প্রতীকী ছবি।
সুন্দরবনে জনবসতির ইতিহাস কত পুরনো? জানা যাচ্ছে, গভীর জঙ্গলের মধ্যে এমন কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন রয়েছে, যা এই অঞ্চলে এক প্রাচীন সভ্যতার অস্তিত্বের দিকে নির্দেশ করছে। খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ থেকে ১২০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ছিল সেই সভ্যতা— “আজ যে অঞ্চল সাগরের গড় জলস্তর থেকে মাত্র দুই থেকে চার মিটার উঁচুতে অবস্থিত এবং প্রতিটি জোয়ারে কয়েক ফুট জলের নীচে অবস্থান করে সেখানে কীভাবে জোয়ারের জলোচ্ছ্বাস থেকে বাঁচার কোনও সুরক্ষাব্যবস্থা ছাড়া একটি সভ্যতার জন্ম হয়েছিল আর তা টিকে ছিল! তবে কি সাগর সেই সময় আরও দক্ষিণে অবস্থান করত? কিংবা ভূমি কি এই সময়ের তুলনায় উঁচুতে অবস্থান করত?”
এমন হাজার ধাঁধা নিয়ে টিকে আছে সুন্দরবন। খাতায়-কলমে তার পরিধি যতখানি, তার একটা বড় অংশে আজ আর ‘বন’-এর চিহ্নমাত্র খুঁজে পাওয়া যাবে না। উজান বেয়ে আসা সুপেয়, মিষ্টি জলের সঙ্গে সাগরের লবণাক্ত জল মিশে তৈরি হয়েছিল সুন্দরবনের বিরল বাস্তুসংস্থানতন্ত্র— কিন্তু গত কয়েক শতাব্দীতে গঙ্গার মূল ধারা পদ্মার খাত বেয়ে বাংলাদেশে চলে যাওয়ায় সেই ভারসাম্য ব্যাহত হয়েছে, বিলুপ্ত হয়েছে বহু প্রজাতির প্রাণী, উদ্ভিদ। এক দিকে বিশ্ব উষ্ণায়নজনিত জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, আর অন্য দিকে মানুষের অবিবেচক লোভ, দুইয়ে মিলে আরও বিপন্ন হচ্ছে সুন্দরবন। ভূপ্রাকৃতিক কারণও রয়েছে বিপন্নতার— “ভারতীয় সুন্দরবনে বঙ্গোপসাগর ক্রমশ এগিয়ে এসে উপকূলের ভূমিকে গ্রাস করছে, ফলে নতুন কোনও দ্বীপ জেগে উঠছে না, বরং সুন্দরবন ক্রমশ ছোট হয়ে যাচ্ছে।”
ভারতীয় সুন্দরবন: একটি ভৌগোলিক রূপরেখা
কল্যাণ রুদ্র ও জ্যোতিরিন্দ্র নারায়ণ লাহিড়ী
৪০০.০০
আনন্দ
এই বইটিতে সুন্দরবনের স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যতের খোঁজ করেছেন দুই লেখক। তাঁদের মধ্যে এক জন নদী বিশেষজ্ঞ হিসাবে খ্যাত, অন্য জনের দীর্ঘ দিনের সুন্দরবন চর্চা সুবিদিত। ফলে, বইটি নেহাত গল্পগাছার সঙ্কলন নয়, গবেষণা ও ক্ষেত্রসমীক্ষাপ্রসূত তথ্যের সমাবেশ। ফলে, স্বীকার করতেই হয় যে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে বইটি সুখপাঠ্য নয়, বরং তথ্যভারে শ্লথ। কিন্তু, সেই তথ্যের প্রাচুর্যই বইটির মূল আকর্ষণ, যা আগ্রহী পাঠকের কাজে লাগবে। বইটির একটি ছোট অধ্যায় যেমন বরাদ্দ হয়েছে সুন্দরবনের প্রকৃত দ্বীপসংখ্যা নির্ধারণ সংক্রান্ত আলোচনায়। দীর্ঘতর অধ্যায়ে আলোচনা করা হয়েছে সেই অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড়, বৃষ্টি ও সমুদ্রতলের উচ্চতাবৃদ্ধি, এবং নদীনালা ও বাঁধ নিয়ে। লেখকরা উল্লেখ করেছেন বটে যে, শুধু প্রযুক্তি দিয়ে সুন্দরবনের বাঁধ বা মানুষ কাউকেই বাঁচানো যাবে না, কিন্তু প্রকৃতির সঙ্গে সহাবস্থানের রূপরেখা আরও বিস্তারিত হলে আগ্রহী পাঠকের উপকার হত।
এক দীর্ঘ ক্যানভাসে ভারতীয় কৃষির রাজনৈতিক অর্থনীতিকে ধরেছেন লেখক। বইয়ের গোড়াতেই তিনি ভারতীয় কৃষির শ্রেণিচরিত্র প্রতিষ্ঠা করেছেন, এবং তাঁর বিশ্লেষণ মোটের উপর সেই কাঠামো মেনেই এগিয়েছে। স্বাধীন ভারতের কৃষিনীতি সংক্রান্ত অধ্যায়টিতে ভূমিসংস্কারের প্রশ্ন বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে।
ভারতের কৃষি: একটি অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ
অপরাজিতা মুখোপাধ্যায়
৭৫০.০০
আনন্দ
পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতিতে ভূমিসংস্কারের প্রশ্নটির একটি বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। এই রাজ্যে শিল্পক্ষেত্রের গুরুত্ব হ্রাস পাওয়ার পাশাপাশি কৃষিক্ষেত্রের গুরুত্ববৃদ্ধির প্রবণতা সাম্প্রতিক কালের গবেষণায় ধরা পড়েছে। দেখা গিয়েছে যে, শুধু রাজ্যের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে শিল্পের তুলনায় আপেক্ষিক গুরুত্বই নয়, পশ্চিমবঙ্গের কৃষি সর্বভারতীয় ক্ষেত্রেও এগিয়ে রয়েছে। অপারেশন বর্গার ফলে কৃষিজমি থেকে উচ্ছেদের ভয় কমার ফলে কৃষিতে দীর্ঘকালীন বিনিয়োগ বৃদ্ধি, এবং কৃষকের নিরাপত্তাবোধ এ ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব ফেলেছে। অন্য দিকে, বিশেষত নব্বইয়ের দশকের পর থেকে পশ্চিমবঙ্গের কৃষিতে ‘রিভার্স ল্যান্ড রিফর্ম’-ও ঘটেছে।
ভারতীয় কৃষির উপর বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নীতি কী প্রভাব ফেলেছে, সে বিষয়ে আলোচনাটি এই বইয়ের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। একদা বহু-আলোচিত ডাঙ্কেল প্রস্তাব, দোহা ও কানকুন সম্মেলন ইত্যাদির আলোচনার মাধ্যমে সেই ঐতিহাসিক গতিপথটিকে চিহ্নিত করা গিয়েছে। তবে, আগ্রহী পাঠকের মনে হতে পারে যে, এই অংশটি ইতিহাসকে যতখানি গুরুত্ব দিয়েছে, বর্তমান সংক্রান্ত আলোচনা তার তুলনায় কম। বিটি তুলো কী ভাবে ভারতীয় কৃষকের জীবনে প্রভাব ফেলেছে, তার বিশ্লেষণটিও উল্লেখযোগ্য।
ভারতীয় কৃষির সঙ্কট হিসাবে লেখিকা চিহ্নিত করেছেন জমির নিম্ন উৎপাদনশীলতা, উৎপাদন বৃদ্ধির হারে তাৎপর্যপূর্ণ অগ্রগতির অভাব, খাদ্যশস্যের দাম না পাওয়া, উপকরণের দামের ঊর্ধ্বগতি ইত্যাদিকে; আবার শিল্পের প্রয়োজনে জমি অধিগ্রহণের নীতিকেও। কেউ অভিযোগ করতে পারেন যে, তিনি কৃষির মূল সমস্যাটিকে এড়িয়ে গিয়েছেন— প্রকৃত বাজারব্যবস্থার অভাব। কৃষকের পক্ষে যদি বাজারের নাগাল পাওয়া সম্ভব না হয়, যদি মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণির উপর নির্ভরতা অব্যাহত থাকে, তা হলে ভারতীয় কৃষির আদৌ উন্নতি সম্ভব কি?