চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১

এ যেন পূর্ণ মগ্নতায় নিজের সঙ্গেই কথা বলা

সিমা গ্যালারিতে চলছে গণেশ পাইনের প্রদর্শনী। লিখছেন মৃণাল ঘোষ গণেশ পাইনের (১৯৩৭-২০১৩) ছবির প্রধান বৈশিষ্ট্য অন্তর্মুখীনতা। এই অন্তর্মুখীনতার ভিতর দিয়েই তিনি পুরাণকল্পের অতীতের সঙ্গে বর্তমানের বাস্তবতার সংযোগ সাধন করেছেন। অতীত দিয়ে বর্তমানকে বিশ্লেষণ করেছেন।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০১ নভেম্বর ২০১৪ ০০:০১

গণেশ পাইনের (১৯৩৭-২০১৩) ছবির প্রধান বৈশিষ্ট্য অন্তর্মুখীনতা। এই অন্তর্মুখীনতার ভিতর দিয়েই তিনি পুরাণকল্পের অতীতের সঙ্গে বর্তমানের বাস্তবতার সংযোগ সাধন করেছেন। অতীত দিয়ে বর্তমানকে বিশ্লেষণ করেছেন। আর বিশ্লেষণের প্রক্রিয়ায় যে ‘রূপ’ নির্মাণ করেছেন তাতে দেশজ ঐতিহ্যের সঙ্গে বিশ্বগত আধুনিকতার সংশ্লেষ ঘটেছে। গড়ে উঠেছে ১৯৬০-এর দশক-পরবর্তী আমাদের আধুনিকতাবাদী চিত্রকলার স্বতন্ত্র আত্মপরিচয়। এই অন্তর্মুখীনতা তাঁর নিজেরই মনস্তাত্ত্বিক একটি বৈশিষ্ট্য। পারিবারিক পরিবেশ ও শৈশব থেকে বড় হওয়ার প্রক্রিয়ায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে চর্চিত হয়েছে এই মগ্নতা। তাঁর ব্যক্তিত্বের ও বিশ্বদৃষ্টির আর একটি বৈশিষ্ট্য প্রগাঢ় দেশাত্মবোধ। ১৯৪০-এর দশকের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত তাঁর শৈশব ও কৈশোর, স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত মনীষীদের স্বদেশভাবনা তাঁকে প্রভাবিত ও অনুপ্রাণিত করেছে। তার পর ১৯৫০ ও ৬০-এর দশকের বাস্তবতা তাঁর মধ্যে জাগিয়েছে প্রতিবাদী চেতনা। অন্তর্মুখীনতা, দেশাত্মবোধ ও প্রতিবাদী চেতনা— এই তিনটি মাত্রাকে মিলিয়ে তিনি যখন নিজস্ব রূপ অন্বেষণ করেছেন, তখন সেই উত্‌সগুলিই তাঁকে আকৃষ্ট করেছে, যেখানে কোনও না কোনও ভাবে এই তিনটি বৈশিষ্ট্যের স্পন্দন তিনি অনুভব করেছেন। এ জন্যই পর্যায়ক্রমে অবনীন্দ্রনাথ, রেমব্রান্ট, পল ক্লি ও রবীন্দ্রনাথ তাঁকে আকৃষ্ট করেছে। তাঁদের আত্মস্থ করে তিনি অতিক্রম করে গেছেন। তাঁর নির্মাণের এই বৈশিষ্ট্য সংহত হয়ে আছে তাঁর ড্রয়িং-এ। যাকে তিনি ‘জটিংস’ বলতে পছন্দ করতেন।

Advertisement

গণেশ পাইনের ‘জটিংস’ নিয়ে এখন প্রদর্শনী চলছে সিমা গ্যালারিতে। তাঁর আত্মমগ্নতার, তাঁর বিশ্বদৃষ্টি নিরূপণের গর্ভগৃহ তাঁর এই জটিংস। কেবল লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি, মিকেলেঞ্জেলো বা রেমব্রান্টের স্কেচবুকেই যে তাঁদের অন্তর্লোকের হদিশ লুকোনো ছিল, তা নয়। পৃথিবীর সব শিল্পীই রেখা নিয়ে নিবিড় অনুশীলন করে থাকেন। এর মধ্যে কেউ কেউ আছেন যাঁরা ব্যক্তিগত মনটিকে সম্পূর্ণভাবে মেলে দেন তাঁদের স্কেচখাতায় বা জটিংস-এ। গণেশ পাইনের জটিংস-এর বৈশিষ্ট্য এটাই যে এখানে তিনি পূর্ণ মগ্নতায় নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলতেন।

এ জন্য জীবনকালে তিনি চাইতেন না, এগুলি জনসমক্ষে প্রকাশিত হোক। অথচ ১৯৮৭-এ কলকাতার একটি গ্যালারিতে তাঁর গ্রন্থচিত্রণের ছবির প্রদর্শনীর পর তাঁর দ্বিতীয় পূর্ণাঙ্গ একক প্রদর্শনী হয়েছিল দিল্লির দ্য ভিলেজ গ্যালারিতে। সেটা ছিল এই জটিংস-এরই প্রদর্শনী। প্রথমে সেই প্রদর্শনীতে তিনি সম্মতি দিতে চাননি। বিদেশে বড় শিল্পীদের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক হলেও আমাদের দেশে এ রকম ব্যক্তিগত কাজের প্রদর্শনী কতটা যুক্তিযুক্ত, সে বিষয়ে খানিকতা সংকুচিতই ছিলেন তিনি। তবু সেই প্রদর্শনী হয়েছিল এবং দর্শক মহলে ও সংবাদ মাধ্যমে প্রবল সাড়া জাগিয়েছিল।

তার পরে বিভিন্ন জায়গায় তাঁর জটিংস অনেক বারই দেখানো হয়েছে। তবে শিল্পীর প্রয়াণের পর সিমা-র উদ্যোগে আয়োজিত খানিকটা পূর্বাপর চরিত্রের এই প্রদর্শনীটি শিল্পীর অন্তর্লোকের বহু স্তরবিশিষ্ট আলো-আঁধারিকে উন্মীলিত করতে অনেকটাই সাহায্য করে। গণেশ পাইন আর্ট কলেজের ছাত্রজীবন থেকে বা তারও আগে থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিয়মিত স্কেচ করতেন। তাঁর ১৯৫৫ থেকে ১৯৫৮-৫৯ পর্যন্ত করা কলকাতার জনজীবনের স্কেচ, ১৯৬০-এর কাশ্মীর স্কেচ, ১৯৬১-র কোনারকের নিসর্গ বা সূর্যমূর্তির ভিতর তাঁর আদিপর্বের ড্রয়িং-এর যে ধরন, তাতেও অন্তর্মুখীনতা ও আলো-আঁধারির বৈশিষ্ট্যগুলির প্রাথমিক পদপাত লক্ষ করা যায়। এটাই ক্রমে পরিশীলিত হয়ে ১৯৭০-এর দশক থেকে তাঁর জটিংস নিজস্ব এক বৈশিষ্ট্য অর্জন করে, সেখানে চিত্রপ্রতিমা ও লিখনশৈলী বা অক্ষর বিন্যাস মিলে ব্যতিক্রমী এক নান্দনিক পরিমণ্ডল গড়ে ওঠে। এই স্বকীয় শৈলীটি একান্তই তাঁর নিজস্ব। ছোট ছোট বর্গাকার খোপ পরিবৃত গ্রাফ-পেপারে তিনি স্কেচ করতে ভালবাসতেন। চিত্রপ্রতিমার পাশাপাশি নানা মনীষীর উক্তি উদ্ধৃত করতেন এবং ব্যক্তিগত নানা প্রসঙ্গও লিপিবদ্ধ করে রাখতেন। যার সঙ্গে সংলগ্ন চিত্রপ্রতিমার কোনও প্রত্যক্ষ সম্পর্ক নেই। কিন্তু চিত্রপ্রতিমা ও অক্ষরবিন্যাস সবটা মিলে ওই পৃষ্ঠাটি বিশেষ এক চিত্রীয় তাত্‌পর্যে উন্নীত হয়ে যায়। এই প্রদর্শনীতে মহাভারত-চিত্রের জটিংস-এর সঙ্গে রয়েছে পূর্ববর্তী বহু স্কেচও। আর রয়েছে দশটিরও বেশি পূর্ণাঙ্গ চিত্র— টেম্পারা ও অন্য মাধ্যমের।

আরও পড়ুন
Advertisement