পুস্তক পরিচয় ১

জীবনানন্দের ক্রমমুক্তি ঘটেছে তাঁর হাতে

জীবনানন্দের অগ্রন্থিত রচনার সর্বপ্রথম তালিকাটি (‘ময়ূখ’, জীবনানন্দ স্মৃতি সংখ্যা, ১৯৫৫) যৌথ ভাবে নির্মাণ করেছিলেন সুচরিতা দাশ ও ভূমেন্দ্র গুহ।

Advertisement
গৌতম বসু
শেষ আপডেট: ২৬ ডিসেম্বর ২০১৫ ০০:০১
শিল্পী: রফিকুন নবী (বই থেকে)

শিল্পী: রফিকুন নবী (বই থেকে)

অতিমানবিক আত্মবিশ্বাস, অটল মনোবল, যা অন্যান্য সম্পদের মধ্যেও জীবনানন্দ দাশের অন্তরের অন্যতম প্রধান সম্পদ ছিল, এই বিরূপ বিশ্বে বহু দূর পর্যন্ত রক্ষা করে এসেছিল তাঁকে— তা আমাদের এই ক্ষুদ্র আলোচনার বিষয় নয়। তাঁর সাহিত্যচিন্তা ও সমাজচেতনার কোনও রূপরেখা ফুটিয়ে তোলার কোনও প্রয়াসও আপাতত আমাদের লক্ষ্য নয়। সেই কাজটি দুই বাংলার অগণিত পাঠক-গবেষক ধারাবাহিক ভাবে নথিভুক্ত করে চলেছেন। আমরা কেবল এক মঙ্গলবার্তা ছড়িয়ে দিতে চাই। ‘ক্রমমুক্তি’ শব্দটির আবিষ্কার স্বয়ং জীবনানন্দই করেছিলেন কি না জানি না, কিন্তু এই বিশেষ শব্দটি তাঁর সমগ্র রচনাকর্মের উন্মোচনকে প্রতিফলিত করে বলে মনে হয়। জীবনানন্দের অগ্রন্থিত রচনার সর্বপ্রথম তালিকাটি (‘ময়ূখ’, জীবনানন্দ স্মৃতি সংখ্যা, ১৯৫৫) যৌথ ভাবে নির্মাণ করেছিলেন সুচরিতা দাশ ও ভূমেন্দ্র গুহ। ভাবলে বিস্ময় জাগে, ষাট বছর অতিবাহিত হওয়ার পরেও জীবনানন্দ সংক্রান্ত খননকার্যের সঙ্গে এখনও অদৃশ্য বাঁধনে যুক্ত রয়ে গিয়েছে ভূমেন্দ্র গুহর নাম। আমরা আরও বিস্মিত হই যখন লক্ষ করি, এই আবিষ্কার প্রক্রিয়াটি জীবনানন্দের পঞ্চান্ন বছর ব্যাপী আয়ুষ্কালের চেয়েও দীর্ঘ! ভূমেন্দ্র গুহর লিপ্ত থাকার সময়সীমাটি দীর্ঘতম হলেও স্মরণে রাখা প্রয়োজন থাকছেই যে, তিনি একা নন— দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়, দেবেশ রায় প্রমুখ লেখক-গবেষক ও ‘ভারবি’, ‘প্রতিক্ষণ’ প্রভৃতি প্রকাশনালয়ের অগ্রণী ভূমিকাও জীবনানন্দের লেখা পুনরুদ্ধারের প্রসঙ্গে উল্লেখনীয়। সমান্তরাল ভাবে বয়ে চলেছে ওপার বাংলার একাধিক সাহিত্য-গবেষক ও সম্পাদক কর্তৃক সংগঠিত জীবনানন্দের সাহিত্যকর্মের উপর নতুন করে আলো ফেলার স্বতন্ত্র প্রয়াস। মাতৃভাষার অমোঘ টানে, পৃথক ধারা দুটি মিলিত হতে পারল অবশেষে, এটিই আমাদের সেই মঙ্গলবার্তা। বেঙ্গল পাবলিকেশনস লিমিটেড সম্প্রতি ঢাকা থেকে প্রকাশ করল কলকাতা-নিবাসী ভূমেন্দ্র গুহ সম্পাদিত নির্বাচিত জীবনানন্দ দাশ মূলানুগ পাঠ গ্রন্থমালার প্রথম দুটি খণ্ড (প্রথম খণ্ড: কবিতা, দ্বিতীয় খণ্ড: জীবনানন্দের কবিতা বিষয়ে সম্পাদকের সুদীর্ঘ ভূমিকা)। খণ্ড দুটি হাতে তুলে নিয়ে যে বঙ্গসন্তান আনন্দাশ্রু সংবরণ করতে পারবেন, প্রকৃত অর্থেই তিনি কঠিন হৃদয়ের অধিকারী। আর যিনি পারবেন না, তাঁর সঙ্গে আমরা একযোগে অশ্রুপাত করব, এক বার নয়, দুই বার— প্রথম বার দূরের আকাশপানে অবিরাম চেয়ে থাকা জীবনানন্দের কথা ভেবে, দ্বিতীয় বার তাঁরই ভাবসন্তান, বহু ব্যাধির কারাবাস থেকে সদ্য মুক্তি পাওয়া ভূমেন্দ্র গুহর জন্য।

Advertisement

একটি প্রশ্ন। আগের সংকলনগুলি, বিশেষত দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত মহাগ্রন্থটি (জীবনানন্দ দাশের কাব্যসংগ্রহ, ভারবি, ১৯৯৩) কি তবে মূলানুগ বা সম্পূর্ণ নয়? গুরুত্বপূর্ণ এ প্রসঙ্গটির একটি ব্যাখ্যা আলোচ্য গ্রন্থমালার দ্বিতীয় খণ্ডে (পৃ ৪৯৩) আমরা পাই। পূর্বের ত্রুটিগুলি সংশোধন করে নিয়ে একটি নির্ভুল পাঠ উদ্ধার করবার লক্ষ সামনে রেখে ভূমেন্দ্র গুহ প্রতিটি রচনার ক্ষেত্রে কলকাতায় অবস্থিত জাতীয় গ্রন্থাগারে সুরক্ষিত মূল পাণ্ডুলিপি অনুসরণ করেছেন। সঠিক এই পদ্ধতিটি যে পূর্ববর্তী কাজগুলিতে সর্বত্র অনুসৃত হয়নি তার প্রমাণ অন্যত্রও পাওয়া যাচ্ছে। মরণোত্তর কাব্যগ্রন্থ আলোপৃথিবী-র (১৩৮৮/১৯৮২) ভূমিকায় অশোকানন্দ দাশ লিখছেন, ‘...১৯৭৮ খৃষ্টাব্দে কৃত্তিবাস ত্রৈমাসিকে অগ্রন্থিত কিছু কিছু কবিতা প্রকাশিত হয়। যে সব কবিতার কাটিং আমাদের কাছে ছিল না, পত্রপত্রিকার থেকে সংগ্রহ না করে, একত্রে সংগৃহীত কৃত্তিবাস থেকেই পেয়ে গেছি।’ প্রসঙ্গত, ‘কৃত্তিবাস’ সাহিত্যপত্রে (অক্টোবর ১৯৭৮) সুব্রত রুদ্র ৭১টি কবিতা সংকলিত করেছিলেন; তিনি লিখছেন, ‘আমি শুধু সেই সব কবিতাই সংগ্রহ করেছি যেগুলি বিভিন্ন সাময়িকী ও বর্তমানে দুর্লভ পত্রপত্রিকায় হারিয়ে ছিল।’ অর্থাৎ মূল পাণ্ডুলিপি যে সর্বত্র অনুসৃত হয়নি, ভূমেন্দ্র গুহর এই সিদ্ধান্তটির একটি ভিত্তি আছে বলে মনে হয়। আমরা আরও লক্ষ করি, জীবনানন্দের কবিতার সর্বোত্তম যে সংকলনটি আমাদের হাতে আছে, দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত সেই বইটিতেও কিছু কিছু ত্রুটি থেকে গিয়েছে। দুটি দৃষ্টান্ত, ‘যখন চিনির দাম বেড়ে গেছে ভয়ঙ্কর’ ও ‘গফুর, নীরবে তাহাকে আমি ডাকিলাম — তবু’ (যথাক্রমে জীবনানন্দের ২৬ এবং ৩২ নং খাতায় অন্তর্ভুক্ত) কবিতা দুটি ‘ভারবি’র সংকলনে অনুপস্থিত।

নির্বাচিত জীবনানন্দ দাশ/ মূলানুগ পাঠ, সম্পাদনা, ভূমিকা ও টীকা ভূমেন্দ্র গুহ।
বেঙ্গল পাবলিকেশনস (ঢাকা), পরি: নয়া উদ্যোগ, ৬০০.০০

আলোচ্য গ্রন্থমালার প্রথম খণ্ডটি জীবনানন্দের কবিতার একটি সুনির্বাচিত সংকলন। কবিতার এই খণ্ডটি সাজানোর সময় ভূমেন্দ্র গুহ প্রথা ভঙ্গ করেননি। তাঁর ক্রমটি এই রকম— ১। কবির জীবিতকালে প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থগুলির নির্বাচিত অংশ, ‘নাভানা’ সংস্করণ শ্রেষ্ঠ কবিতা-র অগ্রন্থিত অংশ, এবং মরণোত্তর কাব্যগ্রন্থ বেলা অবেলা কালবেলা-র নির্বাচিত অংশ, ২। প্রকাশিত-অগ্রন্থিত কবিতা এবং ৩। পাণ্ডুলিপি থেকে গৃহীত কবিতা। প্রথম ও দ্বিতীয় অংশের সঙ্গে পাঠকের সুগভীর পরিচয় আছে, সেই কারণে এ প্রসঙ্গে আমাদের বিশেষ কিছু বলবারও নেই। তৃতীয় অংশটি হয়ত সর্বজনপরিচিত নয়, যদিও এ অংশের অনেক কবিতাই দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সংকলনে উপস্থিত। তাঁর সমস্ত কবিতা ৪৮টি খাতায় নকল করবার পর জীবনানন্দ দাশ সেগুলি তোরঙ্গে বন্দি করে রেখেছিলেন। এগুলির মধ্যে প্রথম দুটি খাতা বাল্যরচনা সংবলিত, বাকি ৪৬টি খাতায় সংরক্ষিত রয়েছে ১৯৩১ থেকে ১৯৫৪ পর্যন্ত রচিত তাঁর সমস্ত কবিতা; এই বিপুল রত্নভাণ্ডার এখন জাতীয় গ্রন্থাগার কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে আছে। এই আকরের উপর নির্ভর করেই ২০০৫ থেকে ভূমেন্দ্র গুহ জীবনানন্দের মূলানুগ পাঠ গড়ে তুলছিলেন এবং, সুখের কথা, ৩ নং খাতা (১৯৩১) থেকে ৩২ নং খাতা (অক্টোবর-ডিসেম্বর ১৯৪০-এর লেখা) পর্যন্ত কবিতা উদ্ধারের কাজ (তরুণ গবেষক গৌতম মিত্রের আংশিক সহযোগিতা সহ) ইতিমধ্যে সুসম্পন্ন হয়েছে। উদ্ধারপ্রাপ্ত কবিতাগুলি ‘প্রতিক্ষণ’ সংস্থা পাণ্ডুলিপির কবিতা শিরোনামে ১৩টি খণ্ডে গ্রন্থভুক্ত করেছেন; এর পরে উদ্ধারের কাজটি বন্ধ হয়ে যায়। বলা বাহুল্য, যাকে আমরা নির্বাচিত কবিতা-র তৃতীয় অংশ বলে চিহ্নিত করেছি সেটি ‘প্রতিক্ষণ’ প্রকাশিত ১৩ খণ্ডের সংকলনের নির্বাচিত অংশ।

গ্রন্থমালার দ্বিতীয় খণ্ডের প্রায় সর্বাংশ জুড়ে অবস্থান করছে ৪৮০ পৃষ্ঠা ব্যাপী সম্পাদকের এক সন্দর্ভ। গদ্যরচনাটির প্রতি সুবিচার করতে হলে তাকে বিভিন্ন অধ্যায়ে বিভক্ত করে আলোচনা করতে হবে, তার পরিসর এখানে নেই। শুধু এইটুকু উল্লেখ থাক, এতগুলি শতাব্দী জুড়ে প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের মহাজনেরা যা কিছু ভেবেছেন তার একটি ক্ষুদ্র পরিচয় এখানে পাওয়া গিয়েছে।

জীবনানন্দ দাশের চলে যাওয়ার পর ৬১ বছর কেটে গিয়েছে। এত দিন তাঁর হস্তাক্ষর পড়ে পড়ে এক জন তাঁর জীবনের অনেকটাই কাটিয়ে দিচ্ছিলেন, অতি সম্প্রতি সেই এক জনও চলে গেলেন। পড়ে রইল নির্বাচিত জীবনানন্দ দাশ গ্রন্থমালার পরবর্তী খণ্ডের জন্মলগ্নগুলি এবং জীবনানন্দের ১৬টি খাতা।

আরও পড়ুন
Advertisement