ত্রয়ী: শিশিরকুমার ভাদুড়ি, শম্ভু মিত্র ও উৎপল দত্ত।
থিয়েটার কিংবা শিল্প বিষয়ক বক্তৃতা সংবাদে শ্রোতার উপস্থিতির সংশয় থাকলেও, বক্তা শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম প্রচারিত হলে ভারতের একাধিক শহরে ঘটবে ব্যতিক্রমী উদাহরণ। আবার এই সর্বভারতীয় শ্রোতৃবৃন্দের অভিযোগ শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত প্রবন্ধ-গ্রন্থ সংখ্যা দীন-শীর্ণতার জন্য। এই খরার মধ্যে সম্প্রতি বাংলায় প্রকাশিত হয়েছে শমীকবাবুর দু’টি উজ্জ্বল গ্রন্থ। ‘সায়ক’ নাট্যসংস্থা আয়োজিত ধারাবাহিক বক্তৃতামালার সঙ্কলন থিয়েটারের আকাশে নক্ষত্রমালা। সঙ্কলনটি ইতিপূর্বে প্রকাশিত হলেও, এই নবপ্রকাশনাকে পাঠক অবশ্যই বেশি গুরুত্ব দেবেন। লেখক মুখবন্ধে জানিয়েছেন, “পরিবর্ধিত নতুন সংস্করণ প্রকাশকালে সম্পাদনা ও প্রুফ দেখবার সুযোগ দিয়ে লালমাটি (প্রকাশক) আমাকে বাধিত করেছেন।” আরও লিখেছেন, “প্রথম অংশের রচনাগুলি বক্তৃতার অনুলিখিত পাঠ; দ্বিতীয় অংশে নিবন্ধ আকারে রচিত বয়ান।” প্রথম অংশে বাংলা থিয়েটারের ছয় ‘নক্ষত্র’-র নাট্যপ্রাসঙ্গিক আলোচনা। দ্বিতীয় অংশে ‘ভারতীয় থিয়েটারের কিছু চেনামানুষ’। বাদল সরকার-সহ ইব্রাহিম আলকাজ়ি, সত্যদেব দুবে, গোবিন্দ পুরুষোত্তম দেশপান্ডে আর হেইসনাম কানহাইলাল প্ৰসঙ্গ।
থিয়েটারের আকাশে নক্ষত্রমালা
শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়
৪০০.০০
লালমাটি
শিশিরকুমার আলোচনায় লেখক তাঁর নবীন যৌবনে লেখা ডায়েরির পৃষ্ঠা থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন। প্রথম লেখা ৩ অক্টোবর ১৯৫৮। প্রান্তিক পৃষ্ঠা ১৬ মে ১৯৫৯, শিশিরকুমারের শেষ অভিনয় দেখার স্মৃতিলিখন। আলোচনা করেছেন শিশিরকুমারের অভিনয় ও নাট্যের সমকালীনতা আবর্তিক পরিসরে। বিশ্লেষণ করেছেন বিজন ভট্টাচার্য, শম্ভু মিত্র, তৃপ্তি মিত্র, উৎপল দত্ত আর অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাট্যকৃতির। এই পাঁচ নক্ষত্রের সঙ্গে ছিল তাঁর প্রতিদৈনিক শৈল্পিক বন্ধুত্ব। ভারতীয় থিয়েটারে তাঁর সংলগ্নতা আজ ঐশ্বর্যলালিত সম্পদে সম্মানিত। বাংলায় সর্বভারতীয় নাট্যব্যক্তিত্বজনের যথার্থ মর্যাদায় পরিচিতিলিখন প্রায় নেই। অনেকে ‘প্রায়’ শব্দটিও রাখতে চাইবেন না হয়তো। আলকাজ়ি, যাঁকে স্বাধীনতা-উত্তর ভারতীয় থিয়েটারের অন্যতম আধুনিক নির্মাণকের গৌরবে অভিষিক্ত করা হয়েছে, মহারাষ্ট্রের সত্যদেব দুবে, গোবিন্দ পুরুষোত্তম দেশপান্ডে, মণিপুরের তথা ভারতীয় থিয়েটারের আধুনিকতার সঙ্গে লোকজীবন-সম্পৃক্ত সংস্কৃতি স্রষ্টা কানহাইলাল প্রসঙ্গ এই লিখন বর্ণনায়, চর্চা শ্রম আর মননের সৃজন পরিচিতি এত গভীরতায় বাংলার পাঠক আগে পাননি। পাঠক ‘শম্ভু মিত্র’ বিশ্লেষণে কৌতূহল বোধ করবেন। বক্তৃতার দীর্ঘ অংশ জুড়ে আছে শম্ভু মিত্রের নানান ব্যর্থতার প্রসঙ্গ। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নিবিড় পাঠে অবশ্য বিপরীত উদাহরণ পাবেন।
নতুন থিয়েটারের ইতিহাস লেখা হবে না?
শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়
১৫০.০০
পরম্পরা
২৭২ পৃষ্ঠার বইটি উৎসর্গ করেছেন বন্ধু ‘কেয়া চক্রবর্তীর স্মৃতিতে’। এই বন্ধুর মুখে শুনতে হয়েছিল ‘দুষ্পাঠ্য’ লেখার অভিযোগ। সেখান থেকেই বক্তৃতার চর্চা। রহস্য করে শমীকবাবু নিজেকে ‘বই মিস্ত্রি’ বলতে ভালবাসেন। বাংলা প্রকাশনায় থিয়েটারের আকাশে নক্ষত্রমালা-র প্রতিটি পৃষ্ঠার যত্নবিন্যাস, সম্পদ শুধু নয়, অনুকরণীয় উদাহরণ। বড় আশা বইটির ইংরেজি অনুবাদ হলে বাংলা আর ভারতের থিয়েটার সমৃদ্ধ হবে।
২০০৮ সালে শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্পূর্ণ একটি নতুন বিভাগ ‘স্কুল অব আর্টস অ্যান্ড ইসথেটিক্স’-এর অন্যতম প্রধান প্রকল্পক আর অধ্যাপনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। “এই দুই দশকে আমার থিয়েটার দেখা এবং জানার অভিজ্ঞতাটা একটা অন্য পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে। একটা খুব বড়সড় পরিবর্তন পরিবর্ধন ঘটেছে।” নতুন থিয়েটারের ইতিহাস লেখা হবে না?-র প্রথম পৃষ্ঠায় এই ক’টি পঙ্ক্তি পাঠে পাঠক অতি দ্রুত বইটির মধ্যে প্রবেশ করতে চাইবেন। বইটি গ্রন্থিত হয়েছে একটি ‘আলাপচারিতার’ লিখন গড়নে। আলোচনায় শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে ছিলেন রাজীব চক্রবর্তী, ভবেশ দাশ। ৭৯ পৃষ্ঠার হাফ-ক্রাউন সাইজ়ের ছোট্ট বইটি তাঁদেরই দায়িত্বে গ্রন্থিত।
সুন্দর প্রচ্ছদের মোড়কে পৃষ্ঠায় ছড়িয়ে আছে বাংলা থিয়েটার সংযোগে ভারত আর বিশ্বথিয়েটারের বর্তমান অভিঘাতের একাধিক প্রশ্ন, ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ। ‘আলাপচারিতার’ প্রশ্নগুলি ‘পাঠকের পাঠের অন্তরায়’ না হওয়ার জন্য অবলুপ্ত! মাত্র ৬৯ পৃষ্ঠায় বাংলা থিয়েটারের দীর্ঘ ইতিহাসের শরীরকে নিপুণ সৃজনিক দক্ষতায় ময়নাতদন্ত করেছেন বর্তমান সময়ের অসম্পূর্ণ-বিস্তারের রোগচিন্থে। “খুব দুঃখের হলেও, একটা কথা স্বীকার করে নেওয়া ভালো যে থিয়েটারের এই বিশ্বজনীনতার সঙ্গে আমাদের বাংলা থিয়েটারের কোনও আদানপ্রদান সেভাবে গড়ে ওঠেনি।” বলেছেন, “ভারতীয় থিয়েটারের সঙ্গে আমাদের কোনও দিনই নিবিড় সম্পর্ক নেই, বা কোনও দিনই সম্পর্ক তৈরি হয়নি।” ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা-র তীব্র সমালোচনা করেছেন লক্ষ্যহীন নাট্যোৎসবের আয়োজনের কারণে। একই সঙ্গে প্রশ্ন তুলেছেন কেন এই বাংলায় তৈরি হতে পারল না এনএসডি-তুল্য একটি বিদ্যালয়। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যবিভাগে গুণী শিল্পীজন যুক্ত থাকলেও সেখানে গড়ে ওঠে না যথার্থ প্রয়োগিক নাট্যবিভাগ! ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ছোট আকারে আর্কাইভ তৈরি হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গে নানান প্রতিকূলতার মধ্যে সে-ধরনের প্রতিষ্ঠা গড়ে তোলবার চেষ্টা হলেও, শেষ পর্যন্ত সে পথ হারায়। তাঁর ষাট বছরের থিয়েটার জীবনের উপাত্তে বলতে হয়, ‘থিয়েটারের মানুষদের মধ্যে মাটি ছুঁয়ে চলার প্রবণতা ইদানীং দেখছি না; দেখছি না গভীরভাবে নাটককে পড়া, বোঝার ইচ্ছাটাও।’
রাজ্য জাতীয় আর বিশ্বদৃষ্টি আশ্রয়ী শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় আলাপচারিতা শেষ করেছেন প্রশ্নে। যার মধ্যে নিহিত আছে ভবিষ্যৎ-উত্তরণের স্পন্দন। শম্ভু-উৎপল উত্তরপর্বে শঙ্খ ঘোষের রচনার পর বাংলা থিয়েটারে এই দু’টি বই জিজ্ঞাসু আত্মসন্ধানীর হিরণ্ময় পাথেয়।
দ্বিতীয় বইটির নির্মাণে প্রশ্নগুলির অবলুপ্তিতে বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে বিভ্রান্তি আসে। কথার সূত্রে যে জিজ্ঞাসা ছিল প্রত্যাশিত, তার অনুপস্থিতির সঠিক কারণ জানা হয় না। বহু ক্ষেত্রে তথ্য সংযোগ হলে বিষয়টির সম্পূর্ণতা পাওয়া যেত। মহারাষ্ট্রের সুনীল শানবাগ সরকারি বেতন না নেওয়ার যে উল্লেখ আছে, সেখানে মনে পড়ে রমাপ্রসাদ বণিক এই সিদ্ধান্ত নিয়ে থিয়েটার করেছেন প্রায় তিন দশক আগে। দ্বিধা জাগে দু’টি বইতে নেহরু আর নেহেরু বানানে। দ্বিতীয় বইটিতে বের্লিনার— বার্লিনার, ব্রেশ্ট— ব্রেখ্ট পাই। কোন বানান উচ্চারণ সঠিক? ১৯৩১ সালে গ্রুপ থিয়েটার সংস্থার প্রতিষ্ঠাতাদের যে তিনটি নাম উল্লিখিত হয়, একটি পরিবর্তে ব্যবহার করা হয়েছে ক্লিফর্ড ওডেট্স্-এর নাম। ওডেট্স্ সেই সময় ছিলেন অভিনেতার ভূমিকায়। চার বছর পর ১৯৩৫-এ তাঁর রচনা বিখ্যাত ওয়েটিং ফর লেফটি নাটক অভিনীত হয়। পূর্বশ্রুত এই তথ্য সংশোনযোগ্য কি না তারও উল্লেখ নেই। প্রয়োজন ছিল টীকার সংযোজন। দুই গ্রন্থক সামান্য সতর্ক হলে পাঠকের দ্বিধা থাকত না।