত কুমারের ছবিতে সে রকম উত্তরণের অভাব। চতুর্থ পর্যায়ের ছবিগুলি এই উত্তরণ-প্রয়াসের দৃষ্টান্ত। এখানে নব্য-ভারতীয় রূপরীতির প্রচলিত পথকে উত্তীর্ণ হয়ে যাওয়ার প্রয়াস রয়েছে।

ছোট ছোট পোর্ট্রেট স্কেচগুলিতে শিল্পীর দক্ষতা ও মননের পরিচয় পাওয়া যায়। শিল্পীর আত্মপ্রতিকৃতি, নন্দলাল বোস, ক্ষিতীন্দ্রনাথ মজুমদার, হীরাচাঁদ দুগার প্রমুখ শিল্পী ও অন্যান্য অনেক মানুষের ছোট প্রতিকৃতিগুলি খুবই উপভোগ্য। তাঁর কবিতার সঙ্গে আঁকা ছবিতে শিল্পীর পরিমিতিবোধ ও বিভিন্ন ধরনের আঙ্গিক নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরিচয় রয়েছে। একটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা যায়। একটি কবিতার প্রথম কয়েকটি লাইন এরকম:
কে যে গো খেয়ালখোলা
এল যে আপনভোলা
গোপনে খেয়ালিয়া...
’।
সঙ্গে উপরের প্রান্তে আঁকা ছবিতে নিসর্গের ভিতর একতারা হাতে এক বাউলের উপস্থাপনা।

আরও পড়ুন
Advertisement