Surveillance

Book review: সুরক্ষার নামে রাষ্ট্র যা করেই থাকে

ভারত কি আদৌ ব্যক্তিস্বাধীনতায় বিশ্বাস করে?

Advertisement
তাপস সিংহ
শেষ আপডেট: ৩১ জুলাই ২০২১ ০৭:৪৪

ডিজিটাল যুগে গণনজরদারি: রাষ্ট্র ও মানবাধিকার
সুজাত ভদ্র
১২০.০০
গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা সমিতি (এপিডিআর)

গোপনীয়তার মালিকানা কি আদৌ কোনও কালে ছিল?

Advertisement

ইতিহাস কিন্তু বলে, ব্যক্তিমানুষের গোপনীয়তা হরণের একটা স্বাভাবিক প্রবণতা দেশে-বিদেশে নানা কালে নানা রূপে দেখা গিয়েছে। নাগরিক সমাজের উপর নজরদারির ইতিহাসও প্রাচীন। ব্যক্তির গোপনীয়তার সঙ্গে কী ভাবে যেন রাষ্ট্রের সুরক্ষার প্রশ্নটা জড়িয়ে যায়, বা জড়িয়ে দেওয়া হয়। সামান্যতম সমালোচনা বা বিরুদ্ধ স্বর শুনলেও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি কী ভাবে যেন দেশদ্রোহী হয়ে ওঠেন!

প্রসঙ্গটা এখন আলোচনা-তর্ক-বিতর্কের একেবারে কেন্দ্রে। পেগাসাস স্পাইওয়্যার নিয়ে যে বিতর্ক প্রবল ঝড়ে পরিণত হয়েছে, সেই বিতর্কের অবসান কিন্তু এখনই হবে না। বরং, তা শাখা-প্রশাখা বিস্তার করবে। এই আবহেই হাতে এল এমন একটি বই, যা আলো ফেলেছে সুরক্ষা বা নিরাপত্তাকে ঢাল করে ব্যক্তিস্বাধীনতা ও গোপনীয়তা হরণের উপর। বইটিতে এসেছে অধুনা বহুচর্চিত পেগাসাস প্রসঙ্গও।

মানবাধিকার বা সামাজিক অন্যান্য অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে এপিডিআর এর আগেও অসংখ্য পুস্তক-পুস্তিকা প্রকাশ করেছে। কিন্তু, ডিজিটাল যুগে গণনজরদারির উপর বাংলায় এর আগে কোনও বই প্রকাশিত হয়েছে বলে জানা নেই। এই গ্রন্থের লেখক, দীর্ঘ দিনের মানবাধিকার কর্মী সুজাত ভদ্র এর আগে মৃত্যুদণ্ড, কাশ্মীর, উত্তর-পূর্বাঞ্চল, সিএএ-এনআরসি সমেত মানবাধিকার আন্দোলন ও গণতান্ত্রিক অধিকার সংক্রান্ত একাধিক বই লিখেছেন।

এই বইয়ে সুজাত অবশ্য সূত্র টেনেছেন সেই অষ্টাদশ শতক থেকে। দেখিয়েছেন, কী ভাবে যুগে যুগে রাজতন্ত্র ও শাসককুল দেশের সুরক্ষার নামে বিভিন্ন সন্দেহভাজনের উপর নজরদারি চালিয়ে গিয়েছে, রাষ্ট্রের সুরক্ষার নামে কী ভাবে তাঁদের তুলে এনে অত্যাচার চালানো হয়েছে। পরের দিকে প্রযুক্তির অত্যাশ্চর্য উন্নতির পাশাপাশি লাগাতার নজরদারিও তার ক্ষেত্র বিস্তার করে চলেছে।

বহু তথ্য ব্যবহার করে, এবং বিশ্লেষণের মাধ্যমে লেখক দেখিয়েছেন, কী ভাবে এই নজরদারির ফলে নাগরিক অধিকার ক্ষুণ্ণ হয়, ব্যক্তিগত গোপনীয়তা বলে কার্যত কোনও কিছুরই আর অস্তিত্ব থাকে না! ডিজিটাল বিপণনের নানা প্ল্যাটফর্ম, নানা আপাত-নিরীহ ‘অত্যাবশ্যক’ অ্যাপে আমরা যে আমাদের আর্থিক লেনদেন ও ব্যক্তিগত নানা তথ্য ঢেলে দিই, তা কে বা কারা কোন উদ্দেশ্যে ব্যবহার করছে, তা কি সত্যিই জানি?

ইজ়রায়েলি সংস্থা এনএসও গ্রুপের সৃষ্টি পেগাসাস একটি অত্যাধুনিক স্পাইওয়্যার। আইফোন ও অ্যান্ড্রয়েড স্মার্টফোন হ্যাক করার এক অসাধারণ অস্ত্র সরকারের। সরকারের— কারণ স্পাইওয়্যার প্রযুক্তি প্রচুর অর্থের বিনিময়ে বিক্রি করা হয় শুধু সরকারকেই, অর্থাৎ রাষ্ট্রকে। প্রশ্নটা এখানেই উঠছে। দেশের সুরক্ষার স্বার্থে আইন মোতাবেক এতশত ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও পেগাসাসের মতো স্পাইওয়্যার দরকার হয় কেন? দেশের বিরোধী রাজনৈতিক নেতা, বিচারপতি, গোয়েন্দাকর্তা, শিল্পপতি, মানবাধিকার কর্মী, সাংবাদিকদের কথা ছেড়েই দিলাম, কিন্তু একই সরকারের মন্ত্রী-আমলাদের ফোনেও আড়ি পাততে হচ্ছে কেন? বিশ্বাসযোগ্যতা কি তা হলে একেবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে?

এই বইয়ে যথার্থ ভাবেই বলা হয়েছে, যে সব রাষ্ট্র সাইবার অপরাধীদের পাকড়াও করার জন্য সাইবার নিরাপত্তার কথা বলে, নাগরিকদের অধিকার কাড়ার জন্য সামাজিক অনুমোদন চায়, তারাও কিন্তু একই ভাবে সাইবার যুদ্ধে লিপ্ত থাকে। এন পার্লরথ নামে এক গবেষক ২০১৩ সালে দেখান, বিশ্বের প্রায় ২৫টি দেশ তাদের নিজেদের নাগরিকদের উপর নজরদারি চালাতে ‘ফিনস্পাই’ নামে এক সফটওয়্যার ব্যবহার করছে। গামা ইন্টারন্যাশনাল এই সফটওয়্যারের একমাত্র বিক্রেতা। যেমন, ইজ়রায়েলের এনএসও সংস্থা বিক্রি করে পেগাসাস প্রযুক্তি। অভিযোগ উঠেছে, ২০১৬ থেকে ২০১৯-এর মধ্যে ভারতে ৪০ জন সাংবাদিক-সহ প্রায় তিনশো জনের ফোনে আড়ি পেতেছে নরেন্দ্র মোদীর সরকার।

তবে ভারত কি আদৌ ব্যক্তিস্বাধীনতায় বিশ্বাস করে? সুজাত জানাচ্ছেন, ২০১৫ নাগাদ সুপ্রিম কোর্টে বিখ্যাত পুত্তুস্বামী মামলায় সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকারকে ভারত কখনওই স্বীকৃতি দেয়নি। অবাধ নজরদারি চালানোর জন্য রাষ্ট্রের অবাধ ক্ষমতা থাকা উচিত!

ইউনিভার্সিটি অব ইস্ট অ্যাংলিয়া-র স্কুল অব ল’-এর অধ্যাপক, যিনি তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা করেন, সেই পল বার্নাল এবং আরও কয়েক জন বিশেষজ্ঞ সবিস্তার দেখিয়েছেন, নজরদারি ব্যবস্থা যে অজুহাতে চালু রাখা হয়, সেই ‘নিরাপত্তা’ই সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় নজরদারি ব্যবস্থার জন্য! ২০১৩ সালে হার্ভার্ড ল’ জার্নাল-এ প্রকাশিত নিবন্ধে নিল রিচার্ডস বলেন, তথ্য হল শক্তি বা ক্ষমতা। কিন্তু এখানে ব্যক্তিমানুষের তথ্যের উপর রাষ্ট্রের সর্বময়তা এক ভিন্ন ধরনের ক্ষমতা তৈরি করছে, তা হল দমনের ক্ষমতা। অন্য দিকে, মানুষের তথ্য জানার অধিকার হল নাগরিকের স্বীকৃতির অধিকার। দু’টির চরিত্র ভিন্ন। গোপন নজরদারির প্রধান বৈশিষ্ট্যই হল মানুষের উপর প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ বাড়ানো। এই কারণেই গণতান্ত্রিক দেশের রাজনৈতিক শাসক বা স্বৈরতান্ত্রিক দেশের রাষ্ট্রনায়কদের ডিজিটাল নজরদারি ব্যবস্থা খুবই পছন্দের।

এই বইয়ের তথ্য ও গবেষণা শুধু ভারতীয় প্রেক্ষিতেই সীমাবদ্ধ নেই, তা ছড়ানো বিভিন্ন দেশে। বেশ কয়েকটি অধ্যায়ে ভাগ করা হয়েছে বইটিকে। যেমন, ‘এসকেপ ফ্রম ফ্রিডম’, ‘‘টিকটিকি’ ট্র্যাডিশন’, ‘অতিকথার আড়ালের আমেরিকা’, ‘জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ আর এডওয়ার্ড স্নোডেন’, ‘রাষ্ট্র-কর্পোরেট যৌথবাহিনী’, ‘জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের সঙ্গে গুগল প্রধানের কথোপকথন’, ‘‘মেঘ’ মুলুকের মরীচিকা’ প্রভৃতি।

সুজাত দক্ষ গবেষক। যে কোনও পুস্তক রচনার সময় তিনি প্রচুর গবেষণালব্ধ তথ্য ব্যবহার করে থাকেন। এ ক্ষেত্রেও তা করেছেন। প্রচুর বই, গবেষণাপত্র, সংবাদ ও সাময়িকপত্র ঘেঁটে সংগ্রহ করেছেন অজস্র তথ্য। সূত্র-নির্দেশেও তার উল্লেখ রয়েছে। তবে, গবেষণামূলক আরও দু’টি গ্রন্থের সাহায্য নিলে তাঁর এই তথ্যভান্ডার হয়তো আরও সমৃদ্ধ হত। একটি স্পাইং ফর দ্য পিপল: মাও’স সিক্রেট এজেন্টস, ১৯৪৯-১৯৬৭। লেখক মাইকেল শোনেল্‌স। মাও ৎসে তুং-এর চিনের গুপ্তচর বাহিনীর কার্যকলাপ, বিশ্ব রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে। শোনেল্‌স ২৫ বছরেরও বেশি সময় চিনের রাজনীতি ও ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করেছেন। দ্বিতীয় বইটি ব্রিটানি কাইজার-এর টার্গেটেড: মাই ইনসাইড স্টোরি অব কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা অ্যান্ড হাউ ট্রাম্প, ব্রেক্সিট অ্যান্ড ফেসবুক ব্রোক ডেমোক্র্যাসি। বইটির শিরোনামেই স্পষ্ট এর বিষয়বস্তু।

তবে, ডিজিটাল যুগে গণনজরদারি একটি অসাধারণ বই, বিশেষ করে দেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে। আধুনিক ভাষায় ‘কনটেন্ট’ ভাল। কিন্তু মুদ্রণ পারিপাট্যের অভাব রয়েছে, প্রচ্ছদ মামুলি, একটি অধ্যায়ের সমাপ্তির পরেই তার নীচ থেকে আর একটি অধ্যায়ের সূচনা বইয়ের গুণগত মানকে পিছিয়ে দেয়। আশা করা যায়, পরবর্তী সংস্করণে এই সব ত্রুটি সংশোধিত হবে।

আরও পড়ুন
Advertisement