প্রচলিতের সীমা ভেঙে

বাঙালির ব্যর্থ প্রেমকে রাম-সীতাই সফল করতে পারেন। প্রথমে ওঁদের যুগল মূর্তি ধ্যান করতে হবে। তার পর একটি সাদা ফুলের গন্ধ নিতে নিতে প্রেমিক বা প্রেমিকার নাম ও গোত্র বলতে হবে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৯ জুন ২০১৯ ০০:০১

Advertisement

ভালো বাঙালির কালো বই/ অথবা একুশ শতকের বঙ্গ সমাজ কৃষ্ণপ্রিয় দাশগুপ্ত ৫০০.০০ ধানসিড়ি

বাঙালির ব্যর্থ প্রেমকে রাম-সীতাই সফল করতে পারেন। প্রথমে ওঁদের যুগল মূর্তি ধ্যান করতে হবে। তার পর একটি সাদা ফুলের গন্ধ নিতে নিতে প্রেমিক বা প্রেমিকার নাম ও গোত্র বলতে হবে। এই ভাবে সাত দিন করুন, ফল অবধারিত। স্বামীকে বশীভূত করতে গো-চনা জরুরি। শনি বা মঙ্গলবার গো-চনা, কুমকুম ও কলার রস একত্র মিশিয়ে কপালে তিলক ধারণ করলে স্বামী তৎক্ষণাৎ স্ত্রীর বশংবদ হবেন। এই বিজ্ঞাপন গত বছরেই বাংলার এক জ্যোতিষ-পত্রিকায় বেরিয়েছিল। দলবদল কি আর শুধু আজকের ব্যাপার? প্রভাস রায় ও তাঁর কয়েক জন বন্ধু ঠিক করেছেন, কংগ্রেসে আর নয়। কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেবেন। তাঁদের রাজনৈতিক গুরু বিপিনবিহারী গঙ্গোপাধ্যায় প্রায় কেঁদে ফেললেন, ‘‘ওরে, তোরা যদি যাওয়াই স্থির করলি, আমাকে সঙ্গে নিয়ে গেলি না কেন?’’ কৃষ্ণপ্রিয় দাশগুপ্তের এই বইয়ের মজা এইখানেই। তিনি কোনও ধারাবিবরণী বা বিশ্লেষণী তত্ত্বে ঢোকেননি, কিন্তু মূল ধারার বিখ্যাত সংবাদপত্রগুলিতে ছাপা খবর (তাদের ‘দ্বিচারিতা’র দিকেও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন), পাত্র-পাত্রীর বিজ্ঞাপন থেকে ‘দুষ্টুমিষ্টি বোল্ড রিলেশন’, হাল আমলের জ্যোতিষ-পত্রিকা, বটতলা, বশীকরণ, ওঝা, ডাকিনি ও গুণিন বিদ্যার বই থেকে অশোক মিত্র, অসীম চট্টোপাধ্যায়ের নিবন্ধ সব পাশাপাশি সাজিয়ে দিয়েছেন। আর সেটাই নিঃশব্দে ধরে দিয়েছে আধুনিক বাঙালির জীবন। একুশ শতকের বাঙালির বেঁচে থাকার হদিশ। এ কালের ঘটনাবলি ও নানান চরিত্রকে নিয়ে এক সামাজিক দলিল। অবশ্যই ‘গোটা ছবিটা’ নয়, ‘তবে অনেকটাই ধরা যাবে’। কৃষ্ণপ্রিয় দেখান, এই সমাজে ‘পাত্র চাই, পাত্রী চাই’-এর পাশাপাশি আরও একটি জিনিসের বিজ্ঞাপন ক্রমবর্ধমান। প্রাইভেট গোয়েন্দা সংস্থা, বিবাহের আগে ও পরে তথ্যানুসন্ধান। পড়তে পড়তে বোঝা গেল, পাবলিক ইউরিনাল ও ট্রেনের কামরায় হলুদ কাগজে সাঁটা ‘গুপ্তরোগ, সিফিলিস’ চিকিৎসার দিন গিয়েছে। এখন বাজারে জাঁকিয়ে বসেছে অজস্র মাসাজ জেল। পণের জন্য বধূহত্যার খবরের পাশাপাশি উঠে আসে দিঘায় পরকীয়ারত যুগলের আত্মহত্যা। রামমোহন-বিদ্যাসাগর-রবীন্দ্রনাথই তো বাঙালির একমাত্র পরিচয় নয়। পড়তে পড়তে মনের গভীরে নীরদচন্দ্র চৌধুরীর ‘বাঙালি জীবনে রমণী’ ঝিলিক মারে। বাঙালি তো শুধু আজই রিপুতাড়িত নয়। বিভিন্ন অবৈধ সম্পর্ক নিয়ে এখানে শাশুড়ে, ভাশুড়ে ইত্যাদি কত শব্দই যে সে বইয়ে ফাঁস করে দিয়েছিলেন নীরদবাবু! কমিউনিস্ট আন্দোলন দিয়েও এই নৃগোষ্ঠীকে বোঝানো যায় না। এই জনসংস্কৃতিতে দুটো সুতো পাশাপাশিই থাকে। ১৯৭৭ সালে বামফ্রন্টের আগমনের পাশাপাশি সমান তালে সাড়া জাগায় ‘বাবা তারকনাথ’ সিনেমা। সাড়ে তিনশো পৃষ্ঠার বইটি পড়তে পড়তে তাই হাসি-রাগ-দুঃখ-লজ্জা সব এক সঙ্গে পাঠককে আশ্রয় করে। কিন্তু সে সব অনুভূতিমালা নিরর্থক। ভূমিকার অন্তিমে লেখকের বি.দ্র. ‘‘কাউকে কোনও রকম আঘাত দিতে বা অসম্মান করতে এই বই, কোনও ধরনের চেষ্টা করেনি। কেবল ‘সরল বিশ্বাসে’ বহু উদ্ধৃতির একটা সংকলন করেছে মাত্র।’’

মেয়েদের চোরাগোপ্তা স্ল্যাং/ শরীর এবং অন্যান্য আলাপ তৃপ্তি সান্ত্রা ৪৫০.০০ কারিগর

‘‘আমাদের জীবনের শিক্ষিত শোভন সংস্করণে স্ল্যাংয়ের কোনও পাঠ না থাকলেও আমরা জানি এর চোরাগোপ্তা স্রোত আছে। কোনও কোনও দাম্পত্যের নিরীহ শোভন সংস্করণে স্ল্যাং তো একটি নিত্য-ব্যবহার্য আসবাব। আমাদের জীবনে যুগপৎ যৌনতা আছে এবং একটা ধরি-মাছ-না-ছুঁই-পানি গোছের ন্যাকান্যাকা ভাবও আছে।’’ এই বইটি স্ল্যাং-এর অভিধান নয়, তেমন বই এর আগেই লেখা হয়েছে। একে বলা চলে ভাষায় স্ল্যাং ব্যবহারের একটি নিবিড় অনুসন্ধান। এই স্ল্যাং কখনও রহস্যময় পরিভাষা, কখনও আদিরসাত্মক উল্লাস-কৌতুক, কখনও স্রেফ খিস্তি। কাদের মধ্যে, কোন পরিবেশে, কী প্রসঙ্গে ভাষার ভিতরে আর এক ভাষা গড়ে ওঠে, যা অজানা থাকলে জনজীবনের অনেকটা অধরা রয়ে যায়। লেখক তৃপ্তি সান্ত্রা যথার্থই বলছেন, স্ল্যাং-এর সবটাই অশ্লীল নয়, কোথাও গ্রামের মেয়েরা কোনও বিয়ের আগে-পরে যে গান গায় তাতে যৌনাঙ্গের, যৌনমিলনের উল্লেখ থাকলেও তা পর্নোগ্রাফি নয়, ‘খণ্ড জীবনাচরণের উল্লাস’। অন্যত্র বলছেন, স্ল্যাং, অপভাষা, ইতর ভাষা, এদেরকে অনাচারিক ভাষা বা ইনফর্মাল স্পিচ বলা যায়। অপরাধ জগতের ভাষা, হিজড়ে বা বেশ্যাপাড়ার ভাষা তার নিদর্শন। চর্যাপদের সঙ্কেত বা সান্ধ্যভাষাও স্থান পেয়েছে এই আলোচনায়, যেখানে প্রচলিত শব্দের গূঢ় অর্থ তৈরি করেছেন চর্যাগীতির কবিরা।
এই বইটি নানা সময়ে লেখা প্রবন্ধের সঙ্কলন, যার অনেকগুলির বিষয় নারীর যৌনজীবন, যা নিয়ে কেউ কেউ মুখের কথায় তুফান ছোটালেও লেখালিখিতে তার প্রতিফলন হয় সামান্যই। রয়েছে এমন লেখাও, যা ঠিক ভাষার বিশ্লেষণ নয়, সমাজে মেয়েদের অবদমনের রকমফের নিয়ে কলামধর্মী লেখা। তার অনেকগুলি বেশ প্রচলিত আলোচনার সীমাভাঙা লেখা, মেয়েদের অতৃপ্ত যৌনবাসনা, স্বমেহন, সমকামিতা, ঋতুস্রাব-আশ্রয়ী যৌনতা নিয়ে। সঙ্গমে ছেলেদের অসামর্থ্য একটি ‘নিষিদ্ধ’ বিষয়, তাই মেয়েদের সাঙ্কেতিক ভাষায় তা নিয়ে কৌতুক-জড়ানো আক্ষেপ। শেষে রয়েছে বেশ কিছু সাক্ষাৎকার: মেয়েদের যৌনতা, নারীত্বের ধারণা নিয়ে নানা বয়সের নারীদের সঙ্গে।

আরও পড়ুন
Advertisement